ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

৫ সহযোদ্ধা শরতের শিশিরের মত ঝরে গেলো!

ফারুক ওয়াহিদ, ম্যানচেস্টার, কানেক্টিকাট থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০১২
৫ সহযোদ্ধা শরতের শিশিরের মত ঝরে গেলো!

ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরের লোহারবন ট্রেনিং ক্যাম্পে সদ্য গেরিলা ট্রেনিং শেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর থানার ৫০ জনের একটি গেরিলা দলকে আগরতলার মেলাঘর, শালবন এবং অবশেষে ক্যাপ্টেন আয়েন উদ্দিনের অধীনে মনতলা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। ট্রেনিং শেষ অথচ যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছে না- এর জন্য মক্তিযোদ্ধারা প্রতিবাদ করেন এবং অনশন করার সিদ্ধান্ত নেন।

ক্যাপ্টেন আয়েন উদ্দিন অনেক বুঝিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনশন না করার অনুরোধ করেন এবং ঘোষণা দেন ভারত সরকার অস্ত্র ও গোলাবারুদ বরাদ্দ দিলেই খুব শীঘ্রই যুদ্ধে পাঠানো হবে। পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বিক্ষোভ এবং অনশন করার ইতিহাস আর কোথাও আছে কি না আমার জানা নাই।

অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন ১ অক্টোবর ’৭১ শুক্রবার আগরতলার মনতলা ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন আয়েন উদ্দিন আমাদেরকে বাংলাদেশে যুদ্ধে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। আমাদের বাঞ্ছারামপুরের ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধাদের বহন করা দুইটি নৌকা কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিএণ্ডবি রোডের সুলতানপুরের অদূরে মহিউদ্দিননগর ব্রিজের নিচ দিয়ে অতিক্রম করার সময় ঊষার আলো উঁকি দিলেও কিছুটা আঁধার ছিল। আমরা টের পাওয়ার অনেক আগেই কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসা হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যরা অনেকগুলো জলপাই রংএর যুদ্ধে সজ্জিত গাড়ি হেডলাইট অফ করে মহিউদ্দিননগর ব্রিজের উপর অ্যামবুশ(শক্রুর অপেক্ষায় ফাঁদ পেতে বসে থাকা) পেতে বসে ছিল এবং সাথে কুখ্যাত রাজাকাররাও ছিল। আমাদের নৌকা ব্রিজ অতিক্রমের সাথে সাথেই আমরা কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই ব্রিজের উপর থেকে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যরা নৌকার উপর একযোগে গ্রেনেড চার্জ করে এবং পাকিস্তানি এলএমজি ও এমএমজি থেকে ননস্টপ ব্রাশফায়ার করতে থাকে। গ্রেনেড চার্জের সময়ই আমাদের সাথে থাকা এন্টি ট্যাঙ্ক মাইন, এন্টি পারসোনাল মাইন, থারটি সিক্স হ্যান্ড গ্রেনেড, প্রচুর রাউন্ড (গুলি), এক্সপ্লসিভ সবকিছু প্রকম্পিত করে বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। আমাদের নৌকা টুকরো টুকরো হয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পানি থেকে অনেক উপরে শূন্যে উঠে যায়। আমরাও পানির সাথে সাথে শূন্যে উঠে যাই এবং কিছু বুঝে উঠার আগেই ছিটকে ধানক্ষেতের পানিতে পড়ে যাই। বিকট শব্দে কানে তালা লেগে যায়। কিছুই শুনছি না- জোরে জোরে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকলে যেরকম আওয়াজ শোনা যায় কানে সে রকম আওয়াজ পাচ্ছি। একদিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে, দম বন্ধ হয়ে যাওয়া বারুদের কড়া ঝাঁঝাঁলো গন্ধ এবং অন্যদিকে কুয়াশার মত ঘন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন কিছুই দেখছি না। আমার সঙ্গীরা কোথায় তাও জানিনা। হাত দিয়ে কান স্পর্শ করে দেখি তাজা রক্ত, নাকে হাত দিয়ে দেখি লাল তাজা রক্ত বের হচ্ছে। চোখ দিয়ে অশ্রুর বদলে রক্ত ঝরছে। বাম পায়ের হাঁটুর পিছনের ক্ষত দিয়ে রক্ত ঝরছে- মনে হল স্প্রিন্টারের টুকরো লেগেছে রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। ঘন ধানক্ষেতের ফাঁকে একটু মাথা উঁচু করে সিএণ্ডবি রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি শুধু জলপাই রংয়ের সাজোঁয়া গাড়ি আর গাড়ি। মনে হয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট খালি করে পাকিস্তানি সৈন্যরা সবাই চলে এসেছে। হঠাৎ পানিতে ডুবে ডুবে ধানক্ষেত নড়াচড়া করে বাঞ্ছারামপুরের ফরদাবাদ গ্রামের মিজান আমার দিকে এগিয়ে আসে। মিজানের কান দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমরা দুজনই ডুব দিয়ে দিয়ে প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে পশ্চিম দিকে সরে যেতে থাকি- শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ডভাবে কাঁপছি এবং শরীরে শক্তি পাচ্ছি না- উল্লেখ্য, তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। হঠাৎ দেখি সামনের জায়গাটা ফাঁকা খালের মত এবং ধানক্ষেত অনেক দূরে। এতবড় চওড়া খাল প্রায় ধানমন্ডি লেকের দ্বিগুন হবে। ডুব দিয়ে যাব কি করে? এখনইতো ধরা পড়ে যাব। আমি ও মিজান সিদ্ধান্ত নেই দম বন্ধ হয়ে মারা গেলেও এক ডু্বেই খালটি পার হতে হবে। এবং এত বড় খাল এক ডু্বেই পার হয়ে যাই- এখন আমার মনে হয় সেদিনের সেই ডুব সাঁতার অলম্পিকের রেকর্ডকেও হার মানাবে। আমরা দুইজন আমি ও মিজান দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হারিয়ে যাওয়া ক্ষত-বিক্ষত-বিধ্বস্ত আহত অবস্থায় অজানা-অচেনা দুর্গম পথের দুইদিনের চলার পথের ঘটনা- সে এক দীর্ঘ অশ্রুভেজা শিহরিত কাহিনী এবং কিছুটা রোমাঞ্চকরও। যাইহোক পরবর্তীতে নৌকাযোগে টহলরত অবস্থায় নবীনগর থানার মুক্তিযোদ্ধারা আমাদেরকে দেখে ক্ষত-বিক্ষত প্রায় অচেতন অবস্থায় পানি থেকে উদ্ধার করে নৌকাযোগে নবীনগরের কাইতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ছোট্ট ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্প বলতে একটি দোচালা ছোট্ট বেড়ার ঘর এবং সেখানে থাকার এবং কোনো প্রাথমিক চিকিৎসারও ব্যবস্থা ছিল না। সেখান থেকে রাতে আমাদের দুইজনকে কাইতলা বাজারে একটি পাটের গুদামে থাকতে দেওয়া হয়। অজপাড়াগ্রাম কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না- তাই সারারাত শরীরে প্রচণ্ড জ্বর ও রক্তক্ষরণ এবং তীব্র অসহ্য ব্যথা-যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকি। বিনিদ্র রজনী এবং অসহ্য যন্ত্রণা- কিন্তু একটি রাত যে এত বড় বা দীর্ঘ হতে পারে তা আগে জানা ছিল না- সেদিন বুঝেছিলাম এবং সেকথা এখনও কাউকে বুঝাতে পারবো না এবং কেউ বুঝবেও না- কীভাবে বুঝবে?

দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি এবং মিজান দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে দুইদিন পর বাঞ্ছারামপুর রূপসদী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে সন্ধ্যাবেলায় কোনো রকমে উপস্থিত হই। দুইদিন পর আমাদেরকে জীবিত অবস্থায় দেখে কিছুটা বিস্ময় এবং আমাদের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে কান্নার রোল পড়ে যায়। সেদিনের সংঘর্ষে ৫০ জনের মধ্যে শহীদদের তালিকায় তখনো আমাদের দুইজনসহ মোট ৭ জনের নাম ঘোষণা করা ছিল- এই ৭ জন হল- (১) আবদুল হাকিম, গ্রাম: বৃষ্ণারামপুর; (২) আরজু মিয়া, গ্রাম: বাহেরচর(বারাইলচর); (৩) ফজলুল হক, গ্রাম: জয়কালিপুর; (৪) মো. জিলানী, গ্রাম: হাসননগর; (৫) শহিদ মিয়া, গ্রাম: রূপসদী; (৬) মিজানুর রহমান(মিজান), গ্রাম: ফরদাবাদ(দুইদিন পর জীবিত উপস্থিত) এবং (৭) মো. আবদুল ওয়াহিদ ওরফে ফারুক ওয়াহিদ, গ্রাম: ধারিয়ারচর(দুইদিন পর জীবিত উপস্থিত)।

আমি ও মিজান জীবিত ফেরত আসায় শহীদের সংখ্যা দাঁড়ায় মোট ৫ জন। এই ৫ জন সেদিনই অর্থাৎ ১ অক্টোবর ’৭১ গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। শরতের ভোরে ৫ জন সহযোদ্ধা শরতের শিশিরের মত ঝরে গেলেন! ১ অক্টোবর আমাদের সহযোদ্ধা ৫ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এবং তাঁদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। সেদিন রূপসদী ক্যাম্পে চিকিৎসা করেছিলেন ঢাকার মতিঝিল-টিকাটুলির মোড়ের ঝিলভিউ ফার্মেসির মালিক(গ্রামের বাড়ি- বাঞ্ছারামপুরের বাঁশগাড়ী গ্রাম) ডা. আলী আসগর(এমবিবিএস)। তিনি সেদিন চিকিৎসা না করলে আমরা অনেকেই চিরদিনের জন্য অন্ধ, বধির এবং পঙ্গু হয়ে যেতাম।

পত্র-পত্রিকা পড়ে জানা গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সুলতানপুর গ্রামের মৃত শেখ আবদুল মন্নানের ছেলে শেখ মো. জামশেদ সাহেব যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে সুলতানপুরের ৭ জন দুর্ধর্ষ রাজাকারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। বাদী পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট মো. মোনায়েম খান। আসামিদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা এবং মুক্তিযোদ্ধা হত্যাসহ লুটপাট, অগ্নিসংযোগের অনেক অভিযোগ রয়েছে। মামলার আরজিতে এই কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রোডের মহিউদ্দিননগর ব্রিজে গণহত্যা এবং মুক্তিযোদ্ধা হত্যার কথাও উল্লেখ আছে। মামলাটির সুষ্ঠু তদন্ত হলে কোঁচো খুড়তে সাপ বেড়িয়ে পরতে পারে এবং মনে হয় সুলতানপুর গ্রামের এই রাজাকাররাই ১ অক্টোবর ’৭১ সালে বাঞ্ছারামপুরের ৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার সাথে হানাদার পাকিস্তানিদের সাথে যুক্ত থাকতে পারে। আমরা বাঞ্ছারামপুরের আমাদের সহযোদ্ধা এই মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারীদের বিচার চাই। যদি শহীদ পরিবার বিচার না পায়- হা হলে কি-
“বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা
এর যত মূল্য- সেকি ধরার ধূলায় হবে হারা?”

বাংলাদেশ সময় ২২১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১২

ফারুক ওয়াহিদ, মুক্তিযোদ্ধা ২ নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর
বর্তমানে ম্যানচেস্টার, ক্যানেটিকাট, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী

এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।