(২য় পর্ব)
আকারের দিক থেকে ছোট হলেও ইসরায়েল বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে একটি। শক্তিমত্তার পিছনে নিজেদের ক্ষমতা যতোটুকু, অনেকেই বলে থাকেন তার চেয়ে বেশি কাজ করে আমেরিকার এক-চোখা সমর্থন।
সম্প্রতি যে ‘’ইননোসেন্স অব মুসলিম’’ ছবিটাকে কেন্দ্র করে সারাবিশ্বে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, এর পিছনে কি শুধুই একজন মিশরীয় কপটিক খ্রিস্টানের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহি:প্রকাশই ছিল? শুধুই কি টাকা কামানোর ধান্দা থেকে সে এটা করেছে? নাকি স্রেফ মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তুলতে এই ফাজলামি?
হ্যাঁ, আপাতত সে রকম মনে হলেও ধীরে ধীরে পরিস্থিতি অবলোকন করে মানুষ এর পিছনে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন। আমেরিকায় চলছে এখন ভোটের মৌসুম। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবারই আলামত স্পষ্ট। এরই মধ্যে রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে ওবামাকে আবারো মুসলমান বংশোদ্ভূত আখ্যা দিয়ে শুরু হয়েছে নোংরা খেলা।
এতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না তারা। কারণ এরই মধ্যে ওবামা আমেরিকার প্রধান শত্রু ওসামাকে হত্যার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, তিনি একজন ‘খাঁটি আমেরিকান’। বুশ ছিলেন কথা ও কাজে নিষ্ঠুর। কিন্তু ওবামা মিষ্টভাষী হলেও কাজে তিনি অনেক ক্ষেত্রে বুশের নিষ্ঠুরতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন।
ওবামাকে মুসলিম প্রমাণের মিশনে সফল না হওয়াতে অনেকেই ধারণা করছেন, এই ছবি-পরবর্তী ঘটনাগুলোর মাধ্যমে ওবামা-বিরোধীরা ভোটের রাজনীতিতে তাকে কোনঠাসা করতে চেয়েছে। ঘটেছেও তাই। বেনগাজি হত্যাকাণ্ডের (মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে হত্যা) পরে ভোটের জরিপে ওবামার সমর্থনে লেগেছে ভাটার টান। ইসরায়েল বিবিধ কারণে ওবামার উপরে নাখোশ। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার উপস্থিতিকে ইসরায়েল মনে করে তার নিরাপত্তার জন্য জরুরি। অথচ আমেরিকা ইরাক থেকে তার সৈন্য সরিয়ে এনেছে। আফগানিস্তান থেকেও পালানোর পথ খুঁজছে। ইসরায়েলের অভিলাষ, আমেরিকা ইরান আক্রমণ করুক। অন্তত: ইসরায়েল ইরান আক্রমণ করলে আমেরিকা এসে তার পাশে দাঁড়াক। ওবামা ঠিক এ মুহূর্তে সেটাও চাইছেন না। বিপরীতে রিপাবলিকান প্রার্থীর কন্ঠে শোনা যাচ্ছে ইসরায়েলের যুদ্ধের হুংকার।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ বিশ্বের নোংরা খেলায় পারদর্শীদের মধ্যে এককাঠি সরেস। ৯/১১ এর ঘটনার মতো বেনগাজি হত্যাকাণ্ডে ইসরায়েলের ইন্ধনের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। কিছুদিন আগে ভারতসহ অন্যান্য দেশে ইসরায়েলি দূতাবাসকর্মীকে কথিত হত্যার চেষ্টার দায় ইরানের কাঁধে চাপিয়ে দিতে চাইলেও পরে প্রমাণিত হয়, এর পিছনে খোদ ইসরায়েলেরই হাত ছিল। ঠিক একই কায়দায় এই সিনেমার প্রতিক্রিয়ায় বেনগাজিতে আমেরিকান দূতাবাস কর্মকর্তাদের হত্যার পিছনে আসলে আল কায়দা নাকি ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ইন্ধন আছে সেটা নিয়েও সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বের বাদবাকি স্থানের মতো ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত বেশিরভাগ ধর্মীয় রায়টের পিছনে রাজনীতি কিংবা ক্ষমতার একটা সংযোগ ছিল। অনেকেই এথনিক কিংবা যে কোনো প্রকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে ‘স্বত:স্ফূর্ত’ বলে আখ্যা দেবার চেষ্টা চালালেও ডিউক ইউনিভার্সিটির স্টিভেন উইলকিনসন তার ‘ভোটস অ্যান্ড ভায়োলেন্স’ (ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত) লেখায় বলেন, ‘এথনিক রায়ট রাগ কিংবা ক্ষোভ থেকে উৎপত্তি হলেও এর পিছনে ভোটের রাজনীতি প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। ’’ বিশেষ করে এই উপমহাদেশে এই দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতালিপ্সুরা দুই ধরনের স্বার্থ হাসিল করে। প্রথমে ছোট শহরকেন্দ্রিক দাঙ্গা বাঁধিয়ে প্রাথমিক উদ্দেশ্যটা সফল করে। পরবর্তী সময়ে জাতীয় পর্যায়ে ত্রাতার ভূমিকায় নেমে দ্বিতীয় দফায় স্বার্থ লাভের চেষ্টা চালায়। রামুর ঘটনার দিকে দৃষ্টি দিলে এর প্রমাণ মিলবে। বৌদ্ধদের বাড়ি যখন দীর্ঘ সময় ধরে পুড়ে ছারখার হচ্ছিল, সরকার তখন নিরোর বাঁশি বাজাতে ব্যস্ত ছিল। পুলিশ কিংবা প্রশাসনের কেউ দ্রুততার সাথে সাহায্যে এগিয়ে যায়নি। সরকারী বা বিরোধী দলের কোনো নেতাকর্মী দাঙ্গা থামাতে এগিয়ে যায়নি। বরং সকল দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের নামে দাঙ্গায় সহায়তার অভিযোগ উঠেছে। সব যখন পুড়ে ছাই হয়ে গেল, তখন জাতীয় পর্যায়ে সরকার থেকে শুরু করে বিরোধী দলের সবাই একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে ফায়দা নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
স্টিভেন উইলকিনসনের মতো আরো অনেকেই সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সংগে ক্ষমতা সম্পর্ক বা রাজনীতির সম্পর্ক দেখিয়েছেন। আসগর আলী দেশভাগের আগে বা পরে যে কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সংগে গড়পড়তাভাবে ধর্মকে যুক্ত করে ফেলাটা ঠিক নয় বলে মনে করেন। তিনি ‘দেশভাগের আগে-পরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ শীর্ষক এক লেখায় এর পিছনে আরো কিছু জটিল কারণ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। রাজনৈতিক স্বার্থে খুবই নিপুণভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে সৃষ্টি করা হয়। দেশভাগের আগেও ক্ষমতায় যাবার মনোবাসনা পূরণের জন্য হিন্দু এবং মুসলিম এলিট সম্প্রদায় সুচতুরভাবে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করে। দেশভাগের পূর্বের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে আসগর আলী ব্যাখ্যা করেছেন, রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং জাতীয় সম্পদের উপরে হিন্দু এবং মুসলিম এলিটদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব হিসেবে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ভিত্তিক মিথোলজিও দাঙ্গার পিছনে ভূমিকা রাখে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ অঞ্চলে হিন্দু এবং মুসলমান শাসনামল নিয়ে যে যার মতো সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে মিথ রচনা করে একে অপরের উপরে শ্রেষ্ঠত্ব ফলাতে গিয়ে মূলত: এই সংঘাতের উৎপত্তি ঘটায়।
রায়টের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক বোঝাতে আসগর আলী ১৯৬১ সালের জাবলপুর রায়টের উদাহরণ টানেন। সংঘাতের উৎপত্তি ছিল একজন মুসলমান ছেলের সাথে হিন্দু মেয়ের পালিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এর পিছনে কাজ করেছিল ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। ছেলেটি ছিল ঐ অঞ্চলের বিড়ি ব্যবসায়ের ম্যাগনেট হিসেবে পরিচিত এক ফ্যাক্টরি মালিকের ছেলে। হিন্দু প্রতিযোগীরা সব সময় তার উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত ছিল এবং সেই রাগ থেকেই তারা পালিয়ে যাবার ঘটনাকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উস্কানি দেয়।
আসগর আলী বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে দাবি করেন, অধিকাংশ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কেন্দ্রস্থল ছোট শহরকেন্দ্রিক। নিম্ন মধ্যবিত্তের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক পরিচয় বেশ তীব্র। ছোট শহরের রাজনীতির নেতৃত্ত্বেও থাকে সাধারণত: ঐ শ্রেণীর মানুষ, যেমন ডাক্তার, উকিল এবং ছোট ব্যবসায়ী। যে কারণে তারা নিম্ন মধ্যবিত্তের ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এছাড়াও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রতিযোগীতা ক্রমান্বয়ে সামাজিক টেনশনে রূপ নিয়ে পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি ভারতের বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত শহরগুলোর বিবরণ দিয়ে বলেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ফলে কোনো ব্যক্তি ধীরে ধীরে ক্ষমতার সিঁড়ি ছোঁবার পথ খোঁজে। ক্ষমতা কাঠামোতে সংখ্যালঘুর এই অভ্যুদয় সেখানকার ট্রাডিশনাল সংখ্যাগুরুর নেতৃত্ব ও ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ছলছুতোয় ক্ষমতার সংঘাত সাম্প্রদায়িকতায় রূপ নেয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি ১৯৭০ সালে মহারাষ্ট্রের ভয়াবহ দাঙ্গার কথা উল্লেখ করে বলেন, সেখানকার কিছু মুসলিম তাঁত ব্যবসার মাধ্যমে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিল। এই সাফল্য তাদের স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত হতে উৎসাহিত করে। স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটি বিভিন্ন কারণে অঢেল অর্থ উপার্জনের মাধ্যম ছিল। সেখানে মুসলমান ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে প্রবেশ ট্রাডিশনাল হিন্দু নেতাদের অর্থ উপার্জনের স্থান হাতছাড়া হবার আশংকার সৃষ্টি করে। সেই ভয় থেকে তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা করে। এভাবে বিভিন্ন সময়ে মসজিদের সামনে দিয়ে গান বাজনা করা কিংবা গরু জবাই থেকে দাঙ্গার সূত্রপাত মনে হলেও গভীরে গেলে দেখা যাবে মূল কারণটা কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির সংগে সম্পৃক্ত। পশ্চাদপদ সমাজে শিক্ষিত এলিট শ্রেণী ক্ষমতার রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণকে ধূর্ততার সঙ্গে ব্যবহার করে থাকে।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিমাত্রই সাম্প্রদায়িক—এমন ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে আসগর আলী ভারতে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি মুসলিমদের কথা তুলে ধরেন। এই গোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় সংস্কৃতি নেই বললেই চলে। এরা অর্থনৈতিকভাবে খুবই শক্তিশালী এবং রাজনৈতিকভাবে উচ্চাভিলাষী। এরা নিজেদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এতোটাই নির্মম হতে পারে যে, প্রয়োজনে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের ব্যবহার করতেও কুন্ঠিত নয়। অথচ প্রাত্যহিক ও ব্যক্তিজীবনে ধর্মের সংগে এদের তেমন কোনো সম্পর্কই নেই।
ড: গোয়েল একই গ্রন্থে ভিন্ন প্রবন্ধে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পিছনে ধর্মের চেয়েও অন্য কিছুকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলেও জিন্নাহ ছিলেন একজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি। তিনি উভয় সম্প্রদায়ের বিভিন্ন লোকের ব্যক্তিগত তথ্য তুলে ধরে দেখিয়েছেন এদের অনেকেরই ধর্মীয় বিশ্বাস খুব একটা প্রবল ছিল না। ধর্মকে তিনি বলেছেন, আধ্যাত্মিক বিষয়, জীবন, জন্ম এবং মৃত্যু বিষয়ক দর্শন। যতোক্ষণ না বিভিন্ন মতবাদের বিশ্বাসীদের কেউ নিজ স্বার্থে ব্যবহার না করে ততোক্ষণ এটা ক্ষতিকর কিছু নয়। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, সত্যিকার ধার্মিক কখনো সংঘাতে জড়াতে পারে না। আপাত দেখা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পিছনে ধর্মের বাইরে প্রধানত অন্য কারণ ক্রিয়াশীল। (চলবে)
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com