বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান শতকরা প্রায় ২৪ ভাগ হলেও, গ্রামীণ বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল।
সামাজিক ন্যায়বিচারের এক অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে, সব মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য নিরাপত্তা। খাদ্য ও কৃষির গুরুত্ব বোঝাতে সবুজ বিপ্লবের জনক নোবেলজয়ী অধ্যাপক নরম্যান বোরলাগ (Norman Ernest Borlaug) বলেছিলেন- “ক্ষুধা নিঃসন্দেহে উন্নয়ন ও শান্তির অন্যতম বাধা”। অনুরূপ উক্তি করেছিলেন নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী লর্ড জন বয়ড “ক্ষুধার্ত পেটে তুমি কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না”। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সদ্য স্বাধীন দেশে প্রথম বক্তৃতায় অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। সুতরাং বর্তমান সরকার-ঘোষিত লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে একটি সমৃদ্ধ ও সুখী ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপায়নে সর্বাগ্রে বিবচেনা আনতে হবে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি।
সুখের বিষয় হচ্ছে, স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আজ হিসাব করলে দেখেতে পাই নানা প্রতিকুলতা সত্ত্বেও আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে কৃষিক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লব। গবেষণার ফলে আবিষ্কৃত নতুন নতুন কৃষি-প্রযুক্তি কৃষকের মাঠে প্রয়োগের ফলে দানা শস্যসহ অন্যান্য কৃষিখাদ্যের উৎপাদন প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। এ বিশাল অর্জনের কৃতিত্ব, কৃষিবিদ ও দেশের কৃষককূলের। সময়োপযোগী কৃষিনীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে সরকারের কৃতিত্বও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশে কৃষিক্ষেত্রে এবিপ্লবের সূচনা করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যথার্থই অনুভব করেছিলেন সোনার বাংলা রূপায়নে কৃষি উন্নয়নের বিকল্প নেই। যদিও গত ৪ দশকে কৃষি উৎপাদন প্রায় তিন গুণ বেড়েছে, তবুও দেশে যেকোনো শস্যের গড় ফলন যেকোনো উন্নত দেশের চাইতে এখনও অনেক কম। সুতরাং কৃষিতে উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তবে নানা কারণে সবুজ বিপ্লবে উদ্ভাবিত অতি উচ্চ উপকরণ নির্ভর প্রযুক্তিসমূহের প্রয়োগে শুধু যে কাঙ্ক্ষিত ফলন লাভ হচ্ছে না তা নয়. প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশে নানা রকম দীর্ঘমেয়াদী কু-প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে। কৃষিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার এবং অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে কৃষিজমি ও পরিবেশ বিপন্ন হতে চলেছে। নিচে এদের কয়েকটি উল্লেখ করছি:
১. অপরিকল্পিত রাসায়নিক পদার্থের যেমন, সিনথেটিক কীটনাশক, সার ব্যবহার ও শিল্প বর্জ্য দ্বারা ভূমির অবক্ষয় ও পরিবেশ দূষণ মারাত্মক আকার নিয়েছে।
২. একক প্রজাতির নিবিড় চাষে জীববৈচিত্র্য আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। মাটিতে নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান হ্রাস পেয়ে উৎপাদনক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
৩. কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহারের কুপ্রভাব পরিবেশের অন্যান্য জীব এমনকি মানবস্বাস্থ্যেও অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
৪. অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন, শিল্পায়ন, ইটভাটা নির্মাণ, নগরায়নের ফলে প্রতিদিন ২২০ একর তথা প্রতি বছর ১% হারে কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে। গত ৪০ বছরে এভাবে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে গেছে। কৃষি জমিতে ইটভাটা এক মহাক্যান্সার, যা ভবিষ্যৎ কৃষির জন্য এক ঘাতকব্যাধি।
৫, বর্তমানে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ৩-৪ হাজার লিটার পানি ব্যবহৃত হয়। অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্ত পানিস্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে উত্তরাঞ্চলে মরুকরণের পূর্বাভাস লক্ষনীয়।
৬. কৃষিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ আশংকাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে মাটি অনুর্বর ও প্রাণহীন হয়ে পড়েছে।
৭. মাংস ও পোল্ট্রিশিল্পে খাদ্যের সাথে সিনথেটিক রাসায়নিক অ্যান্টিবায়োটিক ও ক্ষতিকর বৃদ্ধিকারক রাসায়নিক মানবস্বাস্থ্যে বিপর্যয় আনতে পারে। ফল, মাছ ও অন্যান্য কৃষি খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিকের সংমিশ্রণ সর্বত্র আতংক সৃষ্টি করছে।
এসব চ্যালেঞ্জের সাথে নতুন ও আরও আতংকজনক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা। বলা হচ্ছে, আগামী কয়েক বছরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক বিরাট অংশ সমূদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে। লবণাক্ততায় আবাদি জমি নষ্ট হওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি, সময়মত বৃষ্টিপাত না হওয়া, ঋতুবৈচিত্র্য ও তাপমাত্রার পরিবর্তন, কৃষিব্যবস্থাকে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এছাড়া বাজারব্যবস্থার ত্রুটির ফলে কৃষক ও ভোক্তা উভয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য চাই জ্ঞাননির্ভর টেকসই প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং সথাসময়ে তা কৃষকের মধ্যে প্রয়োগ। প্রয়োজন দূরদর্শী নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ যেন সমস্যাভিত্তিক ধারাবাহিক গবেষণায় কৃষিতে প্রযুক্তিগত ও জ্ঞানের নিরবিচ্ছিন্ন উন্নয়ন হয়।
এক হিসেবে দেখা গেছে যে, এদেশে কৃষি-গবেষণায় এক টাকা বিনিয়োগে তিন টাকার বেশি রিটার্ন আসে। সুতরাং কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। গতানুগতিক খাপ খাওয়ানোর কৌশল ও সনাতন আনুভূমিক কৃষির মধ্য দিয়ে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য যোগানের নিশ্চয়তা দুরূহ। কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং শস্যবীমা চালু করতে হবে। বর্তমান সরকারকে কৃষিবান্ধব সরকার বলা হয়। নানা রকম চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে কৃষি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্যনীয়। এসব পদক্ষেপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
ক) কৃষি উপকরণ সার ডিজেল এবং কৃষিকাজে জ্বালানির মূল্যহ্রাস/ভর্তূকি প্রদান, আইলাদুর্গত ও হাওড় এলাকায় কৃষকদের কৃষি সহায়তা ও পুনর্বাসন, মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ, কৃষিকার্ড প্রবর্তন এবং কার্ডের মাধ্যমে কৃষকদের সেচের জন্য ডিজেল প্রদান, কৃষিখাতে নানারকম ভর্তুকি, ই-কৃষির প্রচলন, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজন কৌশল এবং বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষিপুরস্কার পূনরায় চালু করা।
খ) কৃষিনীতি প্রণয়ন, অন্যান্য কৃষি সম্পর্কিত নীতি প্রণয়ন কৃষি উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বর্তমান সরকার জাতীয় শিল্পনীতিতে পরিবেশবান্ধব টেকসই প্রযুক্তি উন্নয়নে কৃষি গবেষণা কার্যক্রমকে জোরদার করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। যা প্রশংসনীয়। কৃষি ও শিল্পোৎপাদনে জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্ব অনুধাবন করে ন্যাশনাল বায়োটেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়েছে।
কৃষি উৎপাদন লাভজনক না হলে কৃষক বাঁচবে না। ভর্তুকি দিয়ে হলেও কৃষককে বাঁচাতে হবে। তা করা না হলে বিশাল জনসংখ্যার এদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহারের লক্ষ্যে কোষ ও আণবিক স্তরে গবেষণার মাধ্যমে মৌলিক জ্ঞান সৃজন এবং কৃষিতে এদের প্রয়োগে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। বায়োটেকনোলজি ও জীন প্রকৌশলের মাধ্যমে কৃষিতে নানা রকম ঘাত সহনশীল ফসল ও প্রাণীর জাত সৃষ্টি করা সম্ভব। তবে জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে উদ্ভাবিত যেকোনো নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের আগে জৈব নিরাপত্তা (বায়ো-সেফটি) নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ প্রয়োজন।
জাতীয় শিক্ষানীতির মতো ই-কৃষির নীতিমালাও সকলের মতামতের জন্য উন্মুক্ত করা প্রয়োজন। ই-কৃষি ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্ভব নয়। ই-কৃষি বর্তমান বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা দূর করার কাজে সহায়ক হতে পারে। দক্ষ বাজারব্যবস্থার অভাবে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত। এক্ষেত্রে গত ২০১০ সালে অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অলিভার উইলিয়ামসন-উদ্ভাবিত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রবর্তন করা যেতে পারে। চুক্তিভিত্তিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় এ তত্ত্বের সফল ব্যবহার আমাদের দেশেও দেখা যায়। এক্ষেত্রে কৃষক ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান উভয়ে উপকৃত হয়। আমাদের দেশে বাজার ব্যবস্থার জন্য গত কয়েক বছর আশংকাজনকভাবে কৃষক গোলআলু, টমেটো এমনকি ধানের যথাযথ দাম পায়নি। সীমিত সম্পদ ব্যবহারে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সবুজ বিপ্লবের জনক নরম্যান বোরলাগ ২১ শতকে জৈব প্রযুক্তির (বায়োটেকনোলজি) প্রয়োগে কৃষিতে একটি নীল বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
যদিও জলবায়ু পরিবর্তন, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ, অতিরিক্ত উপকরণ ও মাত্রাতিরিক্ত প্রযুক্তি-নির্ভরতা কৃষিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। তবে লাগসই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সঠিক নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে কৃষিকে আরও উৎপাদনশীল করা সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য হুমকি মোকাবিলার মাধ্যমে দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন: ১) কৃষিগবেষণা ও সম্প্রসারণ-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, (২) আইনের মাধ্যমে ভূমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং (৩) জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার।
সকল চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও জৈব-প্রযুক্তির(বায়োটেকনোলজি) একজন গবেষক হিসেবে আমি মনে করি, দিন বদলের সংগ্রামে এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণে কৌতূহলী বিজ্ঞানীদের কর্মকান্ড এগিয়ে চলবেই। নতুন প্রযুক্তি নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হবে। তবে যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতীয়ভাবে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। গতানুগতিক ধারায় পরিবর্তন আনা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে নরম্যান বোরলাগের বাণীটি স্মরণ করতে চাই: “Change we must, or we will perish as species, just as did the dinosaurs in the late Cretaceous”. তবে যেকোনো পরিবর্তনের জন্য চাই সরকার, রাজনীতিক নেতা, বিজ্ঞানী, জনগণ, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী ও গণমাধ্যমসহ সবার একযোগে পরিকল্পিত ও সতত প্রচেষ্টা। দু:খজনক হলেও সত্যি যে, বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরপত্তায় চ্যালেঞ্জিং বিষয় হচ্ছে দক্ষ বাজার ও বিতরণ ব্যবস্থা এবং ধনী দেশগুলোর অতিভোগের মানসিকতা। সবশেষে মহাত্মা গান্ধীর একটি উক্তি টেনে সমাপ্তি টানছি; মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন: “The world provides enough to satisfy every men’s need, but not every men’s greed.”
[লেখক: অধ্যাপক ড. মোঃ তোফাজ্জল ইসলাম, বায়োটেকনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সালনা, গাজীপুর-১৭০৬। মোবাইলঃ ০১৭১৪-০০১৪১৪;
ই-মেইলঃ tofazzalislam@yahoo.com]
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com