আমার গ্রাম থেকে কিশোর-তরুণদের মিশ্রণে একটি দল এসেছিল। ওরা অনলাইন পত্রিকা করতে চায়।
ওদের ভাবনা- গ্রামের যারা দেশে এবং বিদেশে চাকরিসূত্রে ছড়িয়ে আছেন, তাদের সঙ্গে এই অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে একটা যোগসূত্র তৈরি হবে। সেই সূত্র ধরেই গ্রামের অবকাঠামো, শিক্ষা এবং বাণিজ্যিক উন্নয়ন হবে। ওদের উৎসাহটা আমাদের কিশোর বেলার দেয়াল পত্রিকা বা স্মরণিকা প্রকাশের মতো।
অনলাইন পত্রিকাটি কিভাবে সাজানো যায়, তা নিয়ে কথা বলতেই ওদের আমার কাছে আসা। কিছু টিপস দিতে দিতে জানলাম, গ্রামের অনেকের হাতেই এখন মাল্টিমিডিয়া মোবাইল। কম্পিউটার, ল্যাপটপ আছে বেশ কিছু বাড়িতে। কলেজ ও স্কুলে কম্পিউটার আছে। গ্রামের বাজারগুলোতে দুই-তিনটি সাইবার ক্যাফেও আছে।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। অনলাইন পত্রিকার সঙ্গেও গ্রামের তরুণ-যুবাদের পরিচয় ঘটেছে। তারা দেশ-বিদেশের খবর জানতে অনলাইন পত্রিকার ওপরই আজকাল ভরসা রাখছে বেশি।
ওদেরকে যখন তুমুল উৎসাহ দিয়ে বিদায় করলাম এবং নিজেও ঐ অনলাইন পত্রিকার প্রকাশনা মুহূর্তটির জন্য ছটফট করছি, তখনই জানা গেল- সরকার অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। অনলাইনপ্রেমীদের ভাবনা ও উৎসাহে এই খবরটি ভাটা এনে দিল।
ভাটা বলবো না খরা বলবো তা নিয়েও দোটানায় আছি। কারণ- খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, লাইসেন্স পেতে এককালীন ৫ লাখ টাকা তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। প্রতিবছর নবায়ন ফি দিতে হবে ৫০ হাজার টাকা। তথ্য মন্ত্রণালয়ের এই খসড়া চিন্তাটা অনলাইন গণমাধ্যমের ভাবনার বাগানকে মরুময় করে তুলবে।
কারণ, আমার গ্রামের ঐ কিশোর- তরুণদের পক্ষে ৫ লাখ টাকা যোগাড় করে, অনলাইন পত্রিকা বের করা সম্ভব নয়। কেবল গ্রামের ওদের কথাই বলছি কেনো, কোনো কপোরেট বা শিল্প গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া অনলাইন পত্রিকার আত্মপ্রকাশ হবে না, এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে। খসড়া নীতিমালা দেখে চূড়ান্তভাবেই বলা যায়, এটি হচ্ছে ডিজিটাল আকাশে উড়ন্ত অনলাইন পত্রিকার ডানা ছেঁটে দেওয়া আর টুঁটি টিপে ধরার যন্ত্র। একটা কথা নীতিমালা প্রণেতাদের মনে রাখতে হবে, এই মূহুর্তে দেশে যে প্রায় ২শ টির মতো অনলাইন পত্রিকা রয়েছে তার ৩/৪টির পেছনে বড় পুঁজির বিনেয়োগ রয়েছে। বাকি প্রায় সব পত্রিকার পেছনের পুঁজি কেবলই তারণ্যের উচ্ছ্বাস।
অনলাইন পত্রিকার জন্য একটি নীতিমালা তৈরি হবে, আমি তার পক্ষে। আমিও মনে করি একটি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। কারণ, সবাই যে এটাকে অনলাইন মিডিয়াকে উন্মুক্ত গণমাধ্যমের আন্দোলন হিসেবে বেছে নেবে তা নয়। অনলাইন পত্রিকা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে। সেই জন্য অনলাইন পত্রিকা কোনোভাবেই নজরদারির বাইরে থাকবে না। সেখানে সনাতন সংবাদপত্রের মতোই স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। রাষ্ট্র যখন দেখবে কোনো একটি অনলাইন পত্রিকা রাষ্ট্রবিরোধী উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন রাষ্ট্র তাকে সতর্ক করতে পারবে সংবাদপত্রের মতোই। আর তাই সংবাদপত্র যে আইন বা উপায়ে সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে থাকে, অনলাইন পত্রিকাও সেই পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে।
অনলাইন পত্রিকার প্রতি নীতিমালা পণেতাদের বিরাগ হবার সাধারণ একটি কারণ হতে পারে- এর অপ্রতিরোধ্য বিকাশ। অনলাইন পত্রিকা অন্তর্জাল দুনিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। অনলাইন পত্রিকায় কোনো একটি খবর প্রকাশ পেলে তা দ্রুতই এর লক্ষ-কোটি পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়। অনলাইন পত্রিকার এই গতিকে মুখে ডিজিটাল বাংলাদেশ জপতে থাকা, কিন্তু অন্তরে এনালগ ধারণ করা শম্বুক গতির কর্তারা মেনে নিতে পারছেন না। তারা ভাবছেন, তাদের মন্দ কাজগুলো, পিছিয়ে পড়ার গল্পগুলো বিশ্ববাসীর কাছে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়ার কাণ্ডটি করছে এই অনলাইন পত্রিকাগুলোই।
তাই অনলাইন পত্রিকার জ্যামিতিক বিস্ফোরণকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসতে চাইছে। আর তাদের এই অপকর্মে বাতাস দিচ্ছে, অনলাইন দুনিয়ারই কিছু মানুষ। যারা প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবার যোগ্যতা রাখে না। এবং একক বা মনোপলি মুনাফার খাদক। আর তাই ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে আমরা যখন `জয়তু, অনলাইন পত্রিকা` বলে জয়গান গাইছি, তখন তারা আওয়াজ তুলছে ‘ভয়তু অনলাইন পত্রিকা’!
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৪ ঘণ্টা, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com