বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের সুবাদে আজ (১২ আগস্ট ২০১২) দুপুরের দিকেই নিশ্চিত হলাম যে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য এবার কোনো পরীক্ষা হবে না। মেধা তালিকার ভিত্তিতে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারবেন।
অনেকে পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরছেন। আমার এক অত্যন্ত মেধাবী এবং স্নেহভাজন সহকর্মী শিক্ষক, সুকর্ণ বড়ুয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। তাঁর মতে, সরকারের নতুন নিয়মে তিনি মেডিকেলে কখনই চান্স পেতেন না, কেননা, তিনি এসএসসি পরীক্ষায় অপ্রত্যাশিতভাবে খারাপ করে ফেলেছিলেন। কিন্তু সে সময় তিনি একটুও দমে যাননি, কারণ তিনি জানতেন যে, যখন ভর্তি পরীক্ষা আসবে, তখন তিনি তার মেধার প্রকাশ দেখাতে পারবেন। কিন্তু এখন এসএসসি বা এইচএসসি কোনো একটা পরীক্ষায় অপ্রত্যাশিত খারাপ রেজাল্ট করলে মেডিকেল এ পড়ার স্বপ্ন আর পূর্ণ হবে না। এই যুক্তির পাল্টা যুক্তিও অবশ্য আছে। অপ্রত্যাশিতভাবে খারাপ করে ফেলা তো ভর্তি পরীক্ষাতেও হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি হলো, এস এস সি এবং এইচ এস সি তে মোট পরীক্ষার সংখ্যা ২০-এর উপরে। আর ভর্তি পরীক্ষা একটা। সুতরাং অপ্রত্যাশিতভাবে এসএসসি বা এইচএসসি-তে খারাপ করার সম্ভাবনা ভর্তি পরীক্ষায় খারাপ করার ২৩ গুণ।
আগেই বলেছি আমার এই সহকর্মী খুবই মেধাবী এবং বুদ্ধিমান। তাঁর বিশ্লেষণের সাথেও অনেকেই একমত হবেন। কিন্তু আমি সেদিকে না গিয়ে অন্য কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে পাঠকের মনযোগ আকর্ষণ করতে চাই।
প্রথমত একটা সমস্যা হলো, দুইজন একই গ্রেড পাওয়া আবেদনকারীর মধ্যে কীভাবে পার্থক্য করা হবে? আমরা জানি যে পার্থক্য করার একটা উপায় হলো তাদের দুইজনের প্রাপ্ত নম্বর। যতুটুকু অনুমান করতে পারি, বোর্ড থেকে সরকারি সিদ্ধান্তে সেই নম্বর হয়তো আনানো হবে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে এই পার্থকটুকু গড়ে দেবার জন্য। অনেকে বলবেন এটাই স্বাভাবিক এবং তাই হয়তো করা উচিৎ।
কিন্তু আমার সামান্য বিচারবুদ্ধিতে যা আসে তা হলো, এই ব্যাপারটি করা হলে তা হবে একটা প্রতারণামূলক কাজ। খুবই কঠিন শব্দ ব্যবহার করে ফেললাম, কিন্তু না করেও উপায় নেই।
দেখুন, আমরা গ্রেডিং পদ্ধতিতে গিয়ে প্রথমে বলে দিলাম যে এই ১০০ জন ছাত্র (যারা কিনা একই গ্রেড পেয়েছে) আসলে গুণগতভাবে এক মানের। আসলে এই বলাটা আমরা খুব ফলাও করেই বললাম। প্রচুর মিষ্টি খাওয়াখাওয়ি হলো, আনন্দ উল্লাস হল। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, স্কুল, কলেজ, মন্ত্রণালয়, শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সমগ্র দেশবাসী খুব খুশি হলেন এবং নির্দ্বিধায় এই ফলাফলটা মেনে নিলেন এবং সানন্দে মাথা নেড়ে একমত হলেন যে এই ১০০ জন ছাত্রের গুণগত মান একই। এই ১০০ জন ছাত্রও কিন্তু খুবই খুশি হলো। এখন মেডিকেলে ভর্তির সময় আমরা বলা শুরু করলাম, দাঁড়াও ভাই, তোমরা গুণগতভাবে এক মানের হলেও তোমাদের মধ্যে ১০ জনকে নেওয়া যাবে এবং তা তোমাদের প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে।
তাহলে কী দাঁড়াল? কিছুদিন আগেই একটি পরীক্ষার ভিত্তিতে তাদের গুণগত মান একই বলে আমরা যে ঘোষণা দিয়েছিলাম, আজ ওই একই পরীক্ষার ভিত্তিতে আমরা বলছি যে তা আসলে পুরোপুরি সত্যি নয়। এটা কি তাহলে এক ধরনের প্রতারণা নয়?
প্রায়োগিক দিক থেকে আরও কিছু সমস্যা রয়েছে! বোর্ড ভেদে ফলাফলের বেশ তারতম্য থাকতে পারে। দুটো বোর্ডের মধ্যে জিপিএর এই তারতম্য কীভাবে সমন্বয় করা হবে এটাও একটা বড় প্রশ্ন। প্রায়োগিক দিক থেকে আরো বড় একটা সম্ভাব্য সমস্যা রয়েছে। এটা হলো দুর্নীতির সমস্যা। যেহেতু কোনো বিষয়ে কে কত নম্বর পেয়েছে তা আসলে জনসম্মুখে প্রকাশ করা হচ্ছে না বা হবে না, ভর্তিসংক্রান্ত দুর্নীতি যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা বলা মুশকিল। একেবারে বোর্ড থেকে শুরু করে ভর্তি কমিটি পর্যন্ত যে কোনো পর্যায়েই দুর্নীতির সম্ভাবনা থেকে যাবে।
কথাটা অপ্রিয় হতে পারে, কিন্তু মোটেই অগ্রাহ্য করার মতো নয়। এর থেকে রেহাই পাওয়ার একটা সহজ উপায় হল কে কত নম্বর পেয়েছে তা আসলে জনসম্মুখে প্রকাশ করে দেওয়া। কিন্তু তাহলে তো কার্যকরভাবে আবার আমরা সেই পুরনো প্রশ্নেই ফিরে গেলাম- ১০০ জনকে একই মানের বলে আবার তাদের নম্বর প্রকাশ করে তাদের আলাদা করা তাদের সাথে প্রতারণা করা ছাড়া আর কি?
আসলে, ভর্তি পরীক্ষার বিকল্প অবস্থা বর্তমানে আছে বলে আমার মনে হয় না। ভর্তি পরীক্ষার বিকল্প খোঁজার জন্য সরকারের যে উৎসাহ এবং প্রয়াস সেটাও কিন্তু একটা যুক্তিসংগত কারণেই। সেই কারণটা হলো ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা মেডিকেল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচিং সেন্টারগুলার হাত থেকে আমাদের ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী তথা তাদের অভিভাবকদের রক্ষা করা। আমি এই প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু, শুরুতে যে বলেছিলাম- সবদিক বিবেচনাতে এনেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কিনা- সেইটাই আবার বলতে হচ্ছে। আরো চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। রয়েছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়নের। আমাদের বিশেষত সরকারি কাজকর্মের একটা খারাপ দিক হলো আমরা মূলত Reactive, pro-active নই। যখন যেই সমস্যা সামনে আসে তৎক্ষণাত সেইটা নিয়ে দ্রুত চিন্তাভাবনা করে একটা সিদ্ধান্ত আমরা নিতে চাই। ২০১১ সালের মেডিকেল বা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির পরপরই কিন্তু ২০১২ সালে কী হতে পারে বা হওয়া উচিৎ তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করা যেত। তাহলে সবদিক বিবেচনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তথা সরকারও যথেষ্ট সময় পেতো বলেই আমার বিশ্বাস। সাধারণ একজন নাগরিক হিসাবে আমার বিশ্বাস, আমাদের বেশির ভাগ সিদ্ধান্তের মতোই এটিও খুব দ্রুততার সাথে নেওয়া এবং আমার বিনম্র বিবেচনায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে মোটেই সঠিক নয়।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বুয়েট, ১২ আগস্ট, ২০১২।
sohel.kcl@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১২
সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর