ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ওবামা, রমনি এবং আমরা

আদনান সৈয়দ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১২
ওবামা, রমনি এবং আমরা

গোটা বিশ্বের চোখ এখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এই দেশটির নির্বাচন নিয়ে আমাদের জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই।

আবার কারো দেখি নাওয়া-খাওয়া পর্যন্ত প্রায় হারাম হয়ে গেছে। কে হবেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট? এই ভাবনাটি আজ গোটা বিশ্বের মানুষের। জানি এর ফয়সালা আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই আশা করি শেষ হয়ে যাবে; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে আমাদের চারপাশে নিত্য ফিসফাস আর কপালে যে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে তার আপাত গুরুত্ব কতটুকু থাকবে সেটাই হল কথা।
 
আমেরিকার নির্বাচন গোটা বিশ্বের কাছেই যে গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গোটা বিশ্বেই এই আমোরিকা নামের দেশটি তাদের ইচ্ছেমত ছড়ি ঘুরিয়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। যেমনটা ওবামা তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘‘ইউ আর উইথ আস অর উইদাউট আস”। আমেরিকা নামের যুদ্ধবাজ এই দেশ কখন কাকে শত্রু ভাবছে আবার কখন চিরচেনা শত্রুকে বুকে টেনে নিচ্ছে তা অনেক সময় খোদ আমেরিকার জনগণই বুঝতে পারে না। আর সে কারণে বলা হয়ে থাকে যে, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রিপাবলিকান অথবা ডেমোক্র্যাট যে-ই ক্ষমতায় আসুন না কেন দেশটির বৈদেশিক নীতি তাতে কিন্তু খুব একটা পরিবর্তন হয় না।   বুশ কে হারিয়ে ওবামা যখন প্রেসিডেন্ট হলেন তখন ওবামার প্রতিশ্রুতির ঝুলিতে ছিল এক ঝাঁক শান্তির পায়রা। বুশের ইরাক আক্রমণ এবং পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলমান দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরি কূটনৈতিক সম্পর্ক, আমেরিকার ভ্যন্তরীণ অর্থনীতির মন্দা ইত্যাদি সব মিলিয়ে খোদ আমেরিকার জনগণ বুশের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। বলা যায়, দেশ পরিচালনা, আমেরিকার অর্থনীতি, বৈদেশিক সম্পর্ক, সব কিছু মিলিয়ে বুশের চরম ব্যার্থতাই ওবামার কপালের জয়ের তিলক এনে দিয়েছিল। খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে, প্রেসিডেন্ট ওবামা তার গত চার বছরের রাজত্বে জনতার প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতটুকু পালন করতে পেরেছিলেন। এবং সেই একই বিবেচনায় বর্তমান আমেরিকান প্রেসিডেন্ট কে হবেন তা বিশ্বের মানুষের কাছে কতটুকু গুরুত্ব রাখে?
 
বলে নেওয়া ভাল যে, আমেরিকা ‘ইমিগ্র্যান্টদের দেশ’। গোটা বিশ্বের অভিবাসীদের নিয়ে এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হতে পারে এই ইমিগ্র্যান্টরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক পরিচয়েই নিজেরা পরিচিত কিন্তু মনে রাখতে হবে যে প্রতিটা ইমিগ্র্যান্টের কিন্তু তাদের নিজেদের একটি স্বতন্ত্র দেশ রয়েছে। আর সেই দেশটিই হল সেই অভিবাসীটির আসল দেশ। ইমিগ্র্যান্টদের মনে এমন একটি ধারণা সবসময় কাজ করে যে ডেমোক্র্যাট দল থেকে যিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হবেন তিনি হয়তো ‘লিবারেল’ মানসিকতা পোষন করবেন। রিপাবলিকানদেরকে সবসময়ই ‘‘হার্ডলাইনার” হিশেবে ইমিগ্রান্টদের কাছ থেকে গাল শুনতে হয়। রিপাবলিকান মানেই যেন অবৈধ অভিবাসীদের খেদাও আন্দোলন জোরদার, বিভিন্ন দেশে যুদ্ধবাজি করে দু পয়সা, দেশের বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি । আর অপর দিকে ডেমোক্র্যাটদের ইমিগ্র্যান্টরা বিবেচনা করেন নিপীড়িত মানুষের সাক্ষ্যাৎ বন্ধু হিশেবে। ডেমোক্র্যাটরাও বিষয়টি জানেন আর জানেন বলেই তাদের নির্বাচনী প্রচারনায় সব সময় ইমিগ্র্যান্টদের অধিকারের বিষয়টি জোরালোভাবেই উচ্চারিত হয়। কিন্তু যে বিষয়টি জানা দরকার আর তা হল ডেমোক্র্যাট থেকে একজন প্রার্থী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেই কি একজন সাধারণ হত দরিদ্র অভিবাসীর জীবনের ভাগ্য চাকাটি পাল্টে যায়? বা পাল্টে গেছে? আগেই বলেছি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিপাবলিকান অথবা ডেমোক্র্যাট যেই হোন না কেন তাতে করে সেই দেশটির বৈদেশিক নীতি খুব কি একটা পরিবর্তন হয়? সাধারণ মানুষের জীবনেও কি সত্যি খুব স্বস্তি চলে আসে? কিন্তু মানুষ শান্তিকামী। মানুষের মনে সব সময় আশার আলো জ্বলে। মনের অবচেতনে আমরা সবাই হয়তো এমন একজন প্রেসিডেন্টকে খুঁজি যিনি যুদ্ধবাজ নন, যিনি পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষদেরকে সাথে নিয়ে কাজ করবেন। আর সে কারনেই হয়তো আমরা বুশের মত প্রেসিডেন্টকে বার বার ধিক্কার জানাই। কিন্তু যে দেশটির নীতিই সাম্রাজ্যবাদ সেই দেশটির প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে আমরা কতটুকু আশার আলো শুনতে পারি?
 
আমি যুক্তরাষ্টের একজন নাগরিক। দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকার দরুন সে দেশটি সম্পর্কে কিছু অভিজ্ঞতা আমার নিশ্চয়ই হয়েছে। যে দেশে আজ থেকে মাত্র তিন দশক আগেও গায়ের রং চাকরি-বাকরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ ক্ষেত্রে বিরাট এক বিষয় ছিল সেই দেশে এখন গায়ের রং কোনো বিষয় নয়--- এমনটা যদি কেউ ভাবেন তাহলে বলবো আপনি বড় রকমের একটি ভুল করছেন। একজন ইউরোপীয় এবং একজন আফ্রিকান এই দুটো জাতের মাঝে এখনও বিস্তর ফারাক রয়েছে। বারাক হোসেন ওবামার জাত-পাত নিয়ে রিপাবলিকানদের হৈচৈ এর শেষ ছিল না। নির্বাচনী প্রচারণায় রমনি এর যথাযথ প্রয়োগ দেখিয়েছেন। রিপাবিলিকানদের ভাবটা এমন যে ‘‘এই ছোট কালো জাতের একটা লোক আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয় কিভাবে?” বিশ্বাস করুন বর্ণবাদের এই কালো থাবা থেকে আমেরিকা কিন্তু এখনোও মুক্ত নয়।
 
সেদিন নিউইয়র্ক থেকে এক সাংবাদিক বন্ধু আমাকে ভোর রাতে কল করে ঘুম ভাঙালেন এবং তিরস্কার করলেন। বন্ধুটি যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটদের জন্য প্রচুর খাটা খাটনি খাটছেন। তার অভিযোগ আমি নিউইয়র্ক থাকলে ডেমোক্র্যাটরা হয়তো আরো একটা ভোট বেশি পেতেন। আমি আমার নাগরিক দায়িত্ব পালন করিনি বলেই আমার উপর বন্ধুটির যত এই গোস্বা। আবারো সেই পুরনো কথা। ধরা যাক, ওবামা আবারো প্রেসিডেন্ট হলেন। নিউইয়র্কে আমাদের বাঙালি কমিউনিটি তাতে কি কি ফল পাবেন? অথবা ওবামা ইচ্ছা করলেই কি সত্যি সত্যিই আমেরিকার প্রতিটি রাজ্যে শান্তির পায়রা উড়িয়ে দিতে পারবেন? বা পাল্টে দিতে পারবেন আমেরিকার যুদ্ধনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, বৈদেশিক নীতি? বারাক ওবামার সেই ক্ষমতা কি সত্যিই আছে?
 
তারপরও আমরা যারা খুব সাধারণ মানুষ আমাদের আশা অনেক বেশি। আমাদের চোখে অনেক স্বপ্ন। কানাঘুষা হচ্ছে নির্বাচনের পরই নাকি আমেরিকা ইরান এবং সিরিয়াকে এক হাত দেখিয়ে দেবে। কি ভয়ংকর কথা! এদিকে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেই বেকারত্বের হার ৭% এর কাছাকাছি। তাহলে রমনি বা ওবামা এই পৃথিবীর পরবর্তী বিধাতা যে-ই হোননা কেন তিনি সত্যিকারে কি খেলটি দেখাবেন সেটাই হল বড় কথা। যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের প্রতি আমাদের শুধু একটাই প্রার্থনা, ‘‘গোটা পৃথিবীর মানুষকে তাদের নিজেদের শান্তি নিয়ে থাকতে দিন। যদি সম্ভব হয় শান্তির মশালটি জ্বালিয়ে দরিদ্র, বঞ্চিত মজলুম মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। আমরা যুদ্ধ নয় শান্তি চাই। পৃথিবীর মানুষকে শান্তিতে বাঁচতে দিন। ”

 লেখক: একটিভিস্ট
adnansyed01@gmail.com
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।