অবশেষে পদ্মাসেতু নির্মাণ নিয়ে একটি প্রস্তাব এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। বিশ্বব্যাংক যখন বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সে সময়ে মালয়েশিয়ার এ প্রস্তাব কিছুটা হলেও বিশ্বব্যাংককে একটি ধাক্কা দেবে হয়তো।
মালয়েশিয়ার প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তারা লগ্নি করতে চাইছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। এবং তাদের প্রস্তাবেই বেরিয়ে আসছে, মালয়েশিয়া এ থেকে তুলে নিতে চায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। যদিও তারা এ ৭০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিতে চাইছে ৩৫ বছরে।
পদ্মাসেতু নির্মিত হলে সারা বাংলাদেশ বদলে যাবে, এ ধারণা অমূলক নয়। একটা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে দেয় তার সার্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোকেই। পদ্মাসেতু এ রকমেরই একটা সেতু, যার নির্মাণে বাংলাদেশ বদলে যাবে। সারা বাংলাদেশের সঙ্গে একটি যোগাযোগ বলয় প্রতিষ্ঠিত হবে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পণ্যের আদান-প্রদানেও এ সেতু রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
কিন্তু এক ট্রাক সবজি বহনে যদি প্রথম বছরেই ১৭৫০ টাকা টোল দিতে হয়, প্রতি বছর এ টোলের হার বৃদ্ধি পায় এবং সকল অর্থই চলে যায় মালয়েশিয়ার হাতে, তাহলে এ নিয়ে কিছু প্রশ্নতো আসবেই। টোল কোনো অযৌক্তিক কালেকশন নয়। পৃথিবীর সব জায়গায়ই এ পদ্ধতি চালু আছে। বাংলাদেশের ব্রিজগুলোতেও দেখেছি টোল পদ্ধতি। আবার ব্রিটেনের নতুন মোটরওয়ে নির্মাণের পর সেখানে চলছে টোল উত্তোলন। নিউইয়র্কে ম্যানহাটনের সরু টানেলে প্রবেশ করার সময় টোল দিয়েই ঢুকতে হয়।
পৃথিবীর অন্যান্য শহরগুলোও হবে এ রকমই। কারণ, বিশ্বতো চলে একই গতিধারায়। বিশেষত পুঁজি বিনিয়োগ এবং প্রফিট বানানোর প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর সব দেশের সকল পুঁজিপতি সব কালেই তার লাভকে প্রাধাণ্য দেন। রাষ্ট্রও তাদেরই স্বার্থ দেখে, দেখতে হয়।
বিশ্বব্যাংক নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অর্থমন্ত্রী সবাই কমবেশি ঝেড়েছেন। কিন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ক্ষমতার হাতটা এতোটাই বিশাল যে, সর্বত্রই যে কোনো প্রতিষ্ঠান তার ক্ষমতায়ন চাইবেই। প্রধানমন্ত্রী কিংবা অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে অনেক কিছুই বলেছেন। তস্কর, লুটেরা প্রভৃতি। গোস্বায় বলেছেন, নিজস্ব অর্থায়নের মাধ্যমেই পদ্মাসেতু হবে।
কিন্তু অর্থ যেখানে ২.৯ বিলিয়ন পাউন্ড, সেখানে বললেই যে সব কিছু হয়ে যাবে, তাও নয়। তবে পিছু ছাড়ছেন না দেশের শীর্ষস্থানীয়রাও। তাইতো সরকারের সকল শক্তি এখানে প্রয়োগ হচ্ছে। আওয়ামী রাজনীতির ফান্ডিঙের এক বিশাল বটবৃক্ষ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগপত্রও গৃহীত হয়েছে। চার-পাচজন গুরুত্বপূর্ণ সচিবকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। একজন উপদেষ্টাকেও হয়তো সরে যেতে হতে পারে।
অর্থাৎ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। পদ্মার প্রমত্ত ঢেউয়ের বিশাল ক্ষুধা। এ ক্ষুধা নিবৃত্তিতে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন। অতএব, একগুয়েমি দিয়ে কিছুই হয় না। এ বোধটুকু গলাবাজি করলেও আছে সরকারের উপর মহলের। আর তাইতো বিশ্বব্যাংকের পিছু ছাড়ছে না বাংলাদেশ।
অথচ ইতিমধ্যে বিভিন্নভাবে দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত এবং এম এম আকাশ পদ্মাসেতু নিয়ে নতুন কিছু ভাবতে ইঙ্গিত দিয়েছেন দেশবাসীকে। গোস্বায় হোক কিংবা বাস্তবতার নিরিখে হোক প্রধানমন্ত্রী কিন্তু একটা খাঁটি কথাই বলেছেন। দেশীয় অর্থায়নে যে, পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব তার অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশও দেখিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই দু’জন খ্যাতনামা শিক্ষক। অর্থনৈতিক এ বিচার-বিশ্লেষণ বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমেও।
এসব বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রবাসীরা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। যেমন প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলোর মাঝে আছে বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করা, প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ যতো বেশি সম্ভব ব্যাংকিং চ্যানেলে আনা অর্থাৎ হুন্ডি বন্ধ করা, ‘পদ্মাসেতু বন্ড’ কিংবা ‘সার্বভৌম বন্ড’ কিংবা ‘পদ্মাসেতু আইপিও’ ইত্যাদিতে প্রবাসীদের বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলা।
অর্থনৈতিক অন্য অনেক জটিল বিশ্লেষণে যেতে আমার সীমাবদ্ধতা প্রচুর। সেদিকে না গিয়ে শুধুমাত্র প্রবাসীদের দিকটা আমি সামান্য আলোচনায় নিতে চাই। ব্রিটেনের বাঙালিদের কথাই যদি আলোচনায় নেই প্রথমে, তাহলে দেখা যাবে বাঙালিদের একটা বিশাল অংশের কাছে আছে বাড়তি অর্থ। তারা বিভিন্নভাবে এগুলো বিনিয়োগের জায়গা খোঁজেন। এ জায়গা খোঁজার ব্যাপারটা জানেন ব্রিটেনের অনেক ধূর্ত ব্যবসায়ীরা। তাই এখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম নিয়ে তারা শেয়ার ছেড়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ইতিমধ্যেই। কখনো এয়ারলাইন্সের মালিক বানিয়ে দেওয়া, কখনো বিশাল পাঁচতারা হোটেলের মালিক হয়ে যাওয়া প্রভৃতি বিভিন্ন রকমের চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এখানে আকৃষ্ট করা হয়েছিলো অনেক প্রবাসীকে। এবং তাদের অনেকেই এক সময় চম্পট দেন টাকা নিয়ে। এয়ারলাইন্সও আসেনি, কিংবা হয়নি বিশাল আকারের হোটেলও।
আর সেজন্যে আসল বিনিয়োগকারীদের এখন চিহ্নিত করা এখন অনেকটা জটিল। হালে বাংলাদেশের এক সময়ের এক ডাকসাইটে নেতা এসেছিলেন তার সিংহ মার্কার টেলিকমিউনিকেশনের বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে। লন্ডন-বার্মিংহাম-ম্যানচেস্টারের অভিজাত হোটেলে হাজার হাজার পাউন্ড খরচ করে বিশাল কমিউনিটি জমায়েত করেও ব্যবসায়ীদের মন জয় করতে পারেনি তার প্রতিষ্ঠান। এমনকি সাধারণ মানুষগুলোকেও পারেননি তাদের বন্ড কেনাতে।
অর্থাৎ ব্রিটেনের বাঙালিরা এখন অনেকটা ঠকে ঠকেই কিছুটা শিক্ষা নিয়েছেন। আর এখানেই আমাদের মনে হয় একটা ভালো সুযোগ। সরকারি উদ্যোগ ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি এই ব্রিটেনের বাঙালিদের আকৃষ্ট করবে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রয়োজন বিশ্বাসযোগ্যতা। আমরা তাই ওই অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণকে স্বাগত জানাই।
একটা রূঢ় সত্যি কথা বলতেই হয়। ব্রিটেনে যদি সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরাসরি মানুষগুলো এ উদ্যোগ নেন, তাহলে এসব উদ্যোগের সফলতা নিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন উঠবে। এই ব্রিটেনে পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন কমিটি হয়ে গেছে। এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওই সরাসরি মানুষগুলোই তারও পৃষ্ঠপোষক। আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই, ওই মানুষগুলোর ওপর। কিন্তু দলীয় কোন্দলে বাস্তবায়ন কমিটি নিয়ে শুরুতেই কথা উঠেছে বিভিন্ন জাযগায়। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, পদ্মাসেতু নিয়ে অহেতুক কোনো চাঁদা উত্তোলন নয়।
ব্রিটেনের পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন কমিটিতে তাই দেশপ্রেমিক অভিজ্ঞ সেই সব মানুষগুলোকে জায়গা করে দিতে হবে, যারা পদ্মাসেতু নিয়ে প্রবাসীদের সচেতন করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।
উন্নয়নের ফুলঝুরির কথা নয়, যুক্তিকে পুঁজি করে বাস্তবতা নিয়ে যারা কথা বলতে পারেন, তাদের দিয়েই কথা বলাতে হবে। কারণ, আমরা চাই প্রবাসীদের একটা উদার সহযোগিতা থাকুক এই শুভ উদ্যোগে। পাশাপাশি ব্যবসায়িক লাভালাভেও অংশীদার হোক প্রবাসীদের অর্জিত অর্থ।
ফারুক যোশী: যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Faruk.joshi@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৪ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১২
সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর