বাংলাদেশ ক্রিকেটের অধিকাংশ বাজে দিনের সাথের আমার মন্দ ভাগ্যের চিরায়ত সম্পর্ক। পরিস্কার করে বললে, যেখানে আমি থাকি সেখানে বাংলাদেশ থাকে না, তারা নিচে চলে যায়।
বৈপরীত্যের এই সম্পর্কটা কবে থেকে শুরু হয়েছে, সেটা ভাবতে গেলে ২০০৪ সালে ফিরে যেতে হয়। নিউজিল্যান্ড বাংলাদেশের ওয়ান ডে সিরিজ চলছে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে সাঁজ সাঁজ রব। ভিড় ঠেলে নানা কায়দা কানুন করে ব্ল্যাকে টিকেট কিনে পশ্চিম গ্যালারীতে বসে খেলা দেখছি। ক্লাস নাইনে পড়ি তখন। নির্বিকারভাবে বাড়ি পালিয়ে খেলা দেখার অপরাধের ভয়টা আসন্ন রোমাঞ্চের কাছে হেরে গেল। সারাদিন বাড়ির সাথে কোন যোগাযোগ নেই। কিন্তু সেদিকে কি হচ্ছে ভাবার সময় কই? শুরুতে বাংলাদেশের ব্যাটিং চলছে। এক একটা চার হচ্ছে, উন্মাতাল গ্যালারীভর্তি মানুষের সাথে সাথে ছোট শরীরটা নিয়ে লাফিয়ে উঠছি। অন্য একটা জগতে আমি। অদ্ভুত স্বপ্নময় আর রোমাঞ্চভরা সে জগতে, সবুজ মাঠের জমিনে স্বপ্ন নায়কদের দুইজন দাঁড়িয়ে আছেন ক্রিজের দুই প্রান্তে। তাঁদের কব্জির মোচড়ে যখন উইলো ঘোরে, ঢেউ ওঠে গ্যালারীতে। সময়টা যখন এমন- তখন কি কারও বাড়ি আর বাবা’র লাল চোখের রাঙ্গানি’র কথা মনে থাকে?
তবে সত্যিটা হচ্ছে, সেখানে আমি ছিলাম বলেই হয়তো, স্বপ্নটা বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করতে পারেনি। স্কট স্টাইরিস হঠাৎ করেই রীতিমত বিভীষিকা হয়ে উঠলেন। চমৎকার একটা দিন শুরু করে বাংলাদেশ ২০০ রানের নিচে এসে থেমে গেল। তবুও আশাটুকু বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। এটুকু তো করা যেতেই পারে, দেশটা যে বাংলাদেশ। কিন্তু প্রথম ১২০ রানে কিউইদের কোন উইকেটই পড়লো না। দুই ওপেনার তখনও নির্দয়ভাবে বল মাঠছাড়া করছে। অন্ধকার শুধু আমাদের মনে নয়, মাঠেও যেন নেমে এসেছে। সারাদিন বাসার সাথে যোগাযোগ নেই। বলা যায়, সে ভয়েই মাঠের আঁধার চোখে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। নাহ! হল না। আজকেও হেরে গেলাম।
ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে গেলে অন্তত আমার জন্য খুব ভাল হত। তবে এমনটা হয়নি। বাড়ি ফিরে শুনি, সে ম্যাচটা বড় কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত ৩ উইকেটে জিততে হয়েছে কিউইদের। আফতাব আহমেদ নামের নবীন একজন পাঁচ উইকেট নিয়ে কিউইদের পাঁজরে আঘাত হেনেছিল। যখন আফতাব একের পর পাঁজরভাঙ্গা বলগুলো করছিল,সে সময়টায় গোটা গ্যালারী বুনো হুঙ্কারে মুহুর্মুহু পাগল হয়েছিল। আর সবই হয়েছে আমি ঠিক মাঠটা ছাড়ার পরপর। তাই কিশোর বয়সের সেদিনটায় হয়তো বুঝে গিয়েছিলাম- বাংলাদেশের বেলায় পাশার দানটা ঠিক আমার ঘরে নয়।
দেশের বাইরে থাকার কারণে দীর্ঘদিন মাঠে বসে খেলা দেখা হয় না। মাঝের সময়টায় বাংলাদেশেও ধীর পায়ে সামনে এগিয়েছে। মাঠে বসে খেলা দেখার সুযোগ সচরাচর পাই না। তবে এবার প্রবাসে ঘরের পাশে খেলা। এ বছর জুলাইয়ে বাংলাদেশ এসেছিল হল্যান্ড সফরে। বাংলাদেশের সম্ভাব্য দুর্যোগের আশংকা ভুলে গেলাম। এতোদিনের সংযম ভুলে গিয়ে মাঠে যেতেই হল খেলা দেখতে। ফলাফল যা হল, তা হচ্ছে- বাংলাদেশ অখ্যাত স্কটল্যান্ড আর হল্যান্ডের কাছে অদ্ভুতভাবে দুটি ম্যাচ হেরে গেল। আর যে ম্যাচটায় দেরীতে মাঠে গিয়েছি-শুধু সে ম্যাচটায় বাংলাদেশের একমাত্র জয়। ম্যাচ শেষে মুশফিকুর রহিমের সাথে অল্প কিছুক্ষণের আলাপ হয়। তাঁর মুখ আমার চেয়ে অন্ধকার। নিজেকে দোষী ভাবি। কীই বা দরকার ছিল? মাঠে না গেলেই ভাল হত বোধহয়। কীভাবে কি হল, ঠিক বোঝারই সুযোগ পেলাম না। শুধু ম্যাচ শেষে বাড়ি ফেরার পথে বুঝলাম, পা চলছে না। পা ভারী হয়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে চায়। দিনের আলো পড়ে এসেছিল। জুলাইয়ের শেষ বেলায় সূর্যকে পেছনে রেখে মনে মনে বলেছি, যে মাঠে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল থাকবে, সে মাঠে আমি আর না। কোনদিনও নয়। কোন ধরণের কুসংস্কারে আমি কোনভাবেই বিশ্বাসী নই। তবে আমার সাথে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বৈপরীত্যের সম্পর্কটা ঠিক এমনই, এটা আমি মেনে নিয়েছি।
এবার মুদ্রার উল্টো পিঠের কিছু কথা বলি। ‘গল্প’ না বলে ‘কথা’ এ জন্য বলছি যে- আমার লেখাটার এই অংশটুকুতে বিন্দুমাত্র কোন অতিরঞ্জন নেই। লেখার সৌন্দর্য রক্ষা করতে গিয়ে কোন অমূলক উপমাও এখানে নেই।
২০০৭ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের সময় আমরা কলেজে। ভারতের সাথে প্রথম ম্যাচের দিন হাসপাতাল থেকে খেলার খবর পাচ্ছি। ক্যাডেট কলেজের কঠোর নিয়মের কাছে আপাতভাবে আমরা বন্দী। মাশরাফি যখন সেবাগের প্রথম উইকেট নিল, তখন শুধু শুনলাম সন্ধ্যারাতে পাশের গ্রামটা যেন বিপুল হুল্লোড়ে জেগে উঠলো। রাত বাড়ে, আর এরপর শুধু নিয়মিত বিরতিতে নিভৃত সে পল্লী’র হুল্লোড়ের পাল্লাটা যেন বাড়তে থাকে। দীর্ঘ ছ বছরে আগে কখনো, পাশের এই গ্রামটাকে এভাবে জেগে উঠতে দেখিনি। আমরা তখনও ক্লাসে বসা। কলেজের সিনিয়র মোস্ট ক্লাস। একটা সময় দেখলাম চাঞ্চল্য বাড়ছে। আশ্চর্য শান্ত হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। হঠাৎ পাশের গ্রামটা থেকে আবারো সেই হুল্লোড়। আমরা আর থাকতে পারলাম না। কঠোর শৃঙ্খলা আর নিয়মের শক্ত গলাবন্ধনী আঁটা আমাদের গলাটা হঠাৎ করেই কীভাবে যেন খুলে গেল। ক্লাস খালি হলো মুহূর্তেই। একাডেমী ব্লক ফাঁকা করে দিকশুন্য হয়ে হাসপাতালের দিকে দৌড়াচ্ছি। সেখানে খেলা দেখা যায়। পরে কলেজ প্রশাসন সেই নিয়ম ভাঙ্গাটাকেই বৈধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল। ডিনারের পর হাউসে (হলে) গিয়ে খেলা দেখা। আমার এখনো পরিস্কার মনে আছে, এক একটা উইকেট পড়ছে, আর যেন চারপাশের সব শব্দ থেমে যাচ্ছে। স্টিলের চেয়ারের মধুরতম ঝনঝন শব্দে কাঁপছে চারপাশ। কাঁপছি আমরা।
ক্যাডেট কলেজের অলিখিত স্বীকৃত নিয়মটা হচ্ছে, সবার করা অপরাধে যেহেতু সবাইকে একসাথে শাস্তি দেওয়া সম্ভব নয়, তাই গুটিকয়েককে সে শাস্তি পেতে হয় দৃষ্টান্ত রক্ষার জন্য। খেলার সে রাতে নিয়ম ভাঙার জন্যও গুটিকয়েক ছেলে শাস্তি পেল। সাত কেজি ওজন শেল নিয়ে তাঁদের বিশাল মাঠের চারপাশে চক্রাকারে দৌড়ে বেড়াতে হল। সে জন্য তাঁরা বিন্দুমাত্র দুঃখিত হল না। তাঁরা গভীরভাবে বিশ্বাস করলো, ভারতকে হারিয়ে এমন চমৎকার সব বিজয়ের জন্য তাঁরা আরও সব বিকেলে প্রখর রোদে কাঁধে শেল নিয়ে দৌড়াতে পারে। তাঁদের ঘামের দাম তাঁরা কমিয়ে দিয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে বাংলাদেশ ঘাম ঝরাচ্ছে, এখানে তাঁরা ঘাম ঝড়াবে।
বন্ধুদের কারণে অকারণে ধন্যবাদ দেওয়া দলটায় আমি নেই। শুধু সত্যটুকু স্বীকার করবো। পাঠক, কাঁধে শেল নিয়ে দৌড়ানো এই দলটা শেষ পর্যন্ত পুরোটা বিশ্বকাপের সময় জুড়ে কলেজের কঠোর শৃঙ্খলাকে তুচ্ছজ্ঞান করে এমন অদ্ভুত সব কাজ-কর্ম শুরু করে যে, বিশেষ দিনগুলোতে কলেজ কতৃপক্ষ বাধ্য হয়ে খেলা দেখার সুযোগ করে দেয়। আর সেটার সে জন্য তাঁরা কতগুলো বিকেল যে, শেল কাঁধে কলেজ মাঠের চারপাশে কত মাইল দৌড়েছে- সে খবরটা আমরা কেউ রাখিনি। প্রয়োজনও মনে করিনি।
লেখাটা শেষ করার আগে, বিশেষ কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি। এইচ এস সি পরীক্ষার সময় আমার মা প্রায় দীর্ঘ এক মাস রোজা রেখেছিলেন। ক্লাসে সব সময় পেছনে বসা তাঁর ছেলেটার উপর তাঁর হয়তো খুব একটা ভরসা ছিল না। কিন্তু আমি এমন আরেকজন মা’র কথা জানি, যিনি বাংলাদেশের প্রতিটা খেলার দিন রোজা রাখেন। বাংলাদেশের খেলাগুলোর সময় মা’র মনে কোন অবিশ্বাস কিংবা অজানা শঙ্কার স্থান থাকে না। যা থাকে, তা শুধুই দ্ব্যার্থহীন প্রগাঢ় ভালোবাসা। যে ভালোবাসাকে স্বয়ং ঈশ্বর পর্যন্ত অস্বীকার করার ক্ষমতা রাখেন না। মার্চ- এপ্রিলের কঠোর সূর্যদিনে এই মা পানির পিপাসা ভুলে যান। তাঁর এগারো জন ছেলে যখন মাঠে থাকে, তখন তাঁর পানির তৃষ্ণা লাগে না। কেন লাগে না সে প্রশ্ন মা’কে কখনো করা হয়নি। কিন্তু এটা খুব জানি, চারপাশে এতো এতো সব সমস্যা আর ‘না’ গুলোর মাঝে ক্রিকেটটাই আমাদের একমাত্র ‘হ্যাঁ’। তাই মাঠের এই খেলাটা শুধু মাঠের খেলা থাকে না।
আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকি পুরোটা সময় জুড়ে। এক একটা শুভক্ষণে সারা দেশ জুড়ে ঢেউ খেলে যায়। চারপাশের হাজারো সমস্যা, ক্ষোভ আর ‘না’গুলো মুহূর্তেই অস্তিত্বহীন হয়। খুব বেশি অবিশ্বাস যাদের- দেশ নিয়ে, সমস্যা জর্জরিত এই সময়টা নিয়ে, যে পরিবর্তনটার আশ্বাস দিয়ে প্রতি পাঁচ বছর পর পর এদেশে সরকার পরিবর্তন হয়, সেই পরিবর্তনটা আদতেই আসবে কিনা-সেটা নিয়ে; তাঁরাও আশাবাদী হতে বাধ্য হন।
যে সময়টায় আমরা বাস করছি, সেটাকে কোনভাবেই ভাল কিছু বলার সুযোগ নেই। কিন্তু বিশেষ কিছু মুহূর্তে আমরা আর এই ভুবনে থাকি না। সেসব মুহূর্তে হৃদয়ের গভীরতর কোন জায়গা থেকে ডাক আসে। চোখে স্বপ্ন ভর করে। আমরা স্বপ্নাহত হয়ে অদ্ভুত চোখে দেখি- আরে কঠিন তো কিছুই না। কে বলে আমরা পারি না, বিজয় চিনি না? এইতো বিজয়। এইতো স্বপ্ন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সেই ছেলেগুলো- যারা বাইশ গজের ক্রিজটাকে একটা দেশের স্বপ্নের জমিন বানিয়ে তুলেছে প্রতি মুহূর্তে। তাঁরা হয়তো জানে না, কিন্তু আমি ঠিকই জানি এই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম কাজ হচ্ছে মানুষকে আশায় বাঁচিয়ে রাখা। প্রিয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এই লেখাটা তাই তোমাদের জন্য।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১২
সম্পাদনা: রাইসুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর