প্রজাতন্ত্রের সর্বস্তরে জনগণের প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রপরিচালনার অন্যতম মূলনীতি। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্যই ছিল জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারব্যবস্থা কায়েম করা।
১৯৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বেরই বিজয় হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবমর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারব্যবস্থা কায়েম করার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে।
রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হলেও প্রতিনিধিত্বমূলক প্রজাতন্ত্র বা প্রশাসন কতটুকু অর্জিত হয়েছে এটি আজও একটি বড় প্রশ্ন।
সংবিধানের ৭ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ করবেন জনপ্রতিনিধিরা। কিন্তু বাস্তবে সংসদ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বা সরকার শপথ নেওয়ার কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয় সরকারের বিভিন্ন পদে জনপ্রতিনিধিত্বহীন ব্যক্তিদের নিয়োগ প্রক্রিয়া। সব সরকারের আমলেই এমনটি হয়েছে।
সব সরকারই মন্ত্রিসভায় নিয়োগ দিয়েছে টেকনোক্রেট মন্ত্রী। শুধু তাই নয় তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দাযিত্বও দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ৫৬ (২) অনুচ্ছেদে অত্যন্ত বাস্তব কারণেই সংসদ সদস্য নন এমন কাউকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছিল। রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো বিশেষ বিষয়ে অভিজ্ঞ বা দক্ষ ব্যক্তিদের আসার পথ খোলা রাখার জন্যই এ বিধান। যাতে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যায়। ’৭২ সালের যে সংবিধান তার উদ্দেশ্য সে রকমই ছিল।
কারণ সংবিধান বলছে, মন্ত্রিসভার কমপক্ষে নয়-দশমাংশ সংসদ সদস্যের থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে হবে এবং বাকি এক-দশমাংশও সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা রাখেন এমন ব্যক্তি হতে হবে। এ বিধানটি ভালোভাবে পড়লেই এর উদ্দেশ্য বোঝা যায়। এতে কেবল রাষ্ট্রের প্রয়োজনকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জনপ্রতিনিধিত্বের নীতি যতটুকু সম্ভব বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। টেকনোক্রেট মন্ত্রী হতে হলে জনপ্রতিনিধি হওয়ার যোগ্যতাও থাকতে হবে---এ বিধানটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক গুরুত্ব বহন করে।
কোনো ব্যক্তি বিশেষকে দলের প্রতি বা নেতার প্রতি বিশেষ আনুগত্য প্রদর্শনের স্বীকৃতি প্রদান করার জন্য সংবিধানের ওই বিধান সংযুক্ত করা হয়নি--- যা বর্তমানে আমরা দেখছি।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিষয়টি আরও নিশ্চিত করেছে সংবিধানের ১১ নং অনুচ্ছেদ। অনুচ্ছেদের শেষ অংশে বলা হয়েছে, ‘‘প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। ’’ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে সংবিধানের এমন ভাষণ জনপ্রতিনিধিত্বের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলো আইনের দ্বারা বলবৎযোগ্য নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য এগুলো অবশ্য পালনীয় বিষয় হিসেবে বিবেচিত। রাষ্ট্র পরিচালনার সব স্তরে এই মূলনীতিগুলো অনুসরণ করা হবে-এটিই সংবিধানের ভাষ্য।
আমাদের মূল সংবিধানেও (অনুচ্ছেদ-১১) বিধানটি একই রকম ছিল। কিন্তু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ধারাটি বিলুপ্ত করা হয়। পরবর্তীকালে আবার দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এটিকে পুনঃস্থাপন করা হয়। এখানে লক্ষ্যণীয়, কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে জনপ্রতিনিধিত্ব-সংশ্লিষ্ট ধারাটি বিলুপ্ত বা পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। রাষ্ট্রের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কোনো মূল্যায়ন বা সংবিধানে বর্ণিত ৭ নং অনুচ্ছেদের কোনো তোয়াক্কা কেউ করেনি।
পাঠক, রাষ্ট্র ও প্রশাসনে জনপ্রতিনিধিদের অংশীদারিত্ব নিয়ে সংবিধানের বিধান বর্ণনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং বর্তমান সরকার প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার নিয়ে যে উচ্চবাচ্য করছে তার বাস্তব চিত্র তুলে ধরতেই এ লেখা। সেই সাথে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ের আলোকে আগামী নির্বাচনের রূপরেখা ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টির ওপর আলোপাত করার চেষ্টা করব।
বর্তমান সরকারে ৩ জন টেকনোক্রেট মন্ত্রী ও ৭ জন উপদেষ্টা রয়েছেন। এসব উপদেষ্টা আওয়ামীলীগের প্রতি তাদের অবদানের স্বীকৃতি পেয়েছেন এতে সন্দেহ নেই। তারা সবাই মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন। ব্যক্তি হিসেবে তাদের মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। স্ব-স্ব ক্ষেত্রে তাদের অবদানও কম নয়। যোগ্যতার মানদণ্ডে তারা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হতেই পারেন। কিন্তু তারা মন্ত্রী নন, টেকনোক্রেট মন্ত্রীও নন, মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন উপদেষ্টা। এক-দশমাংশ টেকনোক্রেট মন্ত্রীর সংখ্যার বাইরে তারা অতিরিক্ত (মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন) উপদেষ্টা। টেকনোক্রেট মন্ত্রী ও উপদেষ্টা মোট ১০জন।
সংবিধানে উপদেষ্টা নিয়োগের ব্যাপারে কিছু বলা নেই। তার মানে এই নয় যে, সরকার উপদেষ্টা নিয়োগ করতে পারে। আইনে কোনো কিছু নিষেধ না করার অর্থ সবসময় ইতিবাচক নয়। আইনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিবেচনায় আনতে হয়। সে বিবেচনায় সংবিধানের মূল আদর্শের সঙ্গে উপদেষ্টা নিয়োগ সাংঘর্ষিক। প্রশাসনের সব স্তরে জনপ্রতিনিধিত্বের নীতির সঙ্গে মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন উপদেষ্টা নিয়োগ কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ এ প্রশ্নের সুরাহা হওয়া দরকার। তদুপরি সরকারকে তাদের প্রায় সবার ভূমিকার জন্যই একাধিকবার বিব্রত হতে হয়েছে।
আমরা যতটুকু বুঝি, টেকনোক্রেট মন্ত্রী ও উপদেষ্টা নিয়োগের উদ্দেশ্য একই-সেটা হলো সরকার পরিচালনায় বিশেষ অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন হলে তার নিয়োগদান করা। যদি তাই হয় হবে সংবিধানে এক-দশমাংশ হিসেব করতে হলে উপদেষ্টাদেরও বিবেচনায় আনতে হবে। তাহলে অন্তত সংবিধানে উপদেষ্টাদের একটা জায়গা হয়। তা না হলে সংবিধানে তাদের কোনো জায়গা নেই। ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ের পর এ বিষয়টি আরও নিশ্চিত হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে যে, টেকনোক্রেট মন্ত্রী নিয়োগের বিষয়টি অগণতান্ত্রিক ও ’৭২-এর মূল সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। উপদেষ্টাদের ক্ষেত্রেও এ রায় প্রযোজ্য। সরকার তো সংক্ষিপ্ত রায়ের আলোকে অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল করেছে; এখন মূল রায়ের পর টেকনোক্রেট মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের বেলায় কী সরকার কি করে সেটাই দেখার বিষয়।
বিষয়টি নিয়ে আগেও বিতর্ক হয়েছে। বিষয়টি আবার নতুন করে তুললাম কেননা সরকার বলছে নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া ক্ষমতা হস্তান্তর বা আগামী নির্বাচনের আর কোনো পথ নেই। অর্থাৎ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধীনেই নির্বাচন। কিন্তু সরকার নিজেই এক ঝাঁক অনির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে ঘর করছে। সর্ষের ভেতরেই ভূত আর কি!
রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রশাসনের সর্বত্র অনির্বাচিতদের দৃশ্যমান উপস্থিতি দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এরকম চিত্র কেবল কেন্দ্রেই নয়, মাঠ প্রশাসনেও। অন্তত ঢাকা সিটি করপোরেশন তার বাইরে ছিল। বর্তমানে বিভক্ত ঢাকাও দুই প্রশাসক দ্বারা পরিচালিত একটি নগর। একদিকে ঢাকা উত্তর আরেক দিকে দক্ষিণ-মাঝখানে প্রতিনিধিত্বহীন নগরবাসী।
কেবল সিটি করপোরেশনেই এ রকম চিত্র নয়। দেশের সবক’টি জেলা শহর এখন প্রশাসকদের দ্বারা পরিচালিত। ৬১টি জেলা পরিষদে কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। এগুলো চলছে সরকার কর্তৃক নিয়োজিত অনির্বাচিত প্রশাসকদের দ্বারা।
উপজেলা প্রশাসনে জনপ্রতিনিধি থাকলেও সংবিধানে উল্লিখিত জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের বিষয়টি উপেক্ষিত। সেখানে ক্ষমতার ত্রিমুখী লড়াই আপাত প্রশমিত হলেও স্থায়ীভাবে এখনও সুরাহা হয়নি। আইন অনুযায়ী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন পরিচালিত হওয়ার যে বিধান (অনুচ্ছেদ-৫৯) তা কেতাবেই সই, বাস্তবে নেই।
একদিকে অগণতান্ত্রিক ও জনপ্রতিনিধিত্বহীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল অপরদিকে প্রশাসনের সর্বত্র তারই বিস্তার স্ববিরোধিতা বৈ কিছু নয়।
ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ের বেশকিছু সমালোচনা থাকলেও কিছু সাহসী উচ্চারণও আছে। সরকার যেটি সুবিধাজনক সেটি গ্রহণ করলে আর যেটি অসুবিধাজনক সেটি বর্জন করলে আদতে কোনো রায়ই সরকার, বিরোধীদল বা জনগণ কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনে না।
লেখক: বাংলানিউজের আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com