দুঃখিত। এটুকুতেও মনের ভাবটি প্রকাশ হচ্ছেনা।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবর আসে ১৯ জুলাই রাতে। কিন্তু ১৬ জুলাই থেকেই কান পেতেছিলাম কখন দঃসংবাদটি আসে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে খবর আসছিল হুমায়ূন আহমেদের শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে। যদিও ১৮ জুলাই অন্যপ্রকাশের প্রকাশকের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছিল- তার শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অন্য ‘বরাত’ গুলো থেকে পাওয়া খবরে ছিল দুঃসংবাদ নিকটবর্তী হবার আভাস। তাই পত্রিকা, টেলিভিশন সবার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল মৃত্যুর খবর আসা মাত্র হুমায়ূন আহমেদ বিষয়ক কতো খবর কতো দ্রুত দেওয়া যায়।
পত্রিকা যতো সহজে খবর পরিবেশন করতে পারে, টেলিভিশনের বেলাতে ততোটাই কঠিন। কারণ হচ্ছে ভিডিও ফুটেজ। সেই কাজটিকে অবশ্য কঠিন করে রাখেননি হুমায়ূন আহমেদ নিজেই। গত মে-জুনে ঢাকা ঘুরে যাওয়াতে কম- বেশি সব চ্যানেলের কাছেই তার নুহাশপল্লীতে দেওয়া শেষ সাক্ষাৎকার এবং আসা-যাওয়ার বেলায় বিমান বন্দরের ফুটেজ ছিল। ফলে মৃত্যুর খবর আসার পর থেকে লাশ আসা অবধি চ্যানেলগুলো ঐ ফুটেজ ব্যবহার করেই হুমায়ূন আহমেদ বিষয়ক খবর পরিবেশন করেছে।
দুই-তিনটি চ্যানেল যুক্তরাষ্ট্রের জানাজা এবং বিমানে মরদেহ নিয়ে রওনা হবার ভিডিও ফুটেজও দেখাতে পেরেছে।
এই খবরগুলো যখন প্রচার হচ্ছিল তখনই যুক্তরাষ্ট্র থেকে খবর পাই হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ যেদিন আসবে সেদিন বারডেমে রাখা হবে, তারপর শহীদ মিনার হয়ে দাফন করা হবে নুহাশপল্লীতে। এই খবরের ভিত্তিতেই কভারেজ প্ল্যান করা হয়ে যায়। কিন্তু মরদেহ রোববার না এসে যখন সোমবার এলো, তখন ঐ একদিনের বিলম্বের মধ্যে ‘দাফন’ নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্বটি দানা বেঁধে গেল। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ঢাকায় পৌঁছে জানালেন হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন এসে পৌঁছালে দাফন কোথায় হবে, এনিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ওদিকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সভাপতি হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে দাফন কোথায় হবে এনিয়ে একটা আনুমানিক ধারনা দিয়ে যাচ্ছিলেন গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে। কিন্তু তিনিও শেষ কথাটি বলতে পারছিলেন না। তবে হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই আহসান হাবিব বরাবরই দাফনের স্থান সম্পর্কে যে ইংগিত দিচ্ছিলেন সেখানে নুহাশপল্লীর কোন সম্ভাবনা ছিল না। বলা যায় ২০ জুলাই থেকেই মিডিয়া কর্মীরা দাফন কোথায় হবে, এই খবরের দিকেই মনোযোগী হয়ে পড়তে থাকেন। এই জাতীয় কোন ছিঁটেফোঁটা খবর পাওয়া মাত্র টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ‘ব্রেকিং’ আকারে পরিবেশন করতে থাকে। বিপত্তির শুরু সেখানেই।
কোন একটি সংবাদ চ্যানেল হঠাৎ সর্বশেষ ঢঙে জানাল নুহাশপল্লীতেই হবে হুমায়ূন আহমেদের দাফন। অন্য চ্যানেলগুলো তখনো বলে যাচ্ছিল শাওন দেশে ফিরলে সিদ্ধান্ত। এই খবরগুলো প্রচার করতে গিয়েই টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ধীরে ধীরে দাফনের স্থান বিষয়ে নিজেরাই অবস্থান নিতে থাকে। তার একটি বড় প্রমাণ শহীদ মিনারে নুহাশপল্লীতে দাফনের বিষয়ে শাওনের বক্তব্য মোবাইল ফোনে (এটা নাকি শাওনের অজ্ঞাতে ধারণ করা হয়েছিল?) ধারণ করে এক্সক্লুসিভ দাবি করে প্রচার করা। এখানে ওই চ্যানেলটির নুহাশপল্লীতে দাফনের একটি স্বপক্ষ অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায় সাধারণ দর্শকের কাছে। আরেকটি সংবাদ চ্যানেলও দাফন বিতর্ক চলাকালীন শাওনের নুহাশপল্লীর পক্ষে বক্তব্য গভীর রাতে প্রচার করে। নামাজে জানাজার পর হুমায়ূন আহমেদকে হিমঘরে রেখে দাফন দ্বন্দ্ব আরো জমে উঠে। সন্ধ্যার পর মিরপুরে হুমায়ূন আহমেদের মায়ের বাসায় পারিবারিক বৈঠক বসার আগেই চ্যানেলগুলো প্রচার করতে থাকে বৈঠক শুরু হয়েছে। এবং বৈঠকে কে কে আছেন। যাদের কথা বলা হচ্ছিল তারা তখনো বৈঠকে গিয়ে পৌঁছাননি। এদিকে একটি সংবাদ চ্যানেল সর্বশেষ ঢঙে জানিয়ে দিলো হুমায়ূন আহমেদের দাফন হবে বনানীতে। বাকিরা তখন জানাতে শুরু করলো মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থান অথবা বনানীতে দাফন হবে। নুহাশপল্লীর নাম তখন বাদ পড়ে গেছে। এক্ষেত্রে বরাত দেওয়া হচ্ছিল হুমায়ূন আহমেদের ভাই আহসান হাবিবের। আর কোন কোন চ্যানেল তখনো শাওনের কান্না জড়িত নুহাশপল্লীতে দাফনের আর্জি প্রচার করে যাচ্ছিল প্রতি বুলেটিনেই। কিন্তু হুমায়ুন আহমেদের পরিবারের অন্য সদস্যদের এই বিষয়ক বক্তব্য তখন প্রচার হচ্ছিল না।
২৩ জুলাই রাত সোয়া নয়টার দিকে জাফর ইকবাল জানান তাদের এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আরো কিছু সময় দরকার হবে। হয়তো মধ্যরাতও হয়ে যেতে পারে। এর কিছু পরই টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ‘ব্রেকিং’ খবর জানাতে থাকে যে হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের সদস্যদের প্রধানমন্ত্রী ডেকেছেন। প্রথম শুরু করে একটি চ্যানেল, তাদের দেখাদেখি বাকিরাও। যাচাই ছাড়াই। পরে জানা যায় - তারা সমঝোতা বৈঠকে বসেছেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রীর বাসায়।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু এবং দাফন নিয়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কার আগে কে খবর জানাবে এই ‘অসুস্থ’ প্রতিযোগিতার কবলে পড়ে বিভ্রান্ত হতে হয়েছে ‘অসহায়’ দর্শকদের। কারণ দর্শক কোন সর্বশেষ, ব্রেকিং বা এই মাত্র পাওয়া খবরটি সঠিক তাতে ভরসা রাখতে পারছিলো না। আরেকটি কথা বলে রাখতেই হয় এই দফার লড়াইয়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কোন খবরটি ব্রেকিং বা সর্বশেষ খবর হতে পারে সেই বিচার বিবেচনা বোধটি হয়তো হারিয়ে বসেছিল!
আরো যে ভুল টেলিভিশন চ্যানেলগুলো করেছে তা হলো লাশের ছবি দেখানো। এটা টেলিভিশন সাংবাদিকতার স্টাইলশিটে নিষিদ্ধের তালিকায় তোলা। কিন্তু কোন কোন টেলিভিশন ‘অতি’ পরিবেশনে লাশ দেখানোর ক্ষেত্রে সংযমী হতে পারেনা।
শোকাবহ অবস্থায় বৃদ্ধা মায়ের বক্তব্য নেওয়াটা জরুরি কতোটা সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। সর্বশেষ ২৯ জুলাই ড. ইউনূস যখন হুমায়ূন আহমেদের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তখন সাংবাদিকরা আবারো তার মায়ের কাছে দাফন বিষয় নিয়ে জানতে চান। এই জানতে চাওয়াটা বাড়াবাড়ি পর্যায়েই পড়ে। নৈতিকতার সীমানা পেরিয়ে যায়। কারণ এই প্রশ্নের মাধ্যমে পারিবারিক বিরোধকে মিডিয়া আবারো সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে।
সরাসরি সম্প্রচার প্রসঙ্গেও বলা দরকার। শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর পর্বটি যখন সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছিল, তখন দর্শকদের আগ্রহের জায়গাটি ছিল হুমায়ূন আহমেদে কফিনের পাশে তার বৃদ্ধা মা, শাওন, নোভা, শীলা, নুহাসের ছবি। কোন কোন চ্যানেল তা না করে বারে বারে স্টুডিওতে ফিরছিলেন তাদের রিপোর্টারদের কাছে, আর তারা বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করছিলেন। যা দর্শক অপছন্দের বিষয় ছিল। আর কেউ কেউ শহীদ মিনারেই হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে মন্তব্য করতে এমন ব্যক্তিদের সামনে মাইক্রোফোন ধরছিলেন, যাদের হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে জানার পরিধি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের দাফনের দিন একটি চ্যানেলের রিপোর্টার বা উপস্থাপকতো সরাসরি শাওন এবং শিলার মধ্যকার পারিবারিক বা মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব নিয়েই বর্ণনা দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করছিলেন।
এই দাবিটি করাই যায় যে, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু, তার মরদেহ দেশে নিয়ে আসা, শেষ শ্রদ্ধা এবং দাফনের যে কভারেজ মিডিয়াগুলো দিয়েছে, তা এর আগে কোন ব্যক্তিকে নিয়েই হয়নি। বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রত্যেকে তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য নিয়ে নেমে পড়েছিল এই কভারেজের লড়াইয়ে। সেই লড়াইটি ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়ে আবেগ আর অনৈতিকতার ভাইরাসে। সেই ভাইরাসে হয়তো সংবাদকর্মী হিসেবে আমিও আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এজন্য দর্শকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
বাংলাদেশ সময় ১৯৩৮ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১২
এমএমকে-menon@banglanews24.com