বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা এখন মিডিয়া ক্রেজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়ার পর সম্ভবতঃ তিনিই সর্বাধিক প্রচারপ্রাপ্ত ব্যক্তি।
মজিনা প্রায়শঃই এমনসব কথা বলেন যা আপাতঃ বিচারে সরকারবিরোধী হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। অনেকেই বলেন, মজিনা বিশেষ মিশন নিয়ে এদেশে এসেছেন। তাদের কথা বিশ্বাসও করি না, অবিশ্বাসও করি না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে ‘এক এগারো’ পর্যন্ত আমাদের ঢাকায় বিদেশি বন্ধুরা নানা সময় নানা রকম ইতিবাচক-নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। সেটা সকলেই জানে। তার পরেও একজন কূটনীতিক কী বলবেন আর বলবেন না, তা আমরা কেউ বলে দিতে পারি না। উচিতও নয়। কিন্তু মজিনার সাম্প্রতিক একটি বিষয় আমাকেসহ অনেককে ছুঁয়ে গেছে বলেই এই লেখার অবতারণা। অসাধারণ গল্পবলিয়ে তিনি। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্টোরি টেলার’। তার শব্দ চয়ন, বাচনভঙ্গি ও দর্শক-শ্রোতাকে বোঝানোর ক্ষমতা অসাধারণ। তিনি চোখে চোখ রেখে কথা বলেন। যা তাকে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।
একসময়ের নিরাপত্তা ও গণমাধ্যম বিষয়ের অধ্যাপক এখন রাষ্ট্রদূত। তার বহুকাজের অন্যতম এদেশের গণমাধ্যমে ঘনঘন যাতায়াত। সেই সূত্রেই তিনি এসেছিলেন বৈশাখী টেলিভিশনে যেখানে আমি কাজ করি বর্তমানে। দেখা হলো। শুভেচ্ছা বিনিময় হলো। জম্পেশ একটা আড্ডাও হয়ে গেলো। আড্ডাতেই তিনি গর্ব করে বারবার বলছিলেন, তার বাবা কৃষক। মার্কিন মল্লুকের আইওয়াতে তাদের খামার। প্রায় অশিক্ষিত বাবাই তাদের সব ভাইকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। আজ তারা কেউ ডাক্তার, কেউ ব্যাংকার। তিনি নিজে কূটনীতিক। বাবার কারণেই তিনি বাংলাদেশের খেতখামার আর কৃষকদের ভালোবাসেন। এ জন্যই ঘুরে বেড়ান এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এর মাঝে তিনি হারানো শৈশব খুঁজে পান। তার কাহিনী শুনে খুব ভালো লাগলো। জিজ্ঞেস করলাম, তা এতকিছু থাকতে আপনি কেন কূটনীতিক হতে গেলেন? অন্য পেশা কেন নয়?
কথার খেই যেনো ধরে ফেললেন মজিনা। বললেন, সে এক অসাধারণ গল্প। জানালেন, তখন তিনি প্রাইমারি স্কুলে। স্কুলটা বাংলাদেশের সাতক্ষীরা বা কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকার কোনো স্কুলের মতই। একটা মাত্র ক্লাসরুম। সেখানেই সব শ্রেণীর সব ক্লাস। সেই স্কুলে ভূগোল পড়াতেন মিজ অলব্রেক্ট। বিশাল চেহারার ঐ শিক্ষিকার বয়স মনে হতো দেড়শ বছর। মজিনার মনে হতো প্রাগৈতিহাসিক কোনো চরিত্র তাদের ভুগোল পড়াচ্ছেন। মিজ অলব্রেক্ট কোনোদিন নিজের এলাকার বাইরে যাননি। কিন্তু তিনি ছবি এঁকে আর গল্প বলে এমনভাবে বোঝাতেন মনে হতো যেন গোটা দুনিয়াটা তার ঘুরে দেখা। তিনি একদিন পড়াচ্ছিলেন সিল্করুটের কথা। প্রাচীন এই বাণিজ্যপথ ধরে কিভাবে আরবরা গোটা এশিয়া আর ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তো, কিভাবে কোথায় কোথায় লুটপাট ডাকাতি হতো, যুদ্ধ হলে সৈন্যরা কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়াতো, তিনি এমনভাবে বোঝাতেন যেন শিশু মজিনার মনে হতো তিনি সবকিছু জীবন্ত দেখছেন। ভুগোল টিচার তাকে এমনভাবে সম্মোহিত করেন যে, শিশু মজিনা তখনই স্বপ্ন দেখা শুরু করে, সে সিল্করুট দেখতে যাবে। এশিয়া, ইউরোপ যাবে। গোটা দুনিয়া ঘুরবে।
রোমাঞ্চিত মজিনা আপন মনে বলে চলেন, আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়, যখন পাকিস্তানে যাই। খাইবার পাস এলাকায় গিয়ে একদিন দাঁড়াই। সেদিন একজন প্রায় দেড়-দুই হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ার দিকে নির্দেশ করে বললেন, ঐ যে দেখছেন মাথার উপর ঐ জায়গাটা, ওটাই সেই প্রাচীন সিল্ক রুট। চমকে উঠলেন মজিনা। যেতেই হবে তাকে। সঙ্গীরা বার বার নিষেধ করছে। ওখানে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ। তবু বাধা মনেননি তিনি। পাথর সরিয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে, পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে তিনি পৌছে যান স্বপ্নের সিল্ক রুটে। স্টোরিটেলার মজিনা তখন উত্তেজিত। দুচোখে তার অশ্র“। আবেগ আপ্লুত মজিনার সাথে বৈশাখী টেলিভিশনের কনফারেন্স রুমে আমরা যারা উপস্থিত সবাই বিহ্বল। এতো শুধু মাত্র দু’হাজার ফুট চওড়া সিল্করুট জয়ের কাহিনী নয়, এ যে স্বপ্ন বোনা ও স্বপ্ন ফলানোর অনন্য গল্প।
গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের একজন সাধারণ শিক্ষিকা কি অসাধারণ দক্ষতায় ও মমতায় এক শিশুর মনে জীবনের স্বপ্ন বপন করে দিয়েছিলেন সেদিন। তারই ফসল একজন মজিনা।
(মজিনা সকলের জন্যে বড় কোনো উদাহরণ নাও হতে পারেন। এ বিষয়ে আমি সচেতন। )
আমার মনে হলো, পরে আমার সহকর্মী সাইফুল ইসলামও একই কথা বললেন, এটাইতো শিক্ষকের কাজ। শিশুর হৃদয়ে স্বপ্ন বোনা। সেটা কি করছেন আমাদের শিক্ষকেরা? স্বপ্নবান বা স্বপ্নবতী মানুষদেরকে আমরা শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিচ্ছি কিনা অথবা কোমল হৃদয়ে জীবনের স্বপ্ন এঁকে দেয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের আছে কিনা, সে প্রশ্নও করতে পারেন পাঠক।
লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, বৈশাখী টেলিভিশন- rahulraha1971@gmail.com
বাংলাদেশ সময় ১৫২৬ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০১২
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ- menon@banglanews24.com
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com