পোশাক কারখানায় আগুনে দগ্ধ হয়ে নিহতের ঘটনা এই প্রথম নয়। একটি ইংরেজি দৈনিকের সূত্র মতে ,১৯৯০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৩৩ টি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছে কমপক্ষে ৫০০ শ্রমিক।
বিজিএমএ ও বিভিন্ন সংগঠনের দেওয়া তথ্য মতে, গত দুই দশকে আগুনের ঘটনায় অন্তত ৭০০ শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শনিবারের আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনের মর্মান্তিক ঘটনায় এতো বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের প্রাণহানি আমাদের অমিত শোকস্মৃতিকে আরেকবার জাগিয়ে দিয়ে গেল। এ ঘটনার অগ্নিদগ্ধ হয়ে আরও শত শত মানুষ জীবনীশক্তি হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করল। অসংখ্য নিখোঁজের সন্ধান আজও মেলেনি।
পত্রিকার তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০১০ সালে গার্মেন্টসের এ ধরনের দুটি অগ্নিকাণ্ডে গাজীপুরের গরীব অ্যান্ড গরীব সুয়েটার ফ্যাক্টরিতে ২১ জন শ্রমিক মারা যান। একই বছরে ১৪ ডিসেম্বর আশুলিয়ায় হামীম গ্রুপের কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যান ৩০ জন। ২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্রগ্রামের কেটিএস কম্পোজিট টেক্সটাইলে আগুন ধরলে পুড়ে ভস্ম হন ৯১ জন শ্রমিক। ওই বছরে গাজীপুরের যমুনা স্পিনিং মিলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হন আরও ছয়জন। একই বছরের মার্চে সায়েম ফ্যাশনে আগুনে ৩ মহিলা শ্রমিক নিহত হন। ২০০৪ সালে নরসিংদির এক কারখানায় আগুন লেগে প্রাণ হারান ৪৮ শ্রমিক। ২০০১ সালে ৮ আগস্ট ঢাকার মিরপুরে মিকো সুয়েটার লিমিটেডে আগুন ধরার গুজবে ভিড়ে পায়ের নিচে চাপা পড়ে নিহত হন ২৪ গার্মেন্টস শ্রমিক। এর সপ্তাহখানেক আগে মিরপুরে কাফরুলে অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন আরও ২৬ শ্রমিক। ২০০০ সালের নরসিংদি চৌধুরি নিটওয়ার অ্যান্ড গার্মেন্টস লিমিটেডে এ ধরনের ঘটনায় নিহত হন ৫৩ শ্রমিক। এভাবে মৃত্যুর তালিকা বছরে বছরে বাড়তে থাকে। প্রতিটি ঘটনায় প্রত্যক্ষ করা যায়, প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি-বিরোধী দলের নেতার শোকবাণী, ফায়ার ব্রিগেডের উদ্ধার তৎপরতার রোমাঞ্চকর কাহিনী, ক্ষতিপূরণের নামে মালিক পক্ষের উদারতা প্রকাশের মেকি তৎপরতা।
অন্য দিকে দেখা যায়, থরে থরে সাজানো লাশের মাঝে স্বজন-প্রিয়জনদের শোকের মাতম-আহাজারি। পোড়া লাশের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। চোখের সামনেই মূর্তিমান অভিশপ্ত মৃত্যুপুরী। অনি:শেষ ট্র্যাজিক নাটক যেন চলতেই থাকে। কে বলবে তাজরীন ফ্যাশনের এই বিষাদময় ঘটনাই হবে শেষ ঘটনা! কেন এই মৃত্যু? মৃত্যুর কারণ যে, সস্তাশ্রমের ব্যাপারী মালিকদের সীমাহীন অবহেলা আর মুনাফার অত্যধিক লালসা এটা কে না জানে! এ প্রশ্নের জবাব পেতে কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। অধিকাংশ কারখানাগুলোয় শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। কারখানার নিচ তলায় গোডাউন, অপ্রশস্ত সিঁড়ি, জরুরি নির্গমনপথের অভাব, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের অপ্রতুলতা, বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা, নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সবসময় তালা লাগিয়ে রাখা, শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, নির্দয় ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। দীর্ঘ দিন ধরে বলে এলেও এসবকে থোড়েই কেয়ার করে মালিকপক্ষ। স্বয়ং ক্রেতা দেশগুলো কমপ্লায়েন্সের শর্ত জুড়ে দিলেও কাজের কাজ যে খুব একটা হয়নি তা তাজরীন ফ্যাশনের ঘটনায় আরেকবার প্রমাণিত হলো। তাজরিন ফ্যাশনের ঘটনায় নিমিষেই অর্থগৃধ্নু কাপালিকের স্বার্থের বেদীতলে বলিদান হলো শতাধিক জীবন। সারা পৃথিবীর মানুষ মালিকদের উদগ্র স্বার্থ আর নিষ্ঠুরতার আগুনে পুড়তে দেখলো অসহায় মানবতাকে। সেই সঙ্গে পুড়লো বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও। কিছুদিন আগেও রামুর বৌদ্ধমন্দির-বসতি পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় সভ্য বাংলাদেশের মুখটিকে আরেকবার পুড়তে দেখেছিল বিশ্ববাসী।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের মালিকদের বিবেক, মানবতা অনেক আগেই পুড়ে গেছে বলে একের পর এক কারখানায় মানুষ পুড়ছে। বিবিকের তাড়নায় সাড়া দিয়ে যদি মালিকরা যথাযথ ব্যবস্থা নিত তাহলে এধরণের বিষাদময় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতো না। আর সরকারের আইন সে তো কাগজ, ঘুষ আর দুর্নীতির নিগড়ে বন্দি। সরকারের কারখানা পরিদর্শন বিভাগ কাগজে কলমে। প্রত্যেক কারখানায় অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশ ছিল। কয়টা কারখানায় তা পালন করা হয়েছে? ম্যানেজ মানির জোরে সব কিছু ম্যানেজ করা যায়। লাইসেন্স, ছাড়পত্র পাওয়া যায়। তা না হলে এসব ঘটনা প্রতিরোধে আইন কড়াকড়িভাবে কার্যকর হতো। আইন এখন অসাধুর পকেটবন্দী, অপরাধীর হুকুমাত তালিমে ব্যস্ত। টাকা দিয়ে ক্ষমতাবানেরা সবকিছুই কিনে নিতে পারে। আজ থেকে ১৫ বছর আগে যখন পোশাক কারখানায় একের পর এক ঘটনা বেশুমার প্রাণহানির ঘটনা ঘটলো তখনই আইন করা হয়েছে, প্রত্যেক কারখানায় অগ্নিনির্বাপনের সুবন্দোবস্ত থাকবে, জরুরি বহির্গমন পথ থাকবে, পর্যাপ্ত জলাধারের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকদের উপযুক্ত কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের বা তদারকির উদ্যোগ নেওয়া হলো না। আসল কথা ক্ষমতা আর টাকার জোরে চলে নীতি-নৈতিকতারও বিকিকিনি। টাকা আর ক্ষমতা থাকলে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো যায়। তা না হলে বেগুনবাড়ির সরকারি জমিতে শহরের বর্জ্য ও পানিপ্রবাহকে রোধ করে বিজিএমএ ভবন কোন ঔদ্ধত্যে দাঁড়িয়ে আছে?
পোশাক কারখানায় একের পর মৃত্যুর ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অবজ্ঞা, অবহেলা আর খামখেয়ালির কারণে কারো মৃত্যু হলে তাকে কি হত্যা বলা যায় না? তাজরীন ফ্যাশনে আগুন লাগাল, সতর্কঘণ্টা বাজলে তা বন্ধ করে দেওয়া হলো। কিছুই হয়নি বলে কাজে ফিরে যেতে বাধ্য করা হলো। জীবন রক্ষার জন্য শ্রমিকদের নিচে নামতে দেওয়া হলো না। মালামাল লোপাট হবে ভেবে বের হওয়ার পথগুলোতে তালা লাগিয়ে দেওয়া হলো। অগ্নিকুণ্ডে শতশত মানুষকে অবরুদ্ধ করা হলো। এটাকে কি বলবো দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকাণ্ড? এতো বেশি সংখ্যক শ্রমিক পুড়ে ছাই হলো। কই কারখানা উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা মালিক পক্ষের কাউকে তো ঝলসে যেতে দেখলাম না। তবে কি মানুষের জীবনের চেয়ে মালামালের মূল্য মালিকের কাছে বেশি?
মৃতদেহ সরিয়ে, ভস্ম পরিষ্কার করে, দেয়ালের গায়ে সুরকি চুন লাগিয়ে, আমদানিকৃত অত্যাধুনিক মেশিনে কারখানাটি হয়তো আবার চালু হবে। মুনাফার টাকার স্বাদ মালিক আবার পাবে; কিন্তু হারানো গরীব মানুষের একটি জীবনও তো আর ফিরে আসবে না। এ ঘটনায় যারা দগ্ধ হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করলো, তাদের জীবনের কর্মক্ষমতা কি তারা ফিরে পাবে? বেঁচে থেকে সমাজের র্ভৎসনা আর গ্লানির আগুনে মৃত্যু অবধি তাদের জ্বলতে হবে। পা হারিয়ে কিশোর বয়সে কাউকে হয়তো ভিক্ষার থালা হাতে পথে নামতে হবে। মায়ের বুক থেকে সন্তান হারানোর দুঃসহ বেদনা, স্বামীহারা স্ত্রীর নিঃসঙ্গতা, পিতাহার সন্তানের সীমাহীন অনিশ্চয়তাকে কি দিয়ে পূরণ করা যাবে।
এই গরীব মানুষদের জীবনের মূল্য কত? বেঁচে থেকেও এরা মূল্য পায়নি। সস্তায় নিজেদের বিক্রি করতে হয়েছে। মরণের পরও তাদের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ টাকা। মালিকের কারখানার প্রতিটি মেশিনের বীমা থাকলেও এদের জীবন এতটাই মূল্যহীন যে, কোনো কোম্পানি এদের বীমা করতে এগিয়ে আসে না। বেঁচে থেকে এরা যে জীবন কাটিয়েছে তা কি মানবিক ছিল? যা বেতন পেত তা দিয়ে কি জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো মেটাতে পারতো? অথচ এদের ঘাম, রক্তপানিকরা কঠোর শ্রমের ওপরই জৌলুস আর প্রাচুর্যের পাহাড় গড়ে উঠেছে। মালিকদের একটি থেকে দশটি কারখানা হয়েছে, গাড়ির মডেল পাল্টেছে বারবার। কিন্তু শ্রমিকদের দুঃখ-দুদর্শার রূপ পাল্টায়নি এতটুকু। এদের জীবন সেই পোকা-মাকড়ের জীবনের মতো রয়ে গেছে।
স্বাধীনতার ৪০ বছরে এদেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারছে না এ রাষ্ট্র। এ দায় কার? গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের বন্দর নগরী করাচিতে গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে ২৮৯ জন নিহত হলে সিন্ধু প্রদেশের শিল্পমন্ত্রী আব্দুর রউফ পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি জানান, এ ধরনের দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী কখনই ইস্তফা দেন না বলে পাকিস্তানে যে ধারণা রয়েছে তিনি তা ভাঙতে চান। পাকিস্তানের শিল্প ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক এই দুর্ঘটনার কারণ বের করার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ঘটনায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিতে চরম উদাসীনতার অভিযোগে পুলিশ বাদি হয়ে মালিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা পর্যন্ত দায়ের করে। বাংলাদেশে কি এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে না? অসহায়, ব্রাত্যজনের পক্ষে রাষ্ট্রকে কবে দেখবো আমরা? এ দেশ কার? গুটিকয় হৃদয়হীন মুনাফলোভী ব্যবসায়ীর, নাকি গরীব-দুঃখী অসংখ্য অসহায় মানুষের?
লেখক: আশরাফুল আযম খান
সহযোগী অধ্যাপক
ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ
ই-মেইল: asrafshebu@gmail.com;
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর- eic@banglanews24.com