ঢাকা, শনিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সুন্দরবনে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র: সম্ভাবনা না সঙ্কট?

মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১২
সুন্দরবনে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র: সম্ভাবনা না সঙ্কট?

ঢাকা: আমাদের দেশে পরিবেশ সচেতন মানুষের অভাব নেই, অভাব শুধু দেশ প্রেমের। তা না হলে সুন্দরবন ধ্বংসের আরও নতুন উদ্যোগ কেন নিলো সরকার?

মানছি বিদ্যুৎ আমাদের অনেক দরকার।

বিদ্যুতের অভাবে সরকার, জনগণ উভয়েই বিপদে। তাই বলে ক্ষুধা লাগলেই তো বিষ খেতে পারি না। বাগেরহাটের রামপালে সুন্দরবন লাগোয়া ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার।

নিশ্চয়ই ভালো খবর। কিন্তু সেটা সুন্দরবনের কাছে কেন? আমরা জানি জ্বালানি সমস্যাই আমাদের প্রধান সমস্যা। সরকার জ্বালানির সংকট নিরসনে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে। আগে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। বর্তমানে জ্বালানি তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হলো।

কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ওই এলাকা এমনকি এর আশপাশের পরিবেশরও বিপর্যয়ের কারণ হবে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। বিশেষ করে বাগেরহাটের রামপালে সুন্দরবন সংলগ্ন সাপমারী-কাটাখালি এলাকায় কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে সুন্দরবন ও সংলগ্ন লোকালয়ের ওপর ব্যাপক পরিবেশগত ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। এতে ওই এলাকার মাটি, পানি ও বাতাসের দূষণসহ লবনাক্ততা ও তাপমাত্রা বাড়বে।

উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ সমস্যার জরুরি সমাধানে সরকার এর মধ্যে  কয়েকটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে বেসরকারি খাতে। এ নিয়ে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা অভিযোগও শোনা গেছে। রাশিয়ার সঙ্গে আগামীতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার। এও সত্য,  দেশ-বিদেশে বিপুল বিতর্ক সত্ত্বেও কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র  থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুতের দাম তুলনামূলকভাবে কম।

অবশ্য ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী রামপালের বিদ্যুতের দাম আদৌ কম পড়বে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কেননা স্থানীয় বড়পুকুরিয়ায় প্রাপ্ত কয়লা যেখানে প্রতি টন মাত্র  ৮৪-৮৫ ডলারে বিক্রি হয়, সেখানে রামপালের কেন্দ্রটির জন্য ভারত থেকে কয়লা আমদনি করতে হবে প্রতি টন ১৭৩ ডলারে। তারপরও এ প্রকল্পে ভারত সরকার যে অর্থ ব্যয় করবে, বাংলাদেশকে  সে জন্য ১৪ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। হিসাব মতে, প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ পড়বে ১৫ কোটি টাকা। এতে  যৌথভাবে বিনিয়োগ করেও বাংলাদেশের লাভের চেয়ে  ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তার মানে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুতের দামও পড়বে অনেক বেশি। অনেকটা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মতোই।

গত সোমবার বাগেরহাট প্রেসক্লাবে নিজের গবেষণার আলোকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরীও জানালেন এমনটাই।

‘রামপালের প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে অত্র এলাকা এবং সুন্দরবনের ওপর পরিবেশগত প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে, সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের রামপালে এ ধরণের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে পরবর্তী কুড়ি বছরের মধ্যে এই এলাকার পানি, বাতাস ও মাটি চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

গবেষক বলছেন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষতিকর পরিবেশগত প্রতিক্রিয়ায় এই এলাকার পানির শতভাগ, বাতাসের শতকরা নববই ভাগ এবং মাটির শতকরা পয়ষট্টি ভাগ দূষিত হয়ে পড়বে। মাটির লবনাক্ততা এবং  পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যমান স্বাভাবিক অবস্থায় পানি ও মাটির ক্ষেত্রে কুড়ি বছর পরে এই দূষণ হতে পারে শতকরা কুড়ি ভাগ করে এবং বাতাসের ক্ষেত্রে হতে পারে শতকরা পনের ভাগ মাত্র।

তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য, কয়লা ধোয়া পানি, কয়লার ভেতরে থাকা সালফার, লোহাসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদান এবং কেন্দ্র থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের মতো বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস থেকে এ সব দূষণ সৃষ্টি হবে। ফলে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের জীব বৈচিত্রসহ এলাকার মানুষের কৃষি ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীও। অন্যদিকে পরিবেশ ঝুঁকি হ্রাস করতে অর্থ ব্যয় করা হলে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে।

রামপালের এই কয়লাভিত্তিক এ কেন্দ্রটি খুলনা শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার ও মংলা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে। এমনকি সুন্দরবন থেকেও ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮০  কোটি মার্কিন ডলার। উভয় দেশের সমান মালিকানায় এ কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ শেষ হবে ২০১৫ সালে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি করা কয়লার মূল্য টন প্রতি ১০৫ মার্কিন ডলার হলে ইউনিট প্রতি দাম পড়বে ৫ টাকা ৯০ পয়সা। আর কয়লার দাম যদি ১৪৫ মার্কিন ডলার হয় তা হলে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম পড়বে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা।

এছাড়া পরিবেশগত বিরুপ প্রভাবের ব্যাপারে ড. হারুন আরও বলেন, রামপালের প্রস্তাবিত প্রকল্পে দূষণ প্রতিরোধের জন্য ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানি যে ‘আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল মেথড’ ব্যবহারের কথা বলছে তা সঠিক নয়। কারণ ভারতে এখনও এই পদ্ধতি ব্যবহার হয়নি। সেখানে ২০১৭ সালে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর  প্রস্তাব করা হয়েছে মাত্র। উন্নত বিশ্বেও এ পদ্ধতি এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। তাই এ ধরণের একটি অনিশ্চিত ও পরীক্ষামূলক পদ্ধতি আমাদের দেশের জন্য আরও বড় পরিবেশ ঝুঁকির কারণ হতে পারে বলে মত দেন তিনি।

সরকার এই প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট এ্যানালাইসিস) সম্পর্কে জানগণকে জানতে না দিয়ে গোপনে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। এ ধরণের একটি বিশাল প্রকল্পের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক (ইকোনমিক্যাল) পরিবেশ যাচাই করাই সব না। ভৌত (ফিজিক্যাল), জৈব (বায়োলজিক্যাল) ও সামাজিক (সোশ্যাল) পরিবেশও যাচাই করা প্রয়োজন। কিন্তু সরকার এ সব বিষয় কৌশলে এড়িয়ে ভারতের সঙ্গে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

এই উদ্যোগের বিপরীতে উচ্চ আদালতে দায়ের করা তিনটি রিট পিটিশনও অগ্রাহ্য করেছে সরকার।
আমরা জানি সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীব-বৈচিত্রে জন্য বাংলাদেশের গর্ব। বাংলাপিডিয়ার তথ্যানুসারে সুন্দরবনের আদি বিস্তৃতি ছিলো ১৬ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে যার মাত্র তিন-ভাগের একভাগ অবশিষ্ট আছে। বাংলাদেশে সুন্দরবনের বর্তমান বিস্তৃতি (৪০% এলাকা ভারতে) প্রায় ৪ হাজার ১১০ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে ১ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার জলমহাল।

ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালের ৭ ডিসেম্বর জীববৈচিত্রের জন্য সুন্দরবনকে ‘ওয়ার্লড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করে। বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ৩০ আগস্ট ১৯৯৯ অপরিকল্পিত কার্যকলাপের কারণে সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্টের চতুর্দিকে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে। ওই ঘোষণার আলোকে নিষিদ্ধ হয়েছে ১) প্রাকৃতিক বন ও গাছপালা কাটা ও আহরণ, ২) সবধরনের শিকার ও বন্যপ্রাণী হত্যা, ৩) বন্যপ্রাণী ধরা ও সংগ্রহ, ৪) প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংস বা সৃষ্টিকারী সব ধরণের কার্যকলাপ, ৫) ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট ও পরিবর্তন করতে পারে এমন সব কাজ, ৬) মাটি, পানি, বায়ু এবং শব্দ দূষণকারী শিল্প বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতিকারক যে কোনো প্রকার কার্যাবলী। ’

কিন্তু বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার সাপমারী ও কাটাখালী মৌজায় প্রায় ৪ হাজার একর জমির ওপর যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা’ সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের সীমানার মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে পড়ে, তাই ওই আদেশ অনুযায়ী এই প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু সরকার সুন্দরবনের পরিবেশগত দিক বিবেচনা না করে সেখানে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করলে এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সমগ্র বনের ওপরই। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবনের গাছপালাসহ সব ধরনের জীব-বৈচিত্র পড়বে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, সরকার পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে সুন্দরবনের মাত্র ৩ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব পড়বে বনের গাছগাছালি, পশুপাখি, মাছসহ সব ধরনের জীব-বৈচিত্রের ওপর। বিদ্যুৎকেন্দ্রের গরম পানি, কয়লা পোড়ানো ছাই ও কালো ধোঁয়া সুন্দরবনের অবশিষ্ট সব জীব-বৈচিত্র ধ্বংস করে ফেলবে।

বাপার প্রতিবেদনে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ৫০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ফলে অন্তত ৩৭ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড, ১০ হাজার টন সালফার ডাই-অক্সাইড, ১০ হাজার ২০০ টন নাইট্রোজেন অক্সাইড, ২২০ টন হাইড্রো কার্বন, ৭২০ টন কার্বন মনো-অক্সাইড, ১৭০ পাউন্ড  পারদ, ২২৫ পাউন্ড আর্সেনিক, ১১৪ পাউন্ড সিসাসহ অন্যান্য বিপুল পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপুল পরিমাণ ছাই ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ বাতাস, ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূ-গর্ভস্থ  পানি দূষণ করে।

এসব দিক বিবেচনায় রেখে বাগেরহাট তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে উপযুক্ত শোধনাগার না থাকলে তা বৃহত্তর সুন্দরবনের জন্যই  কাল হয়ে দাঁড়াবে। অন্যদিকে সরকার বলছে, সব ধরনের পরিবেশগত দিক রক্ষা করেই বাগেরহাটে ওই তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এতে সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্রর ক্ষতি হওয়ার কোনো কারণ নেই।

বাগেরহাটের রামপাল সংলগ্ন এলাকা বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত সুন্দরবনের অংশ। সুন্দরবনের কাছে এ ধরনের তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হবে বলে মতামত দিলেও পিডিবির চেয়ারম্যান বলেছেন, এ কেন্দ্র  পরিবেশের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ হবে না। তিনি আরো বলেন, এ কেন্দ্র থেকে কয়লা পোড়ানোর ফলে যে ‘অ্যাশ’(ছাই) বের হবে তা ‘ক্যাপচার’ করার জন্য উচ্চ ক্ষমতার সরঞ্জাম ব্যবহার করা হবে।

সরকারি এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের সঙ্গে  স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, রামপালের কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে  প্রথম পর্যায়ে ৫০০-৬৬০ মেগাওয়াট করে দুই ইউনিটে ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এ জন্য অধিগ্রহণ করা হবে প্রায় ১৮০০ একর জমি। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রর কাজ সম্প্রসারণ করে উৎপাদন করা হবে আরো ১৩০০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হবে বড় পুকুরিয়ার কয়লা। এ কয়লা মংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে মালবাহী জাহাজে আনা-নেওয়া করা হবে। বাগেরহাটের পশুর নদের তীরে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে এর বিষাক্ত  কালো ধোঁয়া আচ্ছন্ন করে ফেলবে সুন্দরবন এলাকার নির্মল আকাশ। চিমনি দিয়ে উগরানো ছাই বিস্তীর্ন এলাকার বাতাসে  ঘটাবে মারাত্মক দূষণ। কারখানাটির কার্বন, পারদ, সিসা, আর্সেনিকসহ নানা বর্জ্য সরাসরি দূষিত করবে নদীনালার পানি।

ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাবে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনের সব সৌন্দর্য। একে একে মারা পড়বে সব গাছপালা। শেষ হয়ে যাবে বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বনের সব পশুপাখি ও জলজ প্রাণী।

পরিবেশবিদ মু. ইনামুল হক বলেছেন, কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে একটি লাল ক্যাটাগরির স্থাপনা, যা’ নির্মাণ করার আগে বাংলাদেশ পরিবেশ আইন ১৯৯৫-এর ধারা ১২ এবং পরিবেশ আইন বিধিমালা ১৯৯৭-র ধারা ৭-এর ৪ ও ৬ (ঘ) উপধারা অনুযায়ী যেসব ছাড়পত্র প্রয়োজন তা’হলো, ১) সম্ভাব্যতা সমীক্ষা রিপোর্ট, ২) প্রাথমিক পরিবেশ পরীক্ষা বা পরিবেশ অভিঘাত যাচাই রিপোর্ট, ৩) শিল্পের লেআউটে বর্জ্য শোধন স্থাপনা, ৪)প্রসেস ফ্লো ডায়াগ্রাম, ৫) পরিবেশ ব্যবস্থাপনা প্ল্যান, ৬) স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে অনাপত্তিপত্র, ৭) প্রতিকূল পরিবেশ এবং পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে জরুরি ব্যবস্থা ও স্থানান্তর ব্যবস্থা, ৮) ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি।

যদিও বাংলাদেশ সরকার জলাভূমি রক্ষায় ‘রামসার কনভেনশন ১৯৭১’ এবং জীববৈচিত্র রক্ষায় ‘রিও কনভেশন ১৯৯২’ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক আইনগুলো স্বাক্ষর করেছে এবং সে কারণে বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েনটিস্টসের হিসাবে কয়লাচালিত ৫০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের যেসব হুমকি সৃষ্টি করে, তাহলো, ১) এই কেন্দ্র থেকে বছরে ৩.৭ মিলিয়ন বা ৩৭ লাখ টন কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গত হয়, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ায়, ২) ১০ হাজার টন সালফার-ডাই অক্সাইড নির্গত করে, যা এসিড বৃষ্টি সৃষ্টি করে, ৩) ১০ হাজার ২০০ টন নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গত করে, যা’ বাতাসে ধোঁয়াশা তৈরি করে, ৪) ৭২০ টন কার্বন মনোক্সাইড নির্গত করে যা’ মাথাব্যথা এবং হৃদরোগ সৃষ্টি করে, এবং ৫) ৫০০ টন ক্ষুদ্রকণা, পারদ, সিসা ইত্যাদি নির্গত হয় যা’ ফুসফুসের ক্ষতি করে ও ক্যান্সার হয়।

এতদসত্ত্বেও জ্বালানি নিরাপত্তার নামে সারাদেশে এভাবে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনা পরিবেশ ও মানুষের ক্ষতি তো করবেই, জাতিসংঘ ঘোষিত ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’-এর জীববৈচিত্র ও পরিবেশের ভারসাম্য  রক্ষা করে ’টেকসই উন্নয়ন’-এর লক্ষ্য অর্জনও সম্ভব হবে না।

এত সব ক্ষতির মুখে তাহলে কি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্ভাবনা না সঙ্কট এই প্রশ্ন এখন সবার। এই অবস্থায় কার স্বার্থে আমরা সুন্দরবন ধ্বংসের আরো একটি উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। আসুন আমাদের স্বার্থে আমাদের পরিবেশকে আমরাই রক্ষা করি।

বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনকে রক্ষা করি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ও যুগ্ম সম্পাদক, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন

বাংলাদেশ সময়: ১১৫২ ঘণ্টা,নভেম্বর ২৩, ২০১২
সম্পাদনা: রাইসুল ইসলাম,নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।