বাংলাদেশকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত কারা? স্বাভাবিক ক্ষেত্রে এ প্রশ্নের উত্তর হয়, কারা আবার বাংলাদেশের জনগণ। কিন্তু কিছু কিছু অস্বাভাবিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নিয়ে এ দেশের জনগণের বাইরেও অনেকেই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন।
নানারকম সূত্র, আলোচনার টেবিলে জোর করে বসানোর চেষ্টা এবং তাতেও কাজ না হলে হুমকি-ধমকি দিয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ঠেকানো কিংবা চালু করার ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহকে এইসব ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়তই যেতে হয়। গরিবি ও মূর্খতা এখানে হয়তো সূচক হিসেবে কাজ করে এই সব ঘটনার পেছনে। যেহেতু আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন, যেহেতু সাহায্যের হাত পাতলে এবং সেই হাতে কিছু পেতে হলে শক্তিশালী শক্তিবর্গের মন জুগিয়ে চলতে হবে, তাদের জুড়ে দেওয়া শর্তও মানতে হবে, তারা যা চাইবে তাদের তা দিয়েও দিতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত যদি কেউ এর ব্যতিক্রম করেন তাহলে তাকে ছুঁড়ে ফেলে নতুন প্রিয়জন খোঁজার চেষ্টায় এই শক্তিশালী পক্ষের খুব বেশি দেরি লাগে না।
যেহেতু আমরা মূলত মূর্খ কিংবা মূর্খ সেজে থাকতে ভালোবাসি সেহেতু আমাদের অনেকেই জেনে-শুনে-বুঝেও চুপ থাকি, চোখ বন্ধ করে রাখি কিংবা মিলিত হই তাদের সঙ্গে, যারা আমাদের সামনে সাহায্যের মুলো ঝুলিয়ে রাখেন, নসিহত করেন এবং রাজনৈতিক খেলায় নিজেদের পছন্দের মানুষকে ক্ষমতায় টেনে আনতে যেমন সময় নেন না, একটু উনিশ-বিশ হলে আবার ক্ষমতা কেড়ে নিতেও দেরি করেন না। এখানে ভাগ্যে বিশ্বাস করতে না চাইলেও বিশ্বাস করতে হয়, নাহলে এই সব সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করলে শেষ পর্যন্ত লোকের সামনে পাগল প্রতিপন্ন হতে হয়।
যা হোক, ভূমিকাটি বেশ দীর্ঘ হলো। বাংলাদেশে আসলে এই মুহূর্তে এরকমই খেলা এবং প্রতি-খেলা শুরু হয়েছে। এরকমটি অবশ্য প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষেই ঘটছে। কারণ ক্ষমতাসীন সরকার একভাবে চায় আর ক্ষমতার বাইরে থাকারা চান আরেক ভাবে। ফলে যে সংঘাতের সৃষ্টি হয় তার ভেতরই ঢুকে পড়ে এই সব দেশি-বিদেশি খেলোয়াড়পক্ষ। আসলে আমরা এদের দারুণ এক সুযোগ সৃষ্টি করে দিই। কেন যেনো মনে হয়, আমরা এতে বিমল আনন্দও লাভ করি। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার লড়াইয়ে কে জেতেন আর কে হারেন তা দেখার জন্য দেশের জনগণ উন্মুখ হয়ে থাকে এবং এই ধৈর্যের উপহার হিসেবে আমরা পাই আরেকটি নির্বাচিত সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটি নির্বাচন হয়ই, এটাও সত্য।
আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে। আমরা যদি গণতন্ত্রের কথা বলি তাহলে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের বাইরে কোনো সরকারই ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। আওয়ামী লীগের পক্ষেও সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে তাদের একটি পথে বেরুতেই হবে, সাংবিধানিক ও স্বাভাবিকভাবে এই পথ হচ্ছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এতোদিন ধরে যে নির্বাচনটি একটি শিখণ্ডি দাঁড় করিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যাকে আমরা বলেছি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বিবদমান দু’টি পক্ষ, একপক্ষ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে, যা সাংবিধানিকভাবে আর বলবৎ নেই। অপরপক্ষ এর বিপক্ষে।
মজার ব্যাপার হলো, এই বিবদমান দু’পক্ষেরই তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে বিরূপ অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিগত তিন/চারটি আমলেই আমরা দেখেছি মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে দেশে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নানা পক্ষের হস্তক্ষেপে একটি নড়বড়ে নির্বাচনের ভেতর দিয়ে সরকার গঠিত হয়েছে। তাতে বিজয়ী ও পরাজিত পক্ষ দু’রকম আচরণ করেছে। সংসদীয় গণতন্ত্রকে কোনোভাবেই আমরা কার্যকর করতে পারিনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে, এর প্রধান কারণ হচ্ছে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো যখন নিজেদেরই বিশ্বাস করতে পারে না, অর্থাৎ পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি অরাজনৈতিক ও অনির্বাচিত পক্ষকে খোঁজে আরেকটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, তখন বিষয়টি হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত কোনো পক্ষই কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। এর অবসান হওয়াটা আসলে খুবই জরুরি ছিল। শেখ হাসিনা সরকার যে অবস্থান বা বিশ্বাস থেকেই এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে থাকুক না কেন, এই পদ্ধতি বাতিলের প্রয়োজনীয়তা আসলেই ছিল এবং এই পদ্ধতিটিকেও আমরা আসলে পঁচিয়ে ফেলেছিলাম। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সরকার পর্যন্ত ঠিকই ছিল হয়তো কিন্তু বিচারপতি লতিফুরের হাতে ভয়ংকরভাবে আহত হয়ে ১/১১-এর আগে ও পরে এসে এই পদ্ধতি সত্যিকার অর্থেই মারা যায়। এই মরে যাওয়া পথে পুনরায় কেউ কেন যেতে আগ্রহী হয়ে উঠছে সে বিষয়ে বিতর্ক হতে পারে এবং হচ্ছেও। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নির্বাচিত সরকারও বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারবে এরকম বিশ্বাসও কি জনগণের মনে সৃষ্টি হয়েছে? উত্তর, মনে হয় না, তবে জনগণ নতুন পথে আগ্রহী, এও সত্য।
আগেই বলেছি, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবেই এবং সেজন্য নির্বাচনও হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে নির্বাচন কেমন হবে? কীভাবে হবে? এখনও এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তরের দিশা আমাদের সামনে নেই। বিবিসি বাংলা সার্ভিসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সূত্র দিয়েছেন, সর্বদলীয় সরকারের। পথ হিসেবে একে খুব একটা খারাপ বলার অবকাশ নেই। কিন্তু কথা হলো, খেলুড়ে পক্ষগুলো এই পথকে কে কীভাবে দেখছেন, তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে আগামী দিনগুলি। আমরা আবার কোনো সংঘাতের পথে যাচ্ছি নাকি শেখ হাসিনা প্রদর্শিত এ পথে হেঁটে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তায় পৌঁছুবো- সে ব্যাপারে আমরা এখনও নিশ্চিত নই। কিন্তু শুরুতেই যা বলেছি, তাহলো বাংলাদেশকে নিয়ে বাইরের শক্তিশালী শক্তিবর্গ কী ভাবছে, কীভাবে এগুচ্ছে, কী খেলার ছক কষছে তা বোঝাটা অত্যন্ত জরুরি আগামী দিনগুলি বিশ্লেষণে।
এর মাঝে সরকার আমাদের হাতে বেশ কিছু উপাত্ত দিয়েছে ভাববার। একটি অত্যন্ত কমন ইস্যু হচ্ছে ড. ইউনূস সম্পর্কিত। পশ্চিমের কাছে অত্যন্ত প্রিয়জন এই ব্যক্তি বাংলাদেশকে নিয়ে তার কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তিনি বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নিজেকে খুব একটা জড়াতে চান না। আমরা কেবলমাত্র তখনই দেখেছি তাকে রাজনীতিতে আগ্রহী হতে যখন ১/১১-র ধাক্কায় বাংলাদেশের দুই যুযুধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত, দুই নেত্রী যখন জেলখানায় বন্দী, মাঠ যখন সম্পূর্ণ ফাঁকা তখন তিনি স্বঘোষিত গরিবের ব্যাংকার থেকে রাতারাতি হতে চাইলেন জননেতা। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে যতোটা সহজ ভাবা গিয়েছিল ততোটা সহজ তারা নয়, তারা বরং বঙ্গবন্ধুর কন্যা আর জেনারেল জিয়ার স্ত্রীকেই তাদের নেতা হিসেবে মেনে নেবে, তাদের সকল দোষ-ত্রুটিকে মেনে নিয়েই, কিন্তু রাজনীতিতে `নাবালক` ড. ইউনূসকে তারা মেনে নেয়নি। পশ্চিমের কাছ থেকে নোবেল পুরস্কার নিয়ে এসেও তিনি এ দেশে রাজনৈতিক হিরো হতে পারেননি।
আমি এখানে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, বর্তমান সরকার যদি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে না হয়ে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে হতো তিনিও ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে একই আচরণ করতেন; রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার জন্য আজ বেগম জিয়া ও তার দল ড. ইউনূসের জন্য মরাকান্না কাঁদছেন কিন্তু ক্ষমতায় থাকলে আমরা উল্টো চিত্র দেখতাম নিঃসন্দেহে। কিন্তু বর্তমান সরকার ও ড. ইউনূসের মধ্যেকার বিতর্ক আমার ধারণা আগামী নির্বাচন কোন পন্থায় হবে তা নির্ধারণে বড় সূচক হিসেবে কাজ করবে।
দেখার বিষয় হলো, এই খেলায় কার শক্তি কতোটুকু এবং কে কতোটা কৌশলী। মাঠের রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে খুব একটা কৌশলী কখনওই মনে হয়নি, দলটি জনগণ-নির্ভরতায় অনেক সময় এমন কিছু কাজ করে যা পরে দলটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। দলটির শুভ-চিন্তক যারা তারা আশা করবেন, এবার যেন তেমনটি না হয়। কিন্তু যারা এর বিপরীত স্রোতে চিন্তা করছেন, তারা হয়তো এখন ভাবছেন, আওয়ামী লীগ সাপের লেজে পা দিয়েছে। হবেও বা। দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়, পিকচার আভি বাকি হ্যায়!!!
লেখক: সম্পাদক, একপক্ষ।
masuda.bhatti@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৮, ২০১২
এডিএ/সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
jewel_mazhar@yahoo.com