বাংলাদেশের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জাতিগত বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম। প্রায় ১৩,২৯৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তন জুড়ে এ অঞ্চলটি নানান দিকে থেকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, যা দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভিন্নতার দাবি রাখে।
এই পাহাড়ে বসবাস করে ১১টি আদিবাসী জাতি গোষ্ঠী বসবাস করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস চিরকালই বঞ্চনার ইতিহাস। প্রাক-ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত তাদের তাদের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করতে হয়েছে।
দেশ স্বাধীন হওযার পর থেকে তাদের অবিসাংবাদিত নেতা তৎকালীন জাতীয় সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পাহাড়ি জনগণ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে।
স্বাধীন রাষ্টের প্রথম সংবিধানেও তাদের দাবি উপেক্ষিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সরকার ১৯৭৯ সালে ঐ অঞ্চলে বাঙালি বসতি স্থাপনের এক কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই কর্মসূচি ছিল পার্বত্য জনগণের প্রথাগত জুমিয়া অধিকারের পরিপন্থী ।
তারই ধারাবাহিকতায় পাহাড়িরা সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। দুই দশক ধরে সশস্ত্র সংগ্রামের পর অবশেষে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে পাহাড়ি জনগণের সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করে।
এই চুক্তি দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয় এবং অন্যান্য দেশের এই ধরনের জাতিগত সমস্যা নিরসনে এ চুক্তি একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে পাহাড়ি জনগণের দীর্ঘদিন ধরে চলমান শোষণ-নিপীড়নের অবসান এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের ঐতিহাসিক একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়।
ধরেই নেওয়া হয়েছিল এ চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিবদমান হানা হানি বন্ধ হবে এবং পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি বিরাজ করবে। অনেকে তাই এই চুক্তিকে শান্তিচুক্তি হিসেবে অবহিত করতে শুরু করেন। চুক্তির পরপরই এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা, শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে দেশীয় ও আন্তজার্তিক সংস্থাসমূহ উন্নয়নমূলক কাজ শুরু করে।
চুক্তির সময় পাহাড়িদের মধ্যে একটি গ্রুপ এবং তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি নের্তৃত্বাধীন চার দলীয় জোট চুক্তির বিরোধিতা করেছিল। তবে পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় এসে বিএনপি এ চুক্তি যেমন বাতিল করেনি, তেমনি চুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকরী কোনো উদ্যোগও গ্রহণ করেনি। তবে বর্তমানে পাহাড়ে চুক্তিরবিরোধী কয়েকটি গ্রুপও বিভিন্নভাবে সক্রিয়।
আজ ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৫ বছর পূর্ণ হতে চলছে । দু:খজনক হলেও সত্যি এই দীর্ঘ ১৫ বছরেও এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অতীতের সকল সরকারের পক্ষ থেকেই চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন আছে বলে দাবী করলেও পাহাড়ি জনগণ অনেকেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের হতাশা ও ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন।
প্রাথমিক অবস্থায় চুক্তির পরপরই কিছু শর্ত বাস্তবায়িত হলেও চুক্তির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ অনেক অংশই বাস্তবায়িত হয়নি। চুক্তি বাস্তবায়নের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে যেগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে সেসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জনসংহতি সমিতির সদস্য কর্তৃক অস্ত্র জমা দেওয়া এবং তাঁদের প্রত্যেককে সরকার থেকে ৫০ হাজার টাকা করে প্রদান, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, তিন জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন পাস অন্তবর্তীকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে পাহাড়ি শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনা।
সরকার বলেছে, এদের অধিকাংশ পরিবারকে অর্থনৈতিক সুবিধাদিও দেওয়া হয়েছে। ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্স পুনর্গঠিত হয় এবং সে বছরই সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে “পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১” প্রণীত হয়।
এ যাবৎ মোট চারজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান করে তিন বছর মেয়াদি ভূমি কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার অন্যতম ইস্যু ভূমি বিরোধের নিষ্পত্তি হয়নি। কিন্তু উক্ত ভূমি কমিশন আইনে চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক ১৯টি ধারা অর্ন্তভুক্ত করা হয় যা আজও সংশোধিত হয়নি। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, সংসদের আগামী শীতকালীন অধিবেশনে আইনটি সংশোধনে বিল আনা হবে।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এখন পর্যন্ত জেএসএস-এর ৬৪ জন ও প্রত্যাগত শরণার্থীদের ১৮৪ জনকে সরকারি চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়, ৬৭৫ জনকে পুলিশ কনস্টেবল ও ১১ জনকে ট্রাফিক সার্জেন্ট পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমানে যেমন একদিকে পার্বত্য চুক্তি পাহাড়িদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে, অন্যদিকে চুক্তির ১৫ বছরেও পাহাড়ি এবং অভিবাসী বাঙালিদের দ্বন্দ্বের কোনো সুরাহা হয়নি।
এ সময়ে পাহাড়ে অন্তত ১৫টি বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। পাহাড়িদের অভিযোগ, অভিবাসী বাঙালিরা এখনো নতুন নতুন এলাকায় বসতি গড়ছে। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামকে (পাহাড়ি) উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের স্বীকৃতি দেওয়া এবং এই বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এখন পর্যন্ত আঞ্চলিক পরিষদ কার্য বিধিমালা, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচন বিধিমালা প্রণয়ন ও নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি এবং স্থায়ী বাসিন্দা ভিত্তিতে ভোটার তালিকা প্রণয়ন হয়নি।
পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন না হওয়ায় বিগত সরকারগুলো কর্তৃক পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্য পদে মনোনয়ন দেওয়ার ফলে জনগণের কাছে এসব অন্তবর্তীকালীন পরিষদের কোনো দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নেই। চুক্তি অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবেভাবে নতুন করে চারটি মন্ত্রণালয়ের ৫টি প্রতিষ্ঠান পার্বত্য তিন জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সরকারী মতে, এ নিয়ে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের কাছে ২৩টি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের কাছে ২২টি করে দপ্তর হস্তান্তর করা হয়েছে।
কিন্তু চুক্তি সংশ্লিষ্ট জনসংহতি সমিতির মতে, সম্প্রতি হস্তান্তরিত ৫টি প্রতিষ্ঠানের মূল বিষয় অনেক পূর্বেই তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। তারা মনে করেন, যে সকল বিভাগ জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে সেগুলো অনেকটা গুরুত্বহীন, তার চেয়ে আইন-শৃংখলা, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, পুলিশ, মাধ্যমিক শিক্ষা, বন ও পর্যটন ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ অবিলম্বে হস্তান্তর করা প্রয়োজন। জেএসএস’র মতে প্রায় পাঁচশোর অধিক অস্থায়ী ক্যাম্পের মধ্যে মাত্র ৬৬টি সেনাক্যাম্প সরিয়ে নেয়া হয়েছে। যদিও সরকারি সূত্র মতে এ পর্যন্ত ২০০টি ক্যাম্প প্রত্যাহার হয়েছে ।
পার্বত্য অঞ্চলের সকল চাকুরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ করার বিধান এখনো কার্যকর হয়নি। সার্কেল চিফ কর্তৃক স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের বিধান থাকলেও তা লঙ্ঘন করে সার্কেল চিফের পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদান চালু করা হয়েছে যা চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দেশবাসীর মনে চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে সৃষ্ট সন্দেহ, অবিশ্বাস কিছুটা হলেও দূর হয়েছিল, কারণ এই সরকারেরই তাদের আগের আমলে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল।
এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছিল যেহেতু এটি তাদের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার, তাই তারা পূর্ণাঙ্গ চুক্তিটিই বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেবে। কিন্ত গত চার বছরে চুক্তি বাস্তবায়নের গতি ছিল খুবই শ্লথ, যা পাহাড়ি জনগনকে অনেকটা হতাশ করেছে।
এরই মধ্যে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটি, প্রত্যাগত জুম্ম শরনার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্ভাস্তু পুর্নবাসন সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্স এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন পুর্নগঠন সহ ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সর্বশেষে এই বছর জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমার সাথে বৈঠক করেন এবং চুক্তি বাস্তবায়নে তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
গত ২২ জানুয়ারি চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির যে সভা অনুষ্ঠিত হয় সেখানেও সরকার-সংশ্নিষ্ট সবাই চুক্তি বাস্তবায়নে নানা পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বেশ ক’বার পার্বত্য চট্টগ্রামে সফর করেছেন এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকও করেছেন। এসত্ত্বেও এগুলো পাহাড়ি জনগণকে আশ্বস্ত করতে পারছে না। তারা চায়, চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন।
সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার বলেছেন, সরকার চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করেছে এবং চুক্তির অবশিষ্ট ধারাগুলোও শিগগিরই বাস্তবায়ন করা হবে। এ কথা বলার অবকাশ রাখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্যমান সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধান ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরনে এবং পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। আর সরকার চাইলেই আগামী এক বছরের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে ।
মোহাম্মদ জাহেদ হাসান, উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর eic@banghlanews24.com