১৯৮২ থেকে ২০১২। দীর্ঘ এই ত্রিশ বছরে বাংলাদেশ আমূল বদলে না-গেলেও পরিবর্তনের একটা বড় ধাক্কা লেগেছে।
ত্রিশ বছরের বাসী মফস্বল সাংবাদিকতা এখন গিয়ে ’আশ্রয়’ নিয়েছে প্রবাসে। কেউ কেউ নিজেকে ঢাকার কাগজের সাংবাদিক পরিচয় দিতেন। আরো স্মার্টরা পোস্ট অফিসে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে প্রবাসী বন্ধুদের সহায়তায় বছর পনেরো আগে একটি সাপ্তাহিকের ডিকলারেশন নিতেন। নিজের গাঁটের টাকা খরচা করে কানাডা-আমেরিকায় বন্ধুদের দিয়ে মাস তিনেক বাংলা সাপ্তাহিক প্রকাশ করে সেই কাগজের সম্পাদক কিংবা নির্বাহী সম্পাদক পদে লোক দেখানো নিয়োগে সেখানে ’হিজরত’ করেছেন। আরো মাস তিনেক প্রকাশের পর যথারীতি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পত্রিকাটিকে ’ইন্তেকালে’ বাধ্য করা হয়। কাগজ বন্ধ হলেও সম্পাদক ও সাংবাদিক মহোদয়রা বাজারে পুরোনো ভিজিটিং কার্ড ব্যবহার করে চলেন। তবে সংবাদমাধ্যমটির আগে সিম্পলি যুক্ত হয় ‘অধুনালুপ্ত’। এই আরেক শব্দ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম জগতের ‘অধুনালুপ্ত’! শব্দটির মেয়াদ কত দিনের? সেটি একটি প্রশ্ন। কতদিন পার হলে তা আর অধুনলুপ্ত থাকে? অনেকে আবার নিজেরাই আমেরিকা-কানাডায় লাখ দশেকে ‘আদম’ নেওয়ার মানসে পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখেন।
প্রবাস এক অদ্ভুত জগৎ। মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের চিন্তা-চেতনায় থাকে গ্রামের জমি-জিরাতের মূল্য, বোনের বিয়ের গয়নার দাম, কে প্রবাসে বেশি সিনিয়র এবং হাসিনা-খালেদা-এরশাদ। এইসব নিয়ে দিব্যি ঝগড়া-বিবাদ আর ভালোবাসায় আছেন মধ্যপ্রাচ্যের ওয়েজ আর্নাররা। কারো টাকা ধার লাগলে সবাই মিলে চাঁদা তুলে ধার দেন। কানাডা-আমেরিকা-ইওরোপ-অস্ট্রেলিয়ায় বাঙ্গালীরা কেবল শ্রেণী বিভক্তই নয়, বরং বড় চাকুরে আর উচ্চ শিক্ষিতরা অন্যদের ভাবেন নিম্নবর্ণের। অধিকাংশই সাধারণ অভিবাসীদের এড়িয়ে চলেন। কিছুদিন প্রবাসে থাকার পর ঢাকার বলাকা সিনেমা হলের অবস্থান জানতে ব্যর্থদের মধ্যে কমিউনিটি নেতা হবার তীব্র খায়েস জাগে। বাংলাদেশে জীবনে দেয়াল পত্রিকায়ও নাম ছাপা হয়নি, এমন অনেকেই কবি-সাহিত্যিক হিসেবে আবির্ভূত হন।
এক নেতা এক দল মন্ত্রে বাঙ্গালী সমিতিগুলো ভাংগেন কিছু মানুষ। এক শহরে গোটা দশেক সমিতি-সংগঠন গড়ে ওঠে।
যারা সমিতি-সংগঠনে ‘যুৎ’ করতে পারেন না, তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, জিয়া পরিষদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও দল করেন। প্রতিটি দল ও সংগঠনের গোটা পাঁচেক ব্রাকেট। বাংলাদেশে থাকা অবস্হায় অধিকাংশ নেতাই কখনো কোনো ওয়ার্ড কমিটির প্রাথমিক সদস্যও ছিলেন না। বৈশাখী মেলা, ভাষা আন্দোলন কিংবা বিজয় উৎসবের নামের আয়ে নেতাদের বছরে একবার বাড়ি ফেরার খরচা উঠে আসে। বিবৃতি সর্বস্ব এইসব পকেট সংগঠনের নেতারা কমিউনিটিতে ‘হামকি-ধমকিতে’ থাকেন। মসজিদ কমিটি, আরবী শিক্ষা স্কুল ও বাংলা ভাষা স্কুলের ফান্ড তছরুপের ঘটনায় ছুরি মারামারির মতো ঘটনাও ঘটে।
কিন্তু নেতা হওয়া কী এতোই সহজ? নিশ্চয় না। এজন্যে চাই যথাযথ কভারেজ। প্রবাসের বাংলা প্রিন্ট ও ওয়েব পত্রকার আগমন ও প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। বাড়ির গ্যারেজের দেয়ালে ব্যানার টানিয়ে ‘শেখ হাসিনার পতনের’ দাবিতে তিনজন বন্ধু একাট্টা হলেই ‘বিশাল’ জন সমাগম হয়। এজন্যে খালি লাগে একটি ওয়েব পত্রিকার ‘সামান্য’ পৃষ্ঠপোষকতা। বিশাল নিউজ, ফেসবুকে শেয়ার হয়, দলের নেতাদের কাছে পাঠানো হয় ই-মেইলে। কেবল লাগে সাংবাদিক কিংবা সম্পাদক ভাইকে নগদ কুড়ি টাকা (প্রবাসে বাঙ্গালীরা সেই দেশের মুদ্রাকে টাকাই বলে)। ’৮২ সালে বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকেরা এরচেয়েও বেশি নিতেন! একটু তোয়াজ। দু’তিনটে বাড়ির দাওয়াত।
বাদবাকী সুবিধা আর কোনো ওয়েব কাগজ সম্পাদকের ‘নেতা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের’ বদলে কী কী বাড়তি সুবিধা নেন, সেটা আগামী কিস্তিতে লিখবো। শরীর খুবই অসুস্হ। ইচ্ছে ছিলো দুই কিস্তিতে শেষ করবো। আরো এক কিস্তি লাগবে। এজন্যে সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
পাদটীকা: শিরোনামটি অনুজপ্রতিম বন্ধু সিডনী প্রবাসী গল্পকার শাখাওয়াৎ নয়নের কাছ থেকে ধার করা।
বাংলাদেশ সময় ২২২২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১২
এমএমকে