সরকারের মেয়াদ যতই শেষের দিকে চলে আসছে, ততই যেন ধেয়ে আসছে সমালোচানার পাহাড়। ব্যর্থতার করাল গ্রাস যেন বর্তমান সরকারকে ডুবাতে বসাচ্ছে একের পর এক।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র আলোচনা-সমালোচনা, আন্দোলন কিংবা খালেদা জিয়ার দেশব্যাপী জনসংযোগ বিএনপির নেতা-কর্মীদের হয়ত চাঙ্গা করছে। কিন্তু আস্থা রাখতে পারছে কি বাংলাদেশের মানুষ বিএনপি’র উপরও। বিএনপি’র আন্দোলন দেশের মানুষকে খুব একটা নতুন পথও দেখাতে পারবে না এটাই ঠিক, কারণ বিগত জোট সরকারের স্মৃতি মানুষের চোখ থেকে মুছে যায় নি।
তারেক জিয়া-মামুন-বাবরদের দাপট আর অর্থ কেলেংকারী মানুষের স্মৃতিপট থেকে হারিয়ে যায় নি এখনও।
কিন্তু আওয়ামী লীগ নিয়ে এখন কথা বলছে সবাই। সরকারের ভেতর থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে এখন অসংখ্য প্রশ্ন। প্রশ্ন উঠছে সংসদে। প্রশ্ন উঠছে দলের ভেতরের মানুষের কাছ থেকে। প্রশ্ন উঠছে প্রকাশ্যে। সরকারের সমালোচনা এখন আর শুধু বিএনপি’র মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, সাবেক ছাত্র নেতা সম্প্রতি এক আলোচনায় বলেছেন, আওয়ামী লীগ করি বলে মানুষ হত্যা চেয়ে চেয়ে দেখব, এটা তো হতে পারে না। যে কোন বিবেকবান মানুষের মতো মাহমুদুর রহমান মান্নাও স্বীকার করেছেন, শেয়াবাজার কিংবা হলমার্কের মতো কেলেংকারীর জন্যে সরকার দায় এড়াতে পারবে না।
যে সরকার ব্যবস্থায় দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা সরকারেরই মানুষগুলো লুটে নিয়ে যায় এবং সরকারের কর্তাস্থানীয় ব্যক্তিরা কিছুদিন পথে-প্রান্তরে টিভি’র ক্যামেরায় এ নিয়ে বিব্রত হয়ে বিরক্তির সঙ্গে কথা-বার্তা বলে একসময় মিইয়ে দেন সব, তখন তো আমাদের এ সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়া যায় না।
পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোতেও হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হয। সমাজ বিরোধী কার্যকলাপ, অপরাধ, সন্ত্রাস, হত্যা, লুটপাট প্রভৃতি প্রবণতা আছে, বিধায়ই পৃথিবীর দেশে দেশে আইন-শৃংখলা বাহিনী প্রয়োজন হয়। অপরাধ প্রবণতা সুস্থ সমাজ ব্যবস্থারই একটা অপভ্রংশ। এই রুঢ় সত্যটি আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারি না। সেজন্যেই পৃথিবীর যেখানেই অপরাধ সংঘঠিত হয়, সেখানে আইন-শৃংখলা বাহিনী তৎপর হয়। অপরাধীদের গ্রেফতার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দায়িত্বটুকু পালন করে তারাই।
কিন্তু এই সেই আমাদের দেশ যেখানে গত সাড়ে তিন বছরে ৩৭৮ জন মানুষ গুম হয়েছে। এই গুমের মধ্যে আছেন এমনকি বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর মতো কেন্দ্রীয় নেতা।
গুম একটা-দুটো হতেই পারে। আইন-শৃংখলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব তৎপরতা চালাতেই পারে অপরাধীরা, কিন্তু এ তৎপরতাটি যখন অপরাধীদের প্রাত্যহিক অপরাধের একটি হয়ে যায়, তখন এটাকে আর অস্বাভাবিক বলতে পারি না। আমাদের তখন বলতেই হয়, এটা আইন-শৃংখলা বাহিনীর ব্যর্থতা।
সাম্প্রতিক বিশিষ্ট সাংবাদিক এবিএম মুসাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তা এবং টিভি চ্যানেল নিয়ে সরকার কিংবা তার এমপি-মন্ত্রীদের বিক্রি বাণিজ্য জনসমক্ষে এসেছে। এখানেও সরকার কিংবা খোদ প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রত হতে হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায একগুয়েমি সরকারকে একধরনের নির্লজ্জ বানিয়ে দিয়েছে।
পদ্মা সেতু ফিরে এসেছে---এ নিয়ে কি গর্ব করার মতো কিছু আছে? বরং পদ্মাসেতুর ফিরে আসায় বাংলাদেশের দুর্নিতীর মুল জায়গাটিকে পৃথিবীর কাছে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো বিশ্বব্যাংক।
খালেদা জিয়ার এক পুত্র কোকো-কে নিয়ে দেশের বিলবোর্ড বাণিজ্যের কথা উঠেছে সেসময়। কোকো তখন বিলবোর্ড বাণিজ্য সামলাতেন। শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন কোকো এ ব্যবসা করে। এখন বিলবোর্ড বাণিজ্য করেন আরও অনেক কোকো। উপদেষ্টার ভাগনে, মন্ত্রীর জামাই, এমপির ভাই এখন এ বাণিজ্য হাতিয়ে নিয়েছেন। এমনকি সময়ে সময়ে এরা আসল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিলবোর্ড দখল করেছেন চর দখল আর হল দখলের মতো।
ব্যবসায়ীরা ফিরিয়ে দিয়েছেন গ্রাহকদের লাখো-কোটি টাকা। ছাত্রলীগ-যুবলীগ সন্ত্রাসীদের এ দখলবাজি চলছে সব জায়গায় সারা দেশে। এ সরকার যে এক্কেবারে কিছুই করে নাই তাতো নয়, কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা, এমপি-মন্ত্রী-স্বজন-পিএসদের সম্পদের বিশাল পাহাড় দেখলে চোখ ধাঁধানোর মতো অবস্থা হয়ে যায় যে কারো।
মানবাধিকার সংস্থাসহ বিরোধী দল কিংবা এমনকি বিদেশেও বাংলাদেশের র্যাবের হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে দির্ঘদিন থেকে। কিন্তু সরকার পাত্তাই দেয় না।
অনেকেই বলে থাকেন, র্যাবের হত্যাকাণ্ড প্রকৃত সন্ত্রাসী নিধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে!
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে সারা দেশব্যাপী এই যে চলমান হত্যা-সন্ত্রাস-গুম, ছয় মাসে ১০ হাজারেরও বেশি নারী নির্যাতন এগুলো কি রোধ করতে পেরেছে এই এই হত্যাকাণ্ড।
প্রশ্নই রাখতে পারি আমরা, সন্ত্রাসীদের পাহারা দেয় কারা? রাজধানীতে খুনের আসামি,এলাকার দাগী সন্ত্রাসী পার্টি কিংবা নেতার তকমা লাগিয়ে কি নির্বিকার চালিয়ে যাচ্ছে তার তা-ব দেশের বিভিন্ন জায়গায়। এগুলোরও উত্তর দেবার সময় এখন।
এই উত্তরগুলো পাব কোথায় আমরা। প্রশ্ন যেমন আছে অসংখ্য, উত্তর নেই সে অনুপাতে। বরং তোফায়েল আহমদ আর রাশেদ খান মেনন মন্ত্রিত্বের অফার ফিরিয়ে দিয়ে প্রমাণ করলেন সরকার ভালো নেই। ব্যর্থতার দায়ভার নিতে চান নি তারা।
মেননও যে ধোয়া তুলশি পাতা তাতো নয়, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ রাজনীতির ময়দানে শুধু একটা গোল দিলেন মন্ত্রিত্ব ফিরিয়ে দিয়ে। এবং প্রকারান্তরে প্রমাণও করে দিলেন এ সরকারের ব্যর্থতার দিকটুকুও। আবার সরকার ও তার ব্যর্থতাটুকু প্রমাণ করলেন অহেতুক আরও ক’জন নতুন মন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে। কি-ই বা প্রয়োজন এতবড় মন্ত্রিপরিষদের?
মন্ত্রী-এমপিদের পেছনে হাজারো কোটি টাকা ব্যয় হয় সরকারের। দেশে-বিদেশে সফর, বাংলাদেশের মানুষের ট্যাক্সের অর্থ কিংবা বিদেশি এইড, তা-ও বাংলাদশের মানুষের প্রয়োজনে....সব কিছু যাচ্ছে কোথায়।
এ সুযোগে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি উঠে আসছে, এরশাদের মতো ভাড়-স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন সাধে বিভোর। ডা. মিলনের হত্যাকারী, তাজুল-বসুনিয়া-ময়েজ-কাঞ্চন-দিপালী সাহার রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করছে কারা। ক্ষমতার মসনদে বসতে আপোস আর নিজস্ব দলের কর্মী-নেতাদের হত্যাযজ্ঞকে জায়েজ করেও পার পেতে চাইছে সবাই। সরকারের ব্যর্থতার দায়ভার কে নেবে এখন। বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তার দায় কে নেবে? কে আসবে আবার .... নতুন বোতলে কি পুরোন সেই মদ?
লেখক: যুক্তরাজ্য অভিবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট