ভালো থাকতে হলে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। এই বিষয়ে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়।
অন্যদিকে, ভারত দ্বারা ক্রমাগত বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কাজের প্রভাবে যুদ্ধে পাশে দাঁড়ানো বন্ধু রাষ্ট্রটি সম্পর্কে জনমনে ব্যাপকভাবে এবং দ্রুততার সঙ্গে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়।
দীর্ঘদিনের এই বৈরী সম্পর্কের আপাতদৃষ্টিতে একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সম্পর্কের এই নতুন যাত্রা আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে না দেখে বরং এর পিছনে বৈশ্বিক পরিস্থিতির একটা প্রভাবও কাজ করেছে বলে মনে হয়। সেই সঙ্গে সম্পর্কের এই পরিবর্তনে ক্ষমতা কাঠামোর নতুন পরিবর্তনের একটা ভূমিকা রয়েছে। অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে ক্রম বিকাশমান ভারত নিজেকে আর আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় না। বিশ্বশক্তি হতে হলে প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলে মনোনিবেশটা বিশ্ব পরিসরে নিতে হবে। তাছাড়া নতুন বিশ্বশক্তি হতে হলে আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোতে একটা শক্তিশালী অবস্থান দরকার। তালেবানি মাজেজায় পাকিস্তান ইতিমধ্যেই দুর্বল এবং অপছন্দনীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে পড়েছে। একমাত্র চীনকে বাদ দিলে বাকি ছোট রাষ্ট্রগুলো শক্তির দিক থেকে ভারতের জন্য কখনোই চ্যালেঞ্জ ছিল না। চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক মধুর নয়। স্নায়ুযুদ্ধের পরে শুধুমাত্র চীনই বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্র আমেরিকার মাথাব্যথার কারণ। সেই হিসেবে আমেরিকাও চায় এ অঞ্চলে চীনের একক আধিপত্য খর্ব করে আরেকটি বিপরীতমুখি সমান্তরাল শক্তির উত্থান। সব কিছু মিলিয়ে ভারত তার আশেপাশের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আর প্রতিদ্বন্দ্বী ভূমিকায় থাকতে চায় না। বরং সম্পর্কের উন্নয়নের মাধ্যমে নিজের একটা শক্তিশালী অবস্থান দেখতে চায়।
অন্যদিকে, পশ্চিমা ভুল নীতির কারণে সারা বিশ্বে মুসলিম উগ্রবাদীদের তৎপরতাও বিশ্ব রাজনীতি পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। ভারতের এক পাশে রয়েছে বৈরী চীন। বিগত দিনে চীনের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যুদ্ধেও জড়াতে হয়েছে। অন্য পাশে আছে জন্ম থেকে বৈরী পাকিস্তান। তার ওপাশে আফগানিস্তান। এই দুইটি দেশই এখন চরমপন্থীদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ইতিমধ্যে ভারত বেশ কয়েকবার সন্ত্রাসী হামলার শিকারও হয়েছে। আশেপাশের আরো কয়েকটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙলাদেশও ভারতের প্রতিবেশী। মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হবার ফলে ভারত মনে করে পাকিস্তান, আফগানিস্তানের পরেই বাংলাদেশও উগ্রবাদীদের ঘাঁটি হবার আশংকায় আছে। নিজের দেশকে সম্ভাব্য বিপদের ঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখতে তাই ভারত চাচ্ছে আগামীতে ক্ষমতায় যাবার সম্ভাবনা সৃষ্টিকারী বিরোধী দলটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের। এর আগেরবার জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে জামাতের ছত্রছায়ায় দেশে বাংলা ভাইদের দ্বারা ‘ছায়া তালেবানি’ রাষ্ট্রের মহড়া হয়েছিল। ভারতের দীর্ঘদিনের মিত্র, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের অবস্থানের কথা বিবেচনা করে ভারত নির্বাচনের আগেই প্রধান বিরোধী দলটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে ঝুঁকি এড়াতে চাইছে। তাছাড়া অদূর ভবিষ্যতে ভারতও আশা করছে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবার। এতোটা উঁচু অবস্থানে যাবার স্বপ্ন দেখে আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোতে প্রতিবেশী কোনো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের বিশেষ কোনো দলকে একতরফা সমর্থন দেওয়া দৃষ্টিকটু এবং স্বার্থবিরোধী। মৃত বাঘকেও কেউ সমীহ করে না। সেখানে শক্তিশালী ভারত কেন দেশের স্বার্থের বাইরে গিয়ে নানা সমস্যায় জর্জরিত, নানা কারণে বেকায়দায় থাকা সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের দেশের স্বার্থকে বিকিয়ে দেবে।
এই দিকগুলো বিবেচনায় এনে কূটনীতিতে সুবিধা আদায়ের পরিবর্তে, অনেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কারণ হিসেবে বাংলাদেশের তিনদিক ঘিরে ভারতের সীমান্তর কথা উল্লেখ করে কোন এক অজানা কারণে নিজের অবস্থানকে দুর্বল করে ফেলে। কথাটার ভেতরে প্রচ্ছন্নভাবে একটা হুমকি কাজ করে। অর্থাৎ তিনদিকে ভারত দ্বারা বেষ্টিত থাকায় তাকে সমঝে চলতে হবে। আরো গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করলে বলতে হয়, কিছুটা দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে। স্বার্থ বলি দিয়ে যে লেনদেন সেটাকে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ বলতে রাজি নই। বরং একে বলা যায়, ‘বশ্যতার সম্পর্ক’। অথচ কথাটাকে ঘুরিয়েও কিন্তু বলা যেত। আমরা যেমন ভারত দ্বারা তিনদিক দিয়ে বেষ্টিত আছি, ঠিক ভারতও কিন্তু একই সীমান্ত জুড়ে বাংলাদেশ দ্বারা বেষ্টিত হয়ে আছে। এভাবে ভাবার সাহসিকতা কিংবা আত্মমর্যাদাটুকু আমাদের অনেকের নেই কেন সেটাই বুঝা মুশকিল! কেন আমরা চিন্তা করি না যে, আমাদের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্কে শুধু আমরা নই, ওরাও লাভবান হবে। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ করার শক্তি এবং সামর্থ্য থাকলেও আমেরিকার মতো এক তরফাভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মতো সেই শক্তিশালী অবস্থান তার নেই। ভারত বড় দেশ বলে সব কিছু জলাঞ্জলি দেবার প্রয়োজন নেই। বড় দেহে শক্তি যেমন বেশি থাকে, প্রয়োজনটাও বেশি। এই উপলব্ধিটাই আমাদের অনেকের নেই বিধায় কূটনৈতিক দর কষাকষিতে আগেই পরাজিত হয়ে আসি। কূটনীতিতে ভারত বারবার আমাদের এই মানসিক দৈন্যের সুযোগটাই নেয়।
প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়ন ভারতের দিক থেকে উদ্দেশ্যটা আন্দাজ করতে পারলেও অন্য পক্ষের অবস্থান এখনো যথেষ্ট পরিষ্কার নয়। খালেদা জিয়া খুবই সহজ ভাষায় ভারতের বিরুদ্ধে কোনো তৎপরতাকে প্রশ্রয় দেবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসলেও ভারতের দিক থেকে তেমন স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে যে, খালেদা জিয়ার ভাষায় এই সফর ফলপ্রসূ হবার পেছনের কারণগুলো কি কি? ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কি কি পদক্ষেপ কার্যত ভূমিকা রেখেছে? নেতিবাচক সম্পর্ক হবার পেছনের দায়ী কারণগুলো কি চিহ্নিত করা হয়েছে? সেগুলো দূর করতে উভয় পক্ষের ভূমিকা কী হবে? জনগণের এই উদ্বেগগুলো পরিষ্কার করা জরুরি। পেছনের আয়নায় না তাকানোর সিদ্ধান্ত সব সময় মঙ্গলজনক নয়। এতে দুর্ঘটনার ঝুকিঁ থাকে।
খালেদা জিয়া গাড়ি চালাতে পারেন কিনা জানি না। তবে গাড়ি চালাতে গেলে পেছনের আয়নায় রিয়ার ভিউ মিরর) চোখ রাখতেই হবে। তাহলেই বোঝা যাবে বিপদের সম্ভাবনাগুলো কি কি এবং সেই মতো স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ির আরোহীদের জীবন রক্ষা সম্ভব। দেশটাও ঠিক গাড়ির মতোই। সামনে, পেছনে, ডানে, বাঁয়ে তাকিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হয়।
ঠিক আরেকটি বিষয় পরিষ্কার নয়। এই সফরে বিএনপির অর্জনগুলো কি কি? আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে, বিরোধী দলীয় নেতা ভারতের সঙ্গে নেতিবাচক সম্পর্কের জন্য তার দলের একক ভূমিকাকে কবুল করে এসেছেন। বিএনপি ভারত বিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসেছে, ভারত এ কথা বেশ ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। খালেদা জিয়া কিন্তু এই কথা প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি যে, ভারত-বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসেছে, ‘বড় ভাইসুলভ’ আচরণ পরিহার করেছে। এভাবে ভারত অতি সুকৌশলে উভয় দেশের মধ্যকার নেতিবাচক সম্পর্কের দায়ভার পুরোটাই বিএনপির কাঁধে সফলভাবে চাপিয়ে দিতে পেরেছে। আমাদের বিরোধীদলীয় নেতাও ভালো খেয়ে, রাজকীয় অভ্যর্থনা পেয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে আনন্দে বিভোর হয়ে আছেন।
অন্যদিকে সরকারি দলও কম বালখিল্যতা দেখায়নি। দীপু মনি থেকে শুরু করে ছোটবড় অনেক নেতাই বাক্যবাণের মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছেন ভারতের সঙ্গে আ. লীগের পুরাতন প্রেম অটুট আছে। খালেদার সফরের পরপরই মহাজোটের নেতারা ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের অতিথি হয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন’ সম্পর্ক স্থাপনের দৌড়ে তারাও পিছিয়ে নেই। ওদিকে বড় দুই দলের খুশির বগলবাজী শব্দে ঢাকা পড়েছে আবারো সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার খবর।
সচেতন নাগরিক হিসেবে বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন আমরাও চাই। তবে সেই প্রক্রিয়াটায় স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। নচেৎ নানামুখি সন্দেহ জাগতে পারে। প্রধান বিরোধী দল সরকারের অসংখ্য গণবিরোধী স্বিদ্ধান্ত এবং ব্যর্থতাকে ব্যবহার করে আন্দোলনে না গিয়ে দূতালী আন্দোলন করার আসল কারণ নিয়ে কানাঘুঁসা চলছে। বেশ কিছুদিন আগে বিদেশী একটা পত্রিকায় খবর বেড়িয়েছিল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’এর হাত ছিল। বিএনপি কি সেটা মনে করে একই ‘আশার’ পথে হাঁটছে? নাকি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে সত্যিকারভাবে জনগণ এবং দেশের মঙ্গলের জন্য কিছু একটা করার উদ্দেশ্যেই ভারতের দাওয়াতে সাড়া দেওয়া? সব কিছু পরিষ্কার করা প্রয়োজন। সম্পর্ক উন্নয়ন সবাই চায়। তবে সেটা বন্ধুত্বের, বশ্যতার নয়।
লেখক: Mahalom72@msn.com
বাংলাদেশ সময়: ১২৩১ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০১২
আরআর/সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com