এক।
১৯৭৯।
মুসলিম লীগ নেতা মতিনের বাড়ির সামনের অংশে দৈনিক দেশ অফিস। পেছনের অংশে জাগ-যুবদলের অস্থায়ী কার্যালয়। যাওয়ার পথটা দৈনিক দেশের নিউজ রুম ডিঙ্গিয়ে। সেখানের সার্বিক দায়-দায়িত্বে যুবদল নেতা কাশেম। পরে মন্ত্রীও হয়েছিলেন কুমিল্লার এই নেতা। কাশেমের বাড়ি থেকে কুখ্যাত ইমদুকে গ্রেফতারের উছিলায় ১৯৮২’তে ক্ষমতা হাসিল করেছিলেন এরশাদ।
তখনো পুরো টিম গোছানো হয়নি। ডামি সংখ্যা প্রকাশের প্রস্তুতি পর্ব চলছে মাত্র। কবি সমুদ্র গুপ্তের আন্তরিক তত্ত্বাবধানে নিউজ ডেস্কে কাজ শিখছি আমি, কথাসাহিত্যিক আবু সাঈদ জুবেরী, সংবাদের বার্তা সম্পাদক কাজী রফিক, এলাহী নেওয়াজ খান সাজু, বিনয়ী আর অসাধারণ মেধার ফারুক চৌধুরী প্রমুখ। রিপোর্টিংয়ে সৈয়দ জাফর আর ওবায়দুল হক কামাল হাতে কলমে রিপোর্টিং শেখাচ্ছেন হাসান আবুল কাশেম, কাজিম রেজা ও আলী মামুদসহ একঝাঁক অনন্য তারুণ্যকে। পিয়ন বলতে তখনো মাত্র দু’জন। একজনের নাম হালিম। আমরা ডাকতাম ‘নিরীহ’।
নিউজ রুম পেরিয়ে যাওয়ার সময় একদিন মুখোমূখি পেয়ে গেলাম চাচার বাল্যবন্ধু ও জাগ-যুবদলের অন্যতম নেতা ফেণীর আবদুল্লাহ চৌধুরীকে। শেষ খবরে জানি, উনি ফেণীর ছাগলনাইয়্যা উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করেছিলেন। সঙ্গত কারণেই ওনাকেও কাকা ডাকি। দু’হাতে দেদার খরচে আবদুল্লাহ কাকার জুড়ি মেলা ভার ছিলো।
আব্দুল্লাহ কাকার এক ‘তালেবে এলেম’ জাগ-যুবদলের নেতাদের সিগ্রেট এনে দিয়ে আর অন্যান্য ফুট-ফরমায়েশ খেটে পাওয়া ‘বকশিশে’ জীবন ধারণ করতেন। পরণে থাকতো ‘টাল কোম্পানির’ কাপড়-চোপড়। মানুষটির সঙ্গে বহু বছর পর একবার দেখা মিলেছিলো ২০০২-০৩-এ। বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসেবে শেরে বাংলা নগরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার উদ্বোধন করছিলেন তিনি। চোখে ‘কার্টিয়ার’ চশমা, হাতে রোলেক্স, পরনে মার্ক্স অ্যান্ড স্পেন্সারের স্যুট। সব মিলিয়ে গায়ে-গতরে হাজার দশেক মার্কিন ডলারের আউটফিট। ভদ্রলোকের নাম বরকত উল্যাহ বুলু।
দুই।
মুসলমান প্রধান বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা মুষ্ঠিমেয় কিছু মানুষের বিভিন্ন নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হন। আমার সীমান্ত-সংলগ্ন গ্রামে হিন্দু-মুসলমানের সৌহ্যার্দ্যপূর্ণ আত্মার আত্মীয়তা সত্ত্বেও রাতের অন্ধকারে সংখ্যালঘুদের অনেকেই নামমাত্র মূল্যে সম্পত্তি বেচে হাওয়া। প্রফুল্ল ঠাকুরের বাড়ির আধুনিক পরিচয় দেওয়ান বাড়ি। অনেক গ্রামের দেবোত্তর সম্পত্তিগুলোও রাক্ষুসে আগ্রাসন থেকে রেহাই পায়নি।
এমন অবস্থার বিপরীতে অভিযোগ শুনি, মুসলমানদের ওয়াক্ফ সম্পত্তি এক সংখ্যালঘু নেতা দখল আর বিক্রি করে খাচ্ছেন। সত্যি-মিথ্যে জানি না। তবে এই নেতার দৃশ্যতঃ কোনো রোজগার নেই। গলা বেচা আর রাজনৈতিক আধিপত্যই ওনার লক্ষ্মী। জীবনের প্রান্তসীমায় এসে কয়েকদিনের জন্যে মন্ত্রী হতে পারা নেতাটির থলে থেকে নাদুস-নুদুশ এক কালো বিড়াল হেলে দুলে হেঁটে বেরিয়ে ‘শুঁটকির হাঁটে’ দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে। মন্ত্রী হবার পর প্রবীণ এই সাংসদকে ঈর্ষা করা শুরু করেছি। একেক পাঞ্জাবীর যে বাহার! ঈদের যৎসামান্য কেনা কাটার ব্যর্থ চেষ্টায় জেনেছি, কোনো পাঞ্জাবীর মূল্য হাজার তিরিশেকের নীচে হবে না।
সংশ্লিষ্ট বিটের রিপোর্টার জানালেন, বাবু সুরঞ্জিতের অনেক পাঞ্জাবী আছে যার মূল্য পাঁচ অংকের ঘর অনায়াসে পেরুনো। একজোড়া জুতো সম্পর্কে গুঞ্জন: দাম নাকি মাত্র সত্তর হাজার!
এক ও অভিন্ন রকমের মূর্চ্ছনায় বেজেই যাচ্ছেন আমার আরেক প্রিয় দাদা দিলীপ বড়ুয়া, থুক্কু , মন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া। বছর দশেক আগে দেখা হলে এড়িয়ে চলাটা বুদ্ধিমানের কাজ ভাবতাম। কারণ কখন আবার ওনার বাসার বাজারের খরচাটা জোগান দিতে হয়! এখন দাদার পোশাকের বাহার আর চেহারার চিকনাই বুঝিয়ে দেয়, মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো আমাদের অবস্হান পাল্টেছে। এখন দাদা ভয়ে থাকেন কখন আমাকে/আমাদের মতো অতীতকে বাড়ির বাজার খরচা ‘কন্ট্রিবিউট’ করতে হয়। একেক বেলায় দাদার পরনে একেক কারুকাজের পাঞ্জাবী দেখে মোনাজাতে বসি, ‘আহা, যদি কমিউনিস্ট হতে পারার সৌভাগ্যপ্রাপ্ত হতাম!’
তিন।
আমার আরেক প্রিয় নেতা ওবায়দুল কাদের ভাই। ওনাকে প্রথম দেখি অকাল প্রয়াত মহিবুর রহমান বাবুল ভাইয়ের সংগে গফুর ভাইয়ের ভাংগা চায়ের দোকানে। গফুর ভাই তখন নির্মলেন্দু গুণ-আবিদ আজাদ-ফারুক মাহমুদদের দখলে। বাংলা সাবান দিয়ে হাতে কাঁচা সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবী পরা কাদের ভাই তখনো কোম্পানীগঞ্জের স্হানীয় ভাষার বাংলা উচ্চারণটাই জানতেন। এখনো সেই ফ্লেভারেই কথা বলেন। বাবুল ভাই আর জনপ্রিয় বাহালুল মজনুন চুন্নুর হাত ধরে প্রিয় কাদের ভাই’র রাজনৈতিক যাত্রা।
মাহমুদুর রহমান মান্নার কাছে জামানত বাজেয়াপ্ত হবার মতো বিপুল ভোটে পরাজয়ের পর ঢাবি ক্যাম্পাস রাজনীতিতে আর ‘জুইৎ’ করতে পারেননি তিনি। রাজনৈতিক বিবেচনায় একটি দলীয় পত্রিকায় লোক দেখানো চাকরি নিয়ে জীবন-যাপনের সংগ্রামে নামেন তিনি।
কদমবুচির সুবাদে প্রতিমন্ত্রী হবার পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি ছাত্রলীগের ব্যর্থ এই নেতাকে। দলীয় প্রধানের ‘অবিরাম-অব্যাহত’’ স্নেহে ও প্রশ্রয়ে প্রিয় কাদের ভাই দলের সাধারণ সম্পাদক হবার স্বপ্নেও কিছুদিন বিভোর ছিলেন। তখনো ধনে-সম্পদে তিনি এতোটা ‘সন্তোষজনক’ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেননি। সব সমীকরণ পাল্টেছে এবার সড়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হবার পর। পরণের ‘হুগো বস’ ও ইতালিয়ান স্যুটের বাহারে চোখ ঝলসে ওঠে। রেলের বাড়তি দায়িত্ব পোশাক-পরিচ্ছদের চাকচিক্যকে আরেকটু জেল্লা দিয়েছে মাত্র।
ছাত্র-যুব-শ্রমিক-স্বেচ্ছাসেবক লীগের হাজারখানেক নেতা-কর্মীসহ একদল ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে নিয়ে আকস্মিক সফরে খরচাপাতি কম হয় না। সামান্য চা-নাস্তার আপ্যায়নেও ব্যয় হয় বিশাল ও বিপুল অংকের। জানতে খুব ইচ্ছে হয়, মন্ত্রীদের বেতন কতো? কিংবা ‘উপরি’ বা অন্যসূত্রে আয় কতো? এতো দামি স্যুট আর নিত্য এতো হাত-খরচ নিশ্চয় বেতনের সামান্য অংকে হয়ে উঠে না।
দূদকের কাছে প্রশ্নগুলোর কোনো জবাব আছে? নাকি সরকারের সবাই নিষ্পাপ ও নির্দোষ!
abid.rahman@ymail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৫২২ ঘণ্টা, ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com