আমি রাজনীতি বুঝি না, তাই বলে এর গতি প্রকৃতি বুঝব না তা কিন্তু নয়। সেই সূত্রেই বলছি, লক্ষণ শুভ দেখছি না।
তেল, বিদ্যুৎ আর খাদ্য সামগ্রীর দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষ দিশেহারা, শেয়ার বাজার ধসে, বসে পড়েছে বৃহৎ এক জনগোষ্ঠী, চাঁদাবাজিতে সাধারণ মানুষ আজ অতিষ্ঠ, ওএসডি ইস্যুতে প্রশাসনে অস্থিরতা, অস্বস্তিকর পদ্মাসেতু–বিশ্বব্যাংক ইস্যু, একই ইস্যুতে গোখরাজ মালয়শিয়ার সাথে লুকোচুরি খেলা আর ড. ইউনূসকে নাস্তানাবুদ করার মরিয়া চেষ্টা---এসব চলে আসছে সামনে। সবখানেই যেন লেজে-গোবরে অবস্থা। চার বছরের `সুশাসনের` আলোকচ্ছ্বটা বিশাল উপদেষ্টা আর মন্ত্রীবাহিনী দিয়েও বিচ্ছুরিত করা যাচ্ছে না।
দেশে ফিরতে চাই, শুভাকাঙ্ক্ষীরা বারণ করেন! বেড়াতে গেলে ২/৪ দিন যেতে না যেতেই হাঁপিয়ে উঠি। খবরের কাগজ খুললে, হত্যা-গুম, আর রাজনৈ্তিক বাগাড়ম্বরে হতবাক হতে হয়। কোথায় চলেছি আমরা? শুধু রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাবে সরকারি বা বেসরকারি কোনো দলই একে অপরকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারছে না। অথচ বিজয়ের ‘মনকলা’ খেতে খেতে উভয় দলই যেন ক্লান্ত। এদের কাছ থেকে বেশি কিছু কি আশা করা যায়?
আমার লেখা অনেকের অপছন্দ হতে পারে। আমারও অনেক পছন্দ-অপছন্দ আছে। শিক্ষিত হয়েও দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের কবিতা আমার কাছে অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বোধ্য মনে হয়। সেই কারণে আমার প্রিয় কবির তালিকায় তিনি নেই। এ নিয়ে গালমন্দ শুনেছি কম না, তাতে কি, আমি যা ছিলাম তাই রয়ে গেছি।
তেল, বিদ্যুৎ, খাদ্য সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি, শেয়ারবাজার কেলেংকারি আর চাঁদাবাজি সংক্রান্ত লেখালেখি পড়ে পড়ে আমি ক্লান্ত। আজ তাই অন্য দু`একটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে চাই।
ওএসডি ইস্যু
সম্প্রতি খবরের কাগজের মাধ্যমে জেনেছি শতাধিক সাবেক সিনিয়র আমলাকে সরকারি নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির একান্ত সচিব (পিএস) ও সহকারী একান্ত সচিবদের (এপিএস) সংখ্যাই বেশি। সাবেক সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কর্মকর্তারাও ওই তালিকা থেকে বাদ যাননি। কেউ কেউ আবার বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই ওএসডি।
খবরের কাগজ জানায়, প্রশাসন ক্যাডারে বর্তমানে ১জন সচিব, ৩৪জন অতিরিক্ত সচিব, ১৪৪জন যুগ্মসচিব এবং প্রায় ৩৫০জন উপসচিব ওএসডি হিসেবে দিনের পর দিন বেতন-ভাতাদি তুলছেন। সব মিলিয়ে শুধু প্রশাসন ক্যাডারেই প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা রয়েছেন, যাদের কোনো কাজ নেই।
ওদিকে একটি গোয়েন্দা সংস্থা দিনের পর দিন ওএসডি থাকা শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গতিবিধির ওপর কঠোর নজরদারি শুরু করেছে। এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছে, সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের সুবিধাভোগী আমলারা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ব্যবহারের অজুহাতে নিয়মিত সচিবালয়ে ঢোকেন। তারা সচিবালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের হলরুমে বসে সুবিধাবঞ্চিত ও ওএসডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেন এবং সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। তাই এখন কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের হলরুমে নিয়মিত কারা আসেন, এসে কি করেন তা তীক্ষ্ণ নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরকারের বিপক্ষে নেমেছেন ৬০০ জন ওএসডি কর্মকর্তা।
ওদিকে সরকারের এমন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সচিবালয়ের নিরাপত্তা বিঘ্নিত ও জনপ্রশাসনে নাশকতা সৃষ্টি করতে পারেন মর্মে আশংকায় গত ১৯ জুলাই সাবেক এক মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ ৩১ জন সাবেক অতিরিক্ত ও যুগ্ম-সচিবের সচিবালয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
অভিযোগ গুরুতর। তবে ভিন্নমত দমনে যাদের ওএসডি করা হয়েছিল তারা দমিত না হয়ে কি করে সংক্রামক হয়ে পড়ল তা ভাববার বিষয়ই বটে! এখান থেকে কি কিছুই শিক্ষণীয় নয়? একে তো কাজ না দিয়ে এতজন কর্মকর্তাকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেওয়া হচ্ছে তার ওপর ওএসডি কর্মকর্তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণেও বিশাল ব্যয় হচ্ছে! এতোটা সৌখিন হওয়া কি আমাদের মানায়?
ঢাকা শহরের অদূরে ওএসডি মন্ত্রণালয় খুলে সেখানে কি এই ওএসডি কর্মকর্তাদের কাজে লাগানো যায় না? প্রস্তাবটা সরকার ভেবে দেখতে পারে!
এদের জন্য না হলেও আগামীতে যারা ওএসডি হবেন তাদের কথা ভেবেও তা করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক কারণে যাদের ওএসডি করা হয়েছে তারা কিন্তু অযোগ্য নন।
অবশ্য ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমি নিজেই একজন সাবেক ওএসডি! দেশসেবা করতে দেশে গিয়েছিলাম, কিন্তু সহকর্মী ও পিএসসি’র কুচক্রে ‘ভিক্ষা চাই না, কুকুর তাড়াও দশা’ নিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল আমাকে। আমার যে যোগ্যতাকে সে সময় প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই একই যোগ্যতা আমাকে বিদেশের মাটিতে সন্মানিত করেছে। মাঝখানে দেশ হারিয়েছে তার একজন ফরেনসিক প্যাথলজিস্টকে। মজার ব্যাপার হল, দেরিতে হলেও দেশ তার ভুল বুঝতে পেরে আমার বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু ন্যাড়া কি বারবার বেলতলায় যায়?
পদ্মাসেতু–বিশ্বব্যাংক-মালয়েশিয়া ইস্যু
দুই অসম কুস্তিগীরের মল্লযুদ্ধে নীচে পড়ে যিনি হেরে গেলেন তিনি যখন বলেন, “তলচাপ কেমন দিলাম”? তখন আমার পদ্মাসেতু নিয়ে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের অসম মল্লযুদ্ধের কথা মনে পড়ে যায়। বিদেশের মাটিতে আমার সহকর্মী যখন আমাদের সরকারকে দুর্নীতিপরায়ণ সরকার হিসেবে অঙ্গুলি দেখায় তখন আমাদের অনুভূতি কেমন হয় সেটা কাকে বোঝাব, কিভাবে বোঝাব? অথচ টিভিতে সরকারি নেতা-পাতিনেতাদের বক্তব্য শুনে মনে হয় অবস্থাটা এমন যে, “বিশ্বব্যাংক ঝাঁটার বাড়ি দিতে পারে কিন্তু লজ্জা কি দিতে পেরেছে?”
হম্বিতম্বি করার কোন দরকার ছিল না। মন্ত্রী আবুল হোসেনকে প্রাথমিক অবস্থায় না বিদায় না দেওয়াতেই তো প্রশ্ন উঠেছে তার অপরিহার্যতা নিয়ে। দল না বাঁচলে কি আবুল হোসেন বাঁচবেন? ইউএন অর্গানাইজেশনে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। সেই থেকে বলতে পারি, আবুল হোসেনকে রক্ষার চেষ্টায় অথবা তার পদত্যাগ নিয়ে লুকোচুরি খেলায় কোনো কাজ হবে না। আর বিশেষজ্ঞরা তো বলেই দিয়েছেন, বিশ্বব্যাংকের ঋণ ছাড়া পদ্মাসেতু তৈরি করা হলে তা দেশের জন্য কোনোভাবেই লাভজনক হবে না। লাভজনক যদি না-ই হবে তাহলে মালয়েশিয়াকে কেন লোক দেখানভাবে জড়ানো হচ্ছে?
ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের প্রবাসী জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ এখন মালয়েশিয়াতে অবস্থান করছে। যারা তাদের পাঠানো রেমিটেন্স দিয়ে আমাদের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নির্বাচনে জাপান, আর ওআইসি নির্বাচনে মালয়েশিয়া বাংলাদেশের ভোট না পেয়ে যেভাবে আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, পদ্মাসেতু নিয়ে আর কোনো টালবাহানা করা হলে তা বাংলাদেশ এর পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। বিশ্বব্যাংকের সাথে দরকষাকষিতে মালয়েশিয়াকে ব্যবহার করা হলে আমার ভয়, হীতে বিপরীত না হয়ে যায়!
ড. ইউনূস প্রসঙ্গ
ড. ইউনূস ইস্যুতে সরকার কেন অস্বাভাবিক এবং অস্বস্তিকর আচরণ করছে তা খুঁজে বের করা গেলে বাংলাদেশের ভাগ্যে বোধ করি দ্বিতীয়বারের মত নোবেল প্রাইজের শিকে ছিঁড়ত! তিনি যদি কর্মক্ষম ও স্বাস্থ্যবান থাকেন, তাতে গ্রামীণব্যাংকের সবোর্চ্চ পদে থাকতে দোষ কোথায়? অবসরের পর সরকার কি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বন্ধ করেছেন? তাছাড়া ড. ইউনূস তো দেশের অলঙ্কার। গ্রামীণব্যাংক যদি তার সাথে নোবেল প্রাইজের ভাগীদার না হত তবে কি তিনি সেখানে যুক্ত থাকতেন? কিছুদিন আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন ভায়াগ্রা আবিষ্কারক ফ্রায়েড মুরাদ। তিনি ৮৪ বছর বয়সে এখনও কর্মক্ষম।
আমাদের মানতেই হবে যে, নোবেল পুরস্কারজয়ী ডঃ ইউনূস নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন সেখানে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, আমলা অথবা শিক্ষিত সমাজের শুধু চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
হে আমাদের রাজনীতিবিদগণ, আপনারা কি ভুলে গেছেন যে আপনাদের কৃতকর্মের হিসাব-নিকাশের দিন সমাগত। এখনও সময় আছে, সংসদভবন, বঙ্গভবন, সেনাভবন অথবা গণভবনে ইফতারির মিলনমেলায় ইস্যুভিত্তিক সমস্যার সমাধান করুন। ভোটের আগেই ভোটের ফলাফল যেন বাতাসে না ভাসে, সেই ব্যবস্থা নিন।
লেখকঃ বর্তমানে ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা, মালয়েশিয়াতে অধ্যাপক ও সিনিয়র ফরেনসিক কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত। ইমেইল- nasimul@salam.uitm.edu.my
বাংলাদেশ সময় ১৫২০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০১২
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ- menon@banglanews24.com; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com