অনেকের টাই বাঁধতে বেশ ঝামেলা হয়। সময় লাগে অনেক বেশি।
প্রবাসীদের কল্যাণে বা স্বার্থে গঠিত ‘দ্বি-খণ্ডিত’ মন্ত্রণালয় প্রায়শই ঢাকঢোল পিটিয়ে বিদেশে শ্রমবাজারের খোঁজে নামে। জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ ও ক্ষেত্র ক্রমেই বাড়ছে—এমন দাবির সমর্থনে বিভিন্ন দেশ সফরে মশগুল থাকেন মন্ত্রী আর কর্মকর্তারা। সাড়ম্বরে পুরনো চুক্তিগুলো সামান্য ঘষামাজার নবায়নের ছবিতে বাহাদুরি কুড়ান। সত্যিই কী মন্ত্রণালয় ওয়েজ আর্নারদের কোনো কাজে লাগে?
জনশক্তি রফতানিকারক দেশগুলো নিত্য-নতুন বাজার অন্বেষণের পাশাপাশি বিরাজমান বাজার নিশ্চিত দখলে রাখতে মনোনিবেশ করে থাকে। বিভিন্ন দেশে কর্মরত ওয়েজ আর্নারদের হাল-ফিল খবরাখবরও রাখে।
কোনো নাগরিক কোনো ঝামেলায় পড়লে দূতাবাস দ্রুত এগিয়ে আসে। বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর সুশিক্ষিত কর্মকর্তাদের বেশির ভাগেরই রেকর্ডে ‘ব-কলম ধরনের’ ওয়েজ আর্নারদের জন্যে স্যুটের ভাঁজ নষ্ট করাটা নেই।
খোদ মন্ত্রণালয়ে যারা (ওয়েজ আর্নার) উপেক্ষিত দূতাবাস কেনো তাদের পাত্তা দেবে? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনীতিকরা বিষয়টি নিয়ে বেশি মাথা ঘামান না; কারণ বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের শংকর বা ককটেল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সামঞ্জস্যহীন মিশ্রণ। জনশক্তি রফতানিকারক দেশগুলোতে রাষ্ট্রদূতদের চেয়েও বেশি ‘ওজন’ লেবার অ্যাটাশেদের।
মালয়েশিয়ায় থাকা অবৈধ বাঙালি শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান এসেছে বহুদিন পর। ডিজিটাল নামের বায়োপেজের পাসপোর্ট ইস্যু নিয়ে কেলেংকারি আর টাকা কামানোর মহোৎসবে দীর্ঘদিন ছিলেন দূতাবাসে থাকা লেবার অ্যাটাশে আর পাসপোর্ট ইস্যুর দায়িত্বে থাকা কূটনীতিকরা। দু’দিনের দশ টাকার কাজে ওয়েজ আর্নাররা গুনেছেন দশ দিনের লম্বা লাইন আর দশগুণ বেশি ‘হাদিয়া’।
কাগজে-পত্রে বা পরিসংখ্যানে জনশক্তি রফতানি কেবলই বাড়ে আর। কারণ ১০ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশের রফতানি আর ১৪ কোটি জনসংখ্যার বর্তমানের সংখ্যাটা তুলনামূলকভাবে বেশি। কিন্তু শতাংশের হারে? তিন বছর আগে একজন শ্রমিক যে বেতন পেতেন এখন কালের স্বাভাবিক নিয়মেই বেতন কিছুটা বেশি, তবে অন্যদেশি শ্রমিকদের তুলনায় অনেক কম। সেকারণেই রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তির দিকে। সেসব দেশের দূতাবাস শ্রমিকদের নায্য পাওনার জন্যে দেন-দরবারে থাকে। আমাদের দূতাবাস দালালদের মাধ্যমে নেয়া নথিপত্র সত্যায়িত করার ‘হাদিয়া’ আদায়েই বেশি মনযোগী।
কুয়েতে ইরাকি আগ্রাসনের পর বাংলাদেশি শ্রমিক পুনর্বাসনের গল্পটা স্বস্তিকর বা সুখকর নয়। জাতিসংঘের দেয়া অর্থসাহায্য নানানভাবে নয়ছয় হয়েছে। লিবিয়ার সাম্প্রতিক সংকটে ওয়েজ আর্নারদের পুনর্বাসন প্রশংসনীয় হলেও সিরিয়া-জর্দান-তিউনিসিয়ায় কর্মরত ওয়েজ আর্নারদের কোনো খবরাখবর কি দূতাবাস কিংবা সেগুনবাগিচার আয়েশী কর্মকর্তারা রাখেন?
আক্তারুজ্জামান বাবুল নামের মানুষটি ’৮৯ থেকে আমার ভাগ্য-দূর্ভাগ্যের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। ৩৫ বছর বয়স্ক মানুষটি একাধারে আমার নফরদার ও অভিভাবক। বাংলাদেশে আমার সবকিছু বাবুলের তত্ত্বাবধানে থাকে।
কারণে-অকারণে আমাকে উপদেশ ও পরামর্শ দেবার চর্চাটা তার বেশ রপ্ত। বাবুলের শ্যালক-সম্বন্ধিরা সবাই মধ্যপ্রাচ্যে চাকরিরত। অথচ বাবুল বাংলাদেশে সামান্য এক ক্লিনার! স্ত্রীর ঘ্যানর-ঘ্যানরে বাবুল গেল কয়েক বছর ধরে বিদেশ তথা মধ্যপ্রাচ্যে যাবার জোর প্রচেষ্টায় ছিলো। দালালরা প্রথমে কুয়েত বা কাতার পাঠানোর প্রতিশ্রুতিতে জমি বিক্রি করা টাকা হাতিয়ে নেয়। তারপর বিভিন্ন অসুবিধার কথা বলে ইরাকে যাওয়ার ব্যাপারে বাবুলকে সম্মত করায়। অবশ্য শেষাবধি নিরুপায় বাবুলের গন্তব্য হয় লিবিয়া।
ছয়মাস বাংলাদেশ ছাড়া ‘হোমসিক’ বাবুল প্রতি শুক্রবার একদফা ফোন করে নিজের পরিবারকে। আরেক দফা আমাকে। গাদ্দাফি-উত্তর লিবিয়ায় সবার হাতে অস্ত্র। আইন-শৃংখলার ‘ডাইল’ দশা। দেশটি সম্পদশালী হলেও সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ধরনের অভাবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ফলে বাবুলের মতো নিরুপায় লিবিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি ওয়েজ আর্নাররা স্বেচ্ছা বন্দিত্বে নিজেদের নিরাপদ রেখেছিলেন দীর্ঘদিন। ওর মালিক নিপাট ভদ্রলোক। নিয়মিত টাকা-পয়সা দিতেন।
হালে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। অস্ত্রধারীদের হামলা আর নির্যাতনের ভয়ে বাবুল ও অন্যরা প্রাণ হাতে মানবিক মালিকের পরামর্শে পায়ে হেঁটে দু’শ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশ দূতাবাসে। দূতাবাস কর্মকর্তারা তাদের আঙ্গিনায় জায়গা দিয়েছেন। দল বেঁধে ওরা সেখানে চাঁদা তুলে সামর্থ্যানুযায়ী খেয়ে-দেয়ে বেঁচে আছেন। দূতাবাস অন্য কোনো সহায়তা না করলেও আশ্রয় তো দিয়েছে!
গেল শনিবার বাবুলের ফোনে জানলাম পরিস্থিতি ভয়াবহ। বাবুলের দেশে ফেরার জো নেই পাওনাদারদের ভয়ে। লিবিয়ায় থাকার পরিবেশ নেই। টাকা-পয়সা-পাসপোর্ট হারানোর পাশাপাশি খোয়া যেতে পারে পৈতৃক প্রাণটা। বাবুলের সামনে এখন ভয়ানক একটাই পথ খোলা---- জীবন নিয়ে জুয়া খেলা। বাঙালি ও বিদেশি দালালরা তাদের উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি বা গ্রিসে নিয়ে যেতে সম্মত আছে দু’লাখ টাকার বিনিময়ে।
যেহেতু পরিশোধের মতো নগদ টাকা হাতে নেই, সেহেতু যদি উত্তাল সাগর পেরিয়ে পৌঁছাতে পারে গ্রিস বা ইতালি তাহলে বিনা বেতনে কেবলমাত্র থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে একবছর বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিয়ে পরিশোধ করতে হবে দালালের ঋণ।
বাবুলের ‘ওয়েজ আর্নার’ হবার স্বপ্ন এখন অনিশ্চিত ‘জীবন-জুয়ার দুঃস্বপ্নে’ পরিণত। যেহেতু ফেরত আসার পথটা রুদ্ধ, সেহেতু জীবনের এই চূড়ান্ত জুয়া খেলা ভিন্ন গত্যন্তর বোধ করি বাবুল(দের) নেই।
এ বিষয়টায় প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের কোনো দায়-দায়িত্ব আছে কি?
ইমেল: abid.rahman@ymail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৯ ঘণ্টা, ১৪ নভেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: একে; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com