ঢাকা: দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে লাশের সারি। আর কত লাশ যোগ হলে বন্ধ হবে এ মৃত্যু উপাখ্যান? জবাব নেই তার।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানায় সংঘটিত দুর্ঘটনার ইতিহাসে যোগ হলো আরও একটি নাম-‘নিশ্চিন্তপুর ট্রাজেডি’। নিভে গেলো শতাধিক গার্মেন্টস কর্মীর প্রাণ।
আমাদের দেশে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই কর্তৃপক্ষ বলে থাকেন, ‘এ বিষয়ে যথাযথ আইন নেই। ’ ঘটনা ঘটার পরপরই কর্তৃপক্ষ লেগে যায় আইন প্রণয়ন করতে। যেনো আইন প্রণয়নই সরকারের একমাত্র কাজ। কিন্তু আইন থাকলেই এদেশে সব সমস্যার সমাধান হয় না। পাশাপাশি প্রণয়ন করা আইন প্রয়োগ নিয়েও কারো মধ্যে নেই মাথা ব্যথা।
সর্বশেষ নিশ্চিন্তপুরের ঘটনাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সেখানেও আইন ছিলো, কিন্তু আইনের প্রয়োগ ঘটেনি।
২০০৬ সালে পোশাক শিল্পে ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলে সরকার একটি আইন প্রণয়ন করে। তখনও কিন্তু অজুহাত ছিলো আইনের অভাবে সরকার অনেক কিছুই করতে পারছে না। যদিও পোশাক শিল্প ও অন্যান্য শিল্পে শ্রমিক স্বার্থ নিয়ে আইন এর আগেও ছিল।
২০০৬ সালের আইনের মাধ্যমে শ্রমিক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ২৫টি ভিন্ন ভিন্ন আইন রহিত করে একটি সমন্বিত আইন করা হয়। সন্দেহ নেই এটি ভালো উদ্যোগ, কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো এ আইনের প্রয়োগ নিয়ে। কারণ, ২০০৬ সালে আইন প্রনীত হলেও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে পরিস্থিতিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। তারও আগে এ ব্যাপারে ১৯৯৭ সালে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন তারও বাস্তবায়ন হয়নি।
তবে আইনটির উদ্দেশ্য ছিলো অনেক ব্যাপক। প্রস্তাবনার মধ্যে শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও চাকরির অবস্থা ও পরিবেশ নিয়ে বিস্তারিত বিধান সংযুক্ত করা হয়েছিলো। কিন্তু এতো কিছুর পরও শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি ছিলো অনেকটাই উপেক্ষিত।
আইনে আছে, যেকোনো নিয়োগকর্তা তার কারখানাতে শ্রমিক নিয়োগ করার সময় শ্রমিকদের নিয়োগপত্র ও ছবিসহ পরিচয়পত্র প্রদান করতে বাধ্য। কিন্তু বাস্তবে কয়টি পোশাক কারখানা শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান করে, সে হিসেব জানা নেই কারও।
এছাড়া নিয়োগপত্র বা পরিচয়পত্র দেওয়া হল কিনা, তা দেখভাল করার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষও নেই দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া।
নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র না থাকার কারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কতজনকে মরতে হলো তা নিয়ে প্রতিবারই সৃষ্টি হয় রহস্যের। আর প্রতিটি দুর্ঘটনার পর বাস্তবতার ধারে দিয়েও যায় না মালিক পক্ষের বক্তব্য।
অন্যদিকে, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য আইনে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হলেও তা কার্যত অনুপস্থিত। আসলে শ্রম আইনের পঞ্চম অধ্যায়ের (স্বাস্থ্য বিষয়ক বিধান) কোনো বিধানই কখনও পুরোপুরি প্রয়োগ করা হয়না। শ্রমিকদের উপর পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শ্রম আইনের সবচেয়ে অবহেলিত ও অঅনুসারিত বিধানগুলো হলো স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক বিধান। আইনটির পঞ্চম (স্বাস্থ্য) ও ষষ্ঠ (নিরাপত্তা) অধ্যায়ের বিধানগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করলে দুর্ঘটনার হার অনেক কমে যেতো, একইভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমানও কমতো অনেকখানি। লাভবান হতো মালিক ও শ্রমিক উভয়ই পক্ষই।
এ আইনে স্বাস্থ্য বিষয়ক ধারাগুলো (পরিচ্ছন্নতা, বায়ু চলাচল, ধূলা-বালি, ধোঁয়া, বর্জ্য অপসারণ, কৃত্রিম আর্দ্রকরণ, আলো, বিশুদ্ধ পানি ইত্যাদি) আমাদের দেশের হাতে গোনা কয়েকটি কারখানাই শুধু অনুসরণ করে থাকে।
দুঃখজনক হলেও এগুলোতে নজরদারি করার জন্য যেনো কেউ নেই। আইনে কারখানার নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয় তদারকির জন্য একজন পরিদর্শকের থাকার কথা হলেও সে পরিদর্শকের উপস্থিতি কোনো শ্রমিক তার কর্মস্থলে কখনও দেখেছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এছাড়া প্রত্যেকটি কারখানার নিজস্ব একজন পরিদর্শক থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনো পরিদর্শকেরই দর্শন মেলা ভার।
আইনের নিরাপত্তা বিষয়ক ধারাগুলোতে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পরিদর্শকের নিকট মনে হয় প্রতিষ্ঠানের কোনো বিষয় জীবন ও নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক, তাহলে তিনি কর্তৃপক্ষকে যথাযথ নির্দেশনা দিতে পারবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো পরিদর্শক আসলে আছেন কি না অথবা তিনি কারখানা পরিদর্শনে আসেন কি না। ’ পরিদর্শন নিয়ে এ প্রশ্নটি তুলেছেন সরকার সমর্থিত শ্রমিক জোট নেত্রী শিরীন আকতার।
তবে সরকারের পাশাপাশি বিজিএমইএ’রও ৪০টির মতো পরিদর্শন টিম রয়েছে। কিন্তু এ টিমগুলোর কার্যকর ভূমিকা আমরা দেখতে পাইনা। যদি পরিদর্শক টিমগুলো ঠিকভাবে কাজ করতো তবে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বেচেঁ যেতো আমাদের শ্রমিকরা।
অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে এ আইনে বেশ কিছু বিধান আছে। কিন্তু আইনের বিধান থাকলেও বাস্তবে তার কোনো তোয়াক্কা না করেই গড়ে উঠছে একের পর এক কারখানা। ফলে আপাত কিছু ভূইফোর পোশাক শিল্প মালিকের উত্থান হলেও আদতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের পোশাক শিল্প। বহির্বিশ্বে বিতর্কিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এ শিল্পটি।
আইনে আছে ‘অগ্নিকাণ্ড বা যেকোনো দুর্ঘটনা থেকে বাচাঁর জন্য কারখানার প্রত্যেক তলা থেকে নামার জন্য বিকল্প সিড়ি বা বর্হিগমনের পথ থাকতে হবে, উপযুক্ত অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জামাদির ব্যবস্থাও থাকতে হবে। ’
তাজরিন গার্মেন্টসে যদিও বলা হয় যে বিকল্প সিড়ি ছিল, কিন্তু আসলেই বিকল্প সিড়ি ছিল কী না ও অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জামাদি কার্যকর ছিল কী না, তা যথাযথ তদন্তেই বের হয়ে আসবে।
বেচেঁ যাওয়া অনেক শ্রমিক অভিযোগ করেছেন কারখানার বের হওয়ার প্রধান দরজাটি আগুন লাগার সময় বন্ধ ছিল। পরে সেটি ভেঙ্গে শ্রমিকদের বের করে আনা হয়।
কর্মকালীন সময়ে গেট বন্ধ রাখা আমাদের পোশাক কারখানার একটি স্বাভাবিক চিত্র। বাংলাদেশের অধিকাংশ কারখানায় একই চিত্র, যা আইনের পুরোপুরি লংঘন। কিন্তু তারপরও ওইসব কারখানাকে কমপ্লায়ান্স বলে দাবি করে আসছেন তারা।
তাজরিন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের সময় ফায়ার এলার্ম বেজে উঠেছিল কিন্তু তারপরও বিভিন্ন ফ্লোরের ম্যানেজাররা শ্রমিকদের বের হতে দেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন বেচেঁ যাওয়া শ্রমিকরা। এটি আইনের ৬২(৫) ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইতিপূর্বে এ কারখানাটিকে কমপ্লায়ান্সের দিক থেকে ‘কমলা’ রঙের শ্রেণীভূক্ত করেছিলো একটি বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। এর মানে হচ্ছে কারখানাটি কমপ্লায়ান্সের দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ।
এরপরই হচ্ছে ‘লাল ক্যাটাগরি’, যার মানে হলো কারখানাটি ‘নন কমপ্লায়ান্স’ শ্রেণীর মধ্যে পড়ে। তাই তাজরিন গার্মেন্টসকে পুরোপুরি কমপ্লায়ান্স ক্যাটাগরিতেও ফেলা যায়না।
তবে বাস্তবতা হলো বিদেশী ক্রেতারা যখন কারখানা পরিদর্শন করেন, তখন প্রায় সব কারখানাই কমপ্লায়ান্স হয়ে যায়। কিন্তু ক্রেতা চলে গেলেই আবারও সেই পুরোনো দশা।
আমাদের দেশে ‘কমপ্লায়ান্স’ বিষয়টি দাঁড়িয়েছে শুধু বায়ারদের খুশি করার একটি উপায় হিসেবে। কারখানা শ্রমিকদের সার্বিক কল্যাণের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
কম্প্লায়ান্সের দুটি দিক আছে, সামাজিক (social compliance) ও প্রযুক্তিগত দিক (Technical compliance)। আমাদের কারখানাগুলো প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনেকটাই কমপ্লায়ান্স হলেও সামাজিক কম্প্লায়ান্সের দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে আছি আমরা। দেশে শতকরা আশি ভাগ ক্ষেত্রে সামাজিক কম্প্লায়ান্স নীতি অনুসরন করা হয়না। কারণ এটি শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। টেকনিক্যাল কম্প্লায়ান্স যেহেতু বিদেশী বায়ার সংশ্লিষ্ট তাই সেক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য আছে।
বিজিএমইএ ২০০৫ সাল থেকে পোশাক কারখানার জন্য একটি পৃথক স্থান নির্ধারনের কথা বললেও সরকার আজো তা করতে পারেনি। ফলে যত্র যত্র বেড়ে উঠছে কারখানা। বিল্ডিং কোডের কোনো ধারই ধারছে না কারখানার মালিকপক্ষ।
এছাড়া বছর দুয়েক আগেও নিমতলীতে আরেকটি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে শতাধিক। তারপর হামিম গ্রুপ ও সাভারের আরেকটি কারখানায় দুর্ঘটনা আমাদের একই কথা জানান দেয়।
গামেন্টস কারখানায় অগ্নি নির্বাপনের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। কিন্তু এ মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকার তালিকায় অগ্নিনির্বাপন সপ্তম স্থানে। এর আগে আরো ছয়টি অগ্রাধিকার রয়েছে। তাই যৌক্তিক কারণেই এ দায়িত্বটি অনতিবিলম্বে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে হস্তান্তর করা প্রয়োজন।
তবে সবচেয়ে বড় কথা, এক্ষেত্রে একটি পূর্ণাঙ্গ গর্ভনেন্স (comprehensive governance)প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তা না হলে শুধু আইন দিয়ে হবে না। আইনের যথাযথ প্রয়োগ লাগবে। আইনের লঙ্ঘন যারা করছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। ‘কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়’-তিনি যত মহাশক্তিধর মালিকই হোন না কেন।
জীবনে যারা সব অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে অন্তত ছাই হয়ে যাওয়া সেই মানুষগুলোর প্রতি আমরা যেন সুবিচার করতে পারি, এটাই কামনা। আজকের দিনটিই যেন হয় পোশাক কারখানায় দুর্ঘটনার জন্য পালিত শেষ শোক দিবস।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১২
সম্পাদনা: রাইসুল ইসলাম,নিউজরুম এডিটর