দেশের রাজনীতির সবটাই যে এখনো পচে যায়নি, ঘুনে ধরেনি, তোফায়েল আহমেদ তারই প্রমাণ দিলেন। আনুগত্য, ভয় বা লোভের বশবর্তী হয়ে অথবা মন্ত্রীত্বের ফাঁদে অনেকে পা দিলেও বঙ্গভবনে পা বাড়াননি তিনি।
সাত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর যোগফলে আগামী এক বছরে লাউ গাছে নারিকেল বা নারিকেল গাছে বেগুন ধরবে না জেনেও আওয়ামী লীগ সরকার মহাজোটের নামে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত করেছে। কারণ সম্ভবত দুটো।
এক. মানুষকে নতুন করে আকৃষ্ট করা, চমকে দেওয়া। দুই. প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় রি-শাফল বা পুনর্বিন্যাস। অন্যদের বেলায় কিছু বলাটা অযৌক্তিক একমাত্র হাসানুল হক ইনু বাদে। তারা দলের নিয়ম মেনে মন্ত্রী হতেই পারেন। ইনু কিছুদিন থেকে বেশ সরব হয়ে উঠেছিলেন। তার এই সরবতা যখন মাইনাস ওয়ান বা খালেদা জিয়া মাইনাস ফর্মুলার মতো বিধ্বসী স্লোগানে পরিণত হলো, তখনই একটা সম্ভাবনা বা ঘটনার আঁচ করা অন্যায় মনে হচ্ছিল না। আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ লেখক শ্রদ্ধাভাজন গাফফার ভাইও এ নিয়ে তার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, লিখেছেনও। কিন্তু নেতা-নেত্রীরা শোনেননি, শোনার কথাও নয়। কেবল স্তুতি বন্ধনা বা প্রশংসা ভিন্ন তারা অন্য কোনো প্রসাদ গ্রহণ করেন না।
খালেদা জিয়ার ঘোর বিরোধিতায় বামপন্থি ইনুর মন্ত্রিত্ব লাভ ও এক বছর মেয়াদে এ দেশ সোনায় ভরে উঠবে না। সত্যি বলতে কি এই সাতজন ঘটনা বুঝে অ্যাকশনে যাবার আগেই সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। তবু নানাদিক অবিরল সমালোচনা, মন্ত্রিত্বের কথা ও কাজের বাড়াবাড়ি, দুর্নীতি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যর্থতায় চারদিকে যখন ‘গেল গেল’ রব, তখন এই পরিবর্তনের নামে নিজেদের কিঞ্চিৎ ঝালিয়ে নেয়া ছাড়া মূলত আর কোনো কারণ দেখা যায় না। অনেকে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সব চালের পেছনেও একটি করে চাল থাকে। এই চালের পেছনে কোন চাল আছে বা কোন ‘বেল’ ‘কল’ বা খেলের আবির্ভাব ঘটে তাই এখন দেখার বিষয়।
রাশেদ খান মেননও মন্ত্রী হবার ডাক পেয়েছিলেন। বেচারা (মেনন) পার্টির পলিটব্যুরোর চাপে যেতে পারেন নি, এমনটাই জানা গেছে। পার্টির লোকজন বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে মেননের কি উপকার করেছে তার জন্য ভবিষ্যতের কাছে হাত পাতা ছাড়া এখন কিছুই করার নেই। তবে মেনন ও ইনু প্রামাণ করলেন, বাম আদর্শ বা বাম রাজনীতির অর্থনৈতিক চিন্তাধারা, শাসন প্রণালী ও সাম্যবাদ মূলত কথার কথা।
বুঝলাম তারা দেশ ও জাতির মঙ্গলার্থে জামায়াত-বিএনপি ঠেকাতে মহাজোটে শরীক হয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী হয়ে তারা কি সমাজবাদী অর্থনীতি, সেক্যুলার রাষ্ট্র বা নিজেদের কথিত আদর্শ বাস্তবায়ন করতে পারবেন? কখনোই নয়, রবং নদী যেমন সমুদ্রে গিয়ে নাম ঠিকানা স্রোতহীন হয়ে পরিচয়হীন হয়ে মিশে যায়। এক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হবে না।
গুডলাক তারপরও, চারদিকে হতাশা, ক্ষিদে, দুর্নীতি আর অব্যবস্থার ভেতর তারা যদি ভালো কিছু করে দেখাতে পারেন মন্দ কি? তবে শেষ হাসিটি কিন্তু পোড় খাওয়া নেতা তোফায়েল আহমেদেরই। সংস্কারপন্থী হিসেবে অচ্ছ্যুৎ। যথাযোগ্য সম্মান বঞ্চিত রোষানলের শিকার হবার পর ভাত ছিঁটানো কাক সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো হামলে পড়েননি, দৌড়ও দেননি। আত্মসম্মান আর মর্যাদাবোধে ‘না’ বলে দলের অনুগত কর্মী হিসেবে কাজ করার বাসনা জানিয়েছেন। সত্যি বলছি, ঘনীভূত হবার মতো ঘটনাই বটে। বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, কামরুজ্জামান, মনসুর আলীদের কথা বলে দীর্ঘঃশ্বাস ফেলা আওয়ামী লীগাররা এদের রেখে যাওয়া আদর্শ বা নীতি কোনোটাই গ্রহণ করেন না। শেষ বেলার মন্ত্রী হয়ে বোঝা না বাড়ানোর কাজটি ঘাড়ে নিলেন না তোফায়েল আহমেদ।
একইসঙ্গে দুরদর্শিতা, বিপদ বাঁচিয়ে রাজনীতি করার পথটিও খুলে রাখলেন। অভিনন্দন আসন বা চেয়ার পেয়েও ‘না’ বলতে পারার কারণে। কেননা বহু ক্ষেত্রে ‘হ্যাঁ’ বলার চেয়ে ‘না’ বলাটা শক্ত এবং সে শক্তি থাকে না সকলের। ‘না’ বললে মুহূর্তের জন্য বিরাগভাজন হলেও আখেরে বিপদমুক্ত ও নিষ্কণ্টক থাকা যায়। বাকিটা সময়ই বিবেচনা করবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১২