ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মেডিকেল ভর্তিপদ্ধতি এবং দু’জন ফেসবুক বন্ধুর পোস্ট

সঞ্জীব রায়, প্রতিবেদক, সময় টেলিভিশন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১২
মেডিকেল ভর্তিপদ্ধতি এবং দু’জন ফেসবুক বন্ধুর পোস্ট

আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড ‘ত’ আদ্যক্ষরের একজন গণমাধ্যমকর্মী। যিনি একটি বড় ধরণের পোস্ট লিখেছেন নিজের ওয়ালে।

বিষয় মেডিকেল ভর্তি, শিরোনাম – “মেডিকেলে ভর্তি: মাথা ব্যাথা? কেটে ফেলুন”। সেটার ওপরই বিভিন্ন কমেন্টস জমছিলো নিচে একের পর এক।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত হবার সাথে সাথে আমাদের টেলিভিশন বিষয়টি নিয়ে তৎপর হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা কি বলছেন, সেটা তুলে ধরা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের খবর তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে সরকারের বক্তব্যও। এসব সংবাদ কভার করতে গিয়ে আমাদের সবারই নজরে এসেছে, কীভাবে কোচিং ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কায়দায় ছাত্রদের মাঠে নামিয়েছে। এবং ঘটনার একদিন পর আন্দোলনের নামে রাস্তা দখল করাদের মধ্যে এইচএসসি পাস ছাত্রদের চেয়ে স্নাতক পর্যায়ের বিভিন্ন ছাত্রদের অংশগ্রহণ বেড়ে যায়।

যাই হোক, আমার আলোচনার বিষয় এটা নয়। ‘ত’ অদ্যাক্ষরের আমার সেই ফেসবুক ফ্রেন্ডের পোস্টের নিচে কমেন্টস লিখলাম, “ভর্তি পরীক্ষা সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক নয়। যারা নিয়মিত ভালো শিক্ষার্থী, যারা এসএসসি-এইচএসচিতে ভালো করেছে, তারাই সুযোগ পাবার যোগ্য। হঠাৎ তিনমাস পড়ে এমসিকিউ দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেডিকেলে সুযোগ পাচ্ছে, মাঝখানে ব্যবসা করছে শিক্ষা ব্যবসায়ী আর কোচিং মাফিয়ারা। বরং সরকারকে বলা যায়, এ ধরনের সিদ্ধান্ত আরো আগে থেকে জানানো উচিৎ, অথবা বলতে পারতো, পরের বার থেকে কার্যকর হবে। ”

এরপর তিনি আবার আমার বক্তব্যকে উদ্দেশ্য করে কমেন্টস করলেন, “মেধা যাচাইয়ের প্রক্রিয়াটা যেহেতু পঞ্চম শ্রেণী থেকে শুরু হয়, সেহেতু ভর্তি পরীক্ষার সময় পঞ্চম শ্রেণী, অষ্টম শ্রেণী, এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে কারা পরীক্ষা দিতে পারবে তার একটি তালিকা করতে হবে। এতে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে ধারাবাহিকতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে, যা জরুরি। এরপর পরীক্ষা। এখানেই শেষ নয়, আরেকটা কাজ করা দরকার যেটা নটরডেম কলেজ করে। সেটা হলো, শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা, সেবা করার মানসিকতা ও সামগ্রিক ইতিবাচকতা যাচাই। ”

সাবেক নটরডেমিয়ান হিসেবে এর জবাবটা শুরু করেছিলাম এভাবে, “নটরডেম কলেজের মতো করে এসব ইতিবাচকতা স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো যাচাই করতে পারে। রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীকে সেখানকার বোর্ড সাক্ষাৎকারে যদি যথোপযুক্ত মনে না করে, তাহলে তাকে ভর্তি না করাতে পারে। সেটা হতে বাঁধা নেই। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার নামে শিক্ষা ব্যবসার মাফিয়া চক্রকে সুযোগ দেয়ার কোনো যুক্তি আছে কি? পরীক্ষাকে কেনো আমরা অনিবার্য ভাবছি? আমরা কি পাবলিক পরীক্ষাগুলোর মান নিয়ে কথা বলতে পারি না? পৃথিবীর কোনো দেশে আমাদের শিক্ষার্থীরা পড়তে গেলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তার এদেশের এসএসসি-এইচএসসির ফলাফলকে মানদণ্ড ধরা হবে। অথচ আমরাই সেই মানদণ্ডে আস্থা রাখতে পারছি না। কোনো কিছু না বুঝেই পরীক্ষা পদ্ধতিকে সমর্থন করছি। কেন্দ্রীয়ভাবে উপযুক্তদের যে তালিকা করে দেয়া হবে সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজগুলো সাক্ষাৎকারভিত্তিক ইতিবাচকতা যাচাই করে ভর্তি নিতে পারে। আমরা বরং এসএসসি-এইচএসসিসহ আগের পর্যায়গুলোতে মান বাড়ানোর প্রতি জোর দিতে পারি। তাগিদ দিতে পারি, ফলাফলভিত্তিক এই মেধাক্রম তৈরির প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করার প্রতিও।

আর একটি বিষয় এখানে বলা উচিৎ। কেনো ভাবছেন, মাথা ব্যাথা বলে মাথা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত এটা? নিশ্চয়ই আপনি জানেন, কোচিং এখন আইনত বন্ধ, হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞাও আছে। এখন যখন পরীক্ষা থাকবে তখন সাইনবোর্ডওয়ালা কোচিং ব্যবসা না থাকলেও পরিমল জয়ধর টাইপ হাজারো নামী শিক্ষকের/ভাইয়ের জন্ম নেবে ঘরে ঘরে। এদের কি ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে ঠেকানো যাবে? কেনো আপনারা এই শিক্ষা বাণিজ্যের সুযোগ রাখতে বলছেন, সত্যিই বোধগম্য নয়।

তবে, শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে যারা ভাবছেন, তারা কিন্তু চাইছেন আগামী দিনে উচ্চশিক্ষার স্তরে আর কোনো পরীক্ষার ব্যবস্থা না রাখতে। কারণ, এসএসসি-এইচএসসির মানদণ্ডই শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছে। এতোদিন দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের থেকে বাংলাদেশই শুধু ব্যতিক্রম ছিলো। আমরা কি একটা ভুল থেকে একটা শিক্ষা-ব্যবসার নতুন সুযোগ তৈরির কবল থেকে শিক্ষাকে বাঁচাবো না?”

এর কয়েকঘণ্টা পরই আমার সেই ফেসবুক ফ্রেন্ড আবার নোটিস করলেন, “শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল অবস্থার কারণে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ণের ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়। আমাদের আটটি সাধারণ, একটি কারিগরী ও একটি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড ভিন্নভিন্ন প্রশ্নপত্রে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ণ করে। এক বোর্ডের প্রশ্নের সঙ্গে অন্য বোর্ডের প্রশ্নের মিল নেই। মিল নেই উত্তরপত্র যাচাইয়ের মনোভাবেও। একেক বোর্ডের একেক শিক্ষক একেকভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ণ করেন। যে দেশে এতো ভিন্নতার মধ্যে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ণ করা হয়, সে দেশে সরকার কীভাবে ফলাফলের ভিত্তিতে মেডিকেল কলেজে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয়?...

এসএসসি ও এইচএসসিতে মোট জিপিএ ৮ থাকলে শিক্ষার্থীরা মেডিকেলে ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারবে। একই ফলাফলের অনেক শিক্ষার্থী আবেদন করতে পারবে। সরকার কিসের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মেডিকেলে পড়ার সুযোগ দেবে? নম্বরের ভিত্তিতে? যদি নম্বরই ভরসা হয়, তাহলে অতীতে প্লেস, স্টার মার্কসের সেই পদ্ধতি বাদ দিয়ে কেনো জিপিএ ব্যবস্থা আনা হয়েছিলো? জিপিএ ব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় বলা হয়েছিলো, পুরনো পদ্ধতি নাকি ‘কোমলমতি’ শিক্ষার্থীদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, বৈষম্য তৈরি করে। তাহলে এ সিদ্ধান্ত কি ধরণের প্রভাব ফেলবে?”

এরপর আমি আবারো লিখলাম, “বুঝতে পারছি, আপনি আমাদের টেলিভিশনের স্পেশাল রিপোর্টটি দেখেননি। যারা শিক্ষাবিটে কাজ করে এবং দেশের শিক্ষাবিদেরা, দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দিয়ে একটা কার্যকর ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়ে আসছেন। আপনাকে এ সম্পর্কিত রাশেদা কে চৌধুরীর লেখাটা পড়ার অনুরোধ করছি। আপনি কি মনে করেন এসএসসি-এইচএসসিতে আদৌ সবাইকে একইভাবে মূল্যায়ণ করা সম্ভব? সামান্য হেরফের তো থাকবেই। একজন শিক্ষককে যদি বাংলাদেশের সব ছাত্রের খাতা মূল্যায়ণের জন্য দেন, (আপনার মতানুযায়ী সেটাই করা উচিৎ) তাহলেও তো একই রকম মূল্যায়ণ হবে না। এটা প্রমাণিত।

একটা ব্যবস্থা তখনই দাঁড়ায়, যখন সেখানে অনেক ধরণের ত্যাগ স্বীকার করে, মেনে নিয়ে সবাই মিলে সেটা দাঁড় করানোর ব্যবস্থা করা হয়। আর আপনি কার কাছ থেকে শুনলেন, নম্বরের ভিত্তিতে বিভাজন করা হবে? এখানে, বিষয়গুলোতে প্রাপ্ত জিপি`র ভিত্তিতে একটা তালিকা তৈরি হবে। সেটা উন্মুক্তভাবে প্রকাশ করা হবে। সেখানে যদি কোনো কারসাজি থাকে, কোনো প্রশ্ন থাকে, সেটা বলা যেতে পারে।

গ্রামের শিক্ষার্থীটি যদি শহরের একটি শিক্ষার্থীর চেয়ে পিছিয়ে থাকে, তাকে তালিকার ওপরের দিকে স্থান দেয়া হবে। আমাদের এসএসসি-এইচএসসিকে আরো মানসম্মত এবং বৈষম্যহীন করে তোলার মধ্য দিয়ে এই ব্যবস্থাটা আরো কার্যকর হয়ে উঠবে। আর আপনার কথায় মনে হচ্ছে, আপনি জিপিএ ব্যবস্থার বিরোধী। বিরোধীতা আমরাও করেছিলাম। কিন্তু এটা যতোটা না অসুবিধার, তারচেয়ে বড় কথা এটা সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটা আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থা। আমাদের শিক্ষার্থীদের বাইরে পড়তে গেলে এর কোনো বিকল্প নেই। বৃহত্তর স্বার্থে  ব্যবস্থাকে মেনে নেয়ার ইতিবাচক মানসিকতা দরকার। সমস্যা আছে এটা সবাই জানে, এবং মেনে নিচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষা বহাল রাখার নামে যারা কোচিং মাফিয়া, শিক্ষা ব্যবসায়ীদের পক্ষে সাফাই গাইছে, তাদের লক্ষ্যটি পরিষ্কার নয়। ”

আশা করি এই কথোপকথন বা ‘ফেসবুকিং’ সর্বসাধারণের সামনে স্পষ্ট করবে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা আদৌ ইতিবাচক না নেতিবাচক।   প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির তৎপরতা, অসাধু কোচিং ব্যবসায়ী, যারা পরীক্ষা পদ্ধতি বহাল থাকলে লাভবান হবে তাদের অপতৎপরতায় রাজপথে নেমেছে শিক্ষার্থীরা। দাবি তোলা হচ্ছে, পরীক্ষা পদ্ধতিটিই বহাল রাখার। আমার এই ফেসবুক বন্ধুর বক্তব্যও তেমনটি। জানিনা, তিনি কোচিং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জড়িত কি না? আশা করবো তিনি তা নন।

আর এটাও আশা করবো, সরকারের হুট করে জানানো এই সিদ্ধান্ত আগামীবার থেকে চালু করবে। এবার না হয় শিক্ষা-ব্যবসায়ীরা একটু ছাড় পেলো। কিন্তু ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা অন্তত তাদের হাতের ক্রীড়নক হবে না। আলোচনা এ পর্যন্তই যথেষ্ট।
royratan.sanjib@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৪ ঘণ্টা, ১৬ আগস্ট, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্‌সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।