ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ওবামার বিজয়ে বাংলাদেশির ভাবনা

আবু জাফর মাহমুদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১২
ওবামার বিজয়ে বাংলাদেশির ভাবনা

এগিয়ে যাবার দৃঢ় অঙ্গীকারে ৬ নভেম্বর দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং সর্বাধিনায়ক বারাক ওবামা। তিনি প্রথমবার বিজয়ের ইতিহাস গড়েছিলেন পরিবর্তনের ডাক দিয়ে।

এই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান হোয়াইট হাউসে প্রথমবার সিংহাসন জয় করেছিলেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের নীতির বিপরীতে।

তখন এই বুশ ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ হারবার ওয়াকার বুশের পুত্র। অনেকের মতে, তিনি ছিলেন একজন রাগি যুদ্ধবাজ এবং আমেরিকান অর্থব্যবস্থা ধ্বসের জন্যে দায়ী, প্রেসিডেন্ট হিসেবে এজন্য সমালোচিত হয়েছেন।

এদিকে, ওবামা বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণিরর সমর্থনের প্রতীকরূপে আত্মপ্রকাশ করে হয়েছেন বেশ উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়।

ওবামার এবারের বিজয় কেবল তার একার নয়, তাকে কেন্দ্র করে অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় গণমানুষের অংশগ্রহণ এবং গড়ে ওঠা আস্থারও হয়েছে বিজয়। তাই এই বিজয় ব্যক্তির নেতৃত্বের বিজয়। তদুপরি শান্তিকামী আমেরিকানদের তো বটেই, পৃথিবীর দিগন্তজুড়ে অসংখ্য মানুষ এতে নিজেকে বিজয়ের অংশীদার ভাবছে বলে তাদের ও বিজয়। তাই এই বিজয়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও রয়েছে দিগন্তজুড়ে সকল মানুষের জন্যে।

মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিংকে তার ভুলে যাবার কথা কথা নয়। নিশ্চয়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ‘স্যান্ডি’র আঘাতে বিপর্যস্ত আমেরিকান জীবনে দুই প্রার্থীর তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই নির্বাচনের দিকে সারা দুনিয়ার মানুষের ছিল শ্বাসরুদ্ধকর মনোযোগ।

৬ নভেম্বরে হোয়াইট হাউসে ওবামা ফিরে আসায় এই মানুষদের মুখে হাসির আভা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এতে রিপাবলিকানদের স্বপ্ন ওলটপালট হয়ে গেল বলা যায়। বলতে পারি, রিপাবলিকানদের জন্যে এটা একটা কঠিন ধাক্কাও বটে। সর্বশক্তি দিয়ে লড়েও তারা ব্যর্থ হয়েছে।

সংবাদ মাধ্যমের খবরে এসেছে, ওবামা প্রশাসনের এই বিজয়ে ইসরায়েলের অধিনায়ক নেতানিয়াহু কিছুটা মন খারাপ করেছেন। কারণ নাকি ইরান আক্রমণ অনিশ্চিত এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গিলে খাওয়ার আশা সূদূর পরাহত হলো ভেবে।

ইসরায়েলি নেতৃত্ব কোমর বেঁধে প্রস্তুত ইরানে আমেরিকার আক্রমণের সিদ্ধান্তের জন্যে। আমেরিকাকে ব্যবহার করে সম্ভাব্য শত্রুর ক্ষতির চিন্তায় তারা অস্থির। কিন্তু এই আক্রমণ যে সারা বিশ্বকে সমৃদ্ধির ধারা হতে দুর্ভিক্ষে এবং প্রাণহানিতে ঠেলে দেবার।

ইরান আক্রমণ হলে তার ওপর যতো নির্ভরশীল দেশ, রাষ্ট্র ও অঞ্চল আছে,তাদের সবাই ভীষণ ক্ষতিতে পড়বে। রিপাবলিকান প্রার্থী এই আক্রমণের পক্ষের লোক। আর ওবামা তা করেননি, তিনি অন্য বিবেচনার লোক। একজন বিশাল বড় মাপের বিশ্বনেতা।

কেবলমাত্র ইরানের তেল সরবরাহ বন্ধ হলে চীনের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। ৭০ শতাংশ তেল সরবারাহ বন্ধ হয়ে যাওয়া সাধারণ কথা নয়। দুনিয়ার দ্বিতীয় প্রধান অর্থনীতির শক্তি চীনের ওপর আমেরিকার নির্ভরতা আছে যথেষ্ট। ভুললে চলবে কি? চীনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ওবামা আমেরিকার যে আর্থিক সম্পর্ক করেছে, তাতে কেবল আমেরিকা নয়, সারা বিশ্ব আছে সমৃদ্ধ।

আমেরিকার নির্বাচনে সিনেটে ডেমোক্র্যাট এবং প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকান দলের দখলে থাকায় এবার মার্কিন পলিসি মুখোমুখি হবে জটিলতার, থাকবে পরস্পরের চাপের মুখে।

এশিয়ার মানুষ মনে রেখেছেন, প্রশান্ত মহাসাগর এবং এশিয়ায় আমেরিকার ৬০ শতাংশ সামরিক শক্তি মোতায়েন করার ঘোষণা আছে প্রেসিডেন্ট ওবামার। সিঙ্গাপুরে ১১তম বার্ষিক সাংগ্রি-লা ডিফেন্স সামিটে ডিফেন্স সেক্রেটারি লিওন পেনেট্রা আমেরিকার সমর শক্তির চৌহদ্দি বাড়ানো সংক্রান্ত ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই পূর্বাভাস দেবার পর আমেরিকার সর্বাধিনায়ক ২০১২ ‍সালের জানুয়ারিতে সামরিক নেতৃত্বের অগ্রাধিকারে  আমেরিকার ভবিষ্য‍ৎ পরিকল্পনায় উল্লেখ করেন, ২০২০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন হবার কথা বলেন। ডিফেন্স স্ট্র্যাটেজিক গাইডেন্স সম্পর্কিত সর্বাধিনায়কের এই ঘোষণায় একবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার ভবিষ্যত সামরিক নেতৃত্বের আভাস তুলে ধরা হয়।

ওবামা আমেরিকার নেতৃত্বে কোনো ছাড় দেন না। কূটনীতি এবং জ্ঞানের সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়ার প্রত্যয় তার। ইরান, চীন এবং অন্যান্য জটিল বিষয়ে তিনি ও তার লোকগুলো মার্কিন অর্থিক সমৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেবার ঘোষণা দেন যুদ্ধের পরিবর্তে। এই ঘোষণার বাস্তবায়নে এগিয়ে যাবার পক্ষে এবারের নির্বাচনে আমেরিকার নাগরিক ভোটাররা সমর্থণ জানিয়েছেন। তাই, আপাতত যুদ্ধ এড়িয়ে বন্ধুত্ব ও কূটনীতির পথে সম্পর্ক-সমৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তিনি, তার নীতি ভেতরে-বাহিরে প্রশংসিত হয়েছে।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান দুয়ার বাংলাদেশে আমেরিকার নিবিড় ঘনিষ্ঠতাকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে চলেছেন বিশ্লেষকরা। এতে সহসা বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় অনৈতিকতা বন্ধ হবার আশাও করছেন অনেকে। আমেরিকার ৭ম, ৮ম ও ৬ষ্ঠ যুদ্ধজাহাজ বহরসহ সমগ্র সামরিক শক্তির প্রধান যোগাযোগ পথ এখন বঙ্গোপসাগর হয়ে। ৭১-এ যে পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল রুশ-ভারত বলয়। সে পথ নিজেই উম্মুক্ত করেছে আমেরিকার বর্তমান প্রশাসন। তাই ওবামার বিজয়ের পথ ধরে বাংলাদেশিরাও এক আলোকোজ্জ্বল বিজয়ে বিশ্বে নতুনভাবে উত্থান পেতে চলেছে।

মার্কিন জাতির সঙ্গে সারা দুনিয়ার শান্তির পক্ষের মানুষের আনন্দের এই দিনে আমার ভেতর যে গৌরব বোধের আলো ছড়াচ্ছে এবং এক ধরনের শান্তিতে আমি উজ্জীবিত হয়ে উঠছি,তা পরিষ্কার বলতে পারি। সারা দুনিয়াই অসংখ্য শান্তিবাদী মানুষ নৃত্য করছেন বা স্বস্তিতে মনোবল পেয়েছেন।

তারা প্রথমত, সান্ত্বনা পেয়েছেন এজন্যে যে আমেরিকা আবার ‘যুদ্ধযুগে’ ফিরে যায়নি। শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলার দৃঢ়তা বজায় রেখেছে। রিপাবলিকান প্রার্থীর কড়া লাইনের বিপরীতে বিশ্বনেতার দায়িত্ব জ্ঞানবোধ দেখা গেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রকাশ্যে অঙ্গীকারের মধ্যে।

৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন করে নেচেছিলাম। সে সুখ হারিয়ে হতাশ হইনি। এদিনের আশায় দিন গুণছিলাম। ধৈয্য ও পরিশ্রমের ব্যর্থতা নেই। আগামীতে আমাদের নৃত্য হবে বাংলাদেশকে পরাশক্তি পরিচয়ে দেখে, এশিয়ান শক্তির ভূমিকায় দেখে। ওবামার বিজয় বাংলাদেশের পথ পরিষ্কার করে দিয়েছে।

কী আশ্চর্য মার্কিনি ধ্বংসযজ্ঞে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি জর্জরিত আফগানিস্তানিরাও আনন্দে নাচছে বারাক ওবামার বিজয়ে। মার্কিনসহ ন্যাটোর সেনা ফিরে আসবে আফগানিস্তান হতে। আমেরিকার ওপর ক্ষেপে থাকা পাকিস্তানিরাও তালে তালে নেচে চলেছে ইরাকিদের নাচের অনুষ্ঠানের আরেক দিকে। তারা বিশ্বাস করেন, ওবামা আমেরিকার জনগণের সঙ্গে সে সব রাষ্ট্রের মানুষের বন্ধুত্ব গড়ছেন।

দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক প্রভাবশালী গবেষক পণ্ডিতরা লিখে চলেছেন, চীনের শক্তি এবং সামর্থ্যের উত্থান দমনের জন্যে নাকি আমেরিকার ভয়ানক এশিয়ান নীতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। অথচ ওবামাকে বিজয়ী হতে সব ধরনের সমর্থন দেওয়া এবং ওবামার ভুবন কাঁপানো বিজয়ে চীনাজাতির আনন্দ উচ্ছ্বাস দেখে সারা বিশ্বই অবিভূত।

এশিয়ান-আমেরিকানরা কেবল নন, এশিয়ার দেশে দেশে সাধারণ মানুষের কাছে ওবামা যেমন আপন হয়ে উঠেছেন, তিনি আপনজনের সম্মান পেয়েছেন ইউরোপের সব দেশের মানুষের কাছে। আফ্রিকানরা তো আছেই তার সমর্থনে।

দুনিয়ার সব মহাদেশে জনপ্রিয় হওয়া আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আজ তাই কেবল আর এক রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেই সীমিত নন, তাকে এবং তার অর্জিত এই ইমেজকে বিশ্ববন্ধু বা বিশ্বনেতার বিশেষণে হিসেব করা হচ্ছে ইতিমধ্যেই। শুরুতেই এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। এটাও রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। বিশ্বব্যাপী সংকটের রাজনৈতিক সমাধান এবং শান্তি-সমৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য নেতৃত্বের জন্যে আরেকটি নোবেল পুরস্কার তার জন্যে জুটে গেলে অবাক হবার থাকবে না।

তবে একথাও বলা দরকার, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এই বিজয়ের অভিযাত্রায় সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটনের নিরলস পরিশ্রম এবং সুযোগ্য কূটনীতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য অবদানরূপে স্বীকৃত হয়ে থাকবে। ওবামা-হিলারি জুটিকে বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার বর্তমান আলোকিত কর্তৃত্বের প্রধান তারকাজুটি বলে চিহ্নিত করা যায়।

ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান জন কেরির বিরামহীন সমর্থন মূল নেতৃত্বকে সফলতা দেওয়ায় যথেষ্ট অবদান রেখেছে। পেন্টাগনে সিআইএ বিশ্বব্যাপী তথ্যানুসন্ধানে নিজেদের বিশ্বনেতৃত্বের অগ্রসর দাবিদার রাখার গৌরব অব্যাহত রেখেছে। প্রেসিডেন্ট ওবামার পুনর্নির্বাচন এই সত্যই প্রমাণ করলো।

এতে এটাও দেখা যায়, ওবামার এই নেতৃত্ব কেবল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে নয়, তিনি বরং সারা দুনিয়ার মানুষের চেতনায় আপন হয়ে উঠেছেন। এই কৃতিত্ব প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটননসহ সমগ্র ডেমোক্র্যাটদের।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতি বিশ্লেষক, কলাম লেখক, নিউইয়র্ক

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৯, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।