স্লোগান পাল্টে গেছে। ৮০’র দশকের শেষের দিকের একটি জনপ্রিয় স্লোগান ছিলো: ‘একটা দুইটা শিবির ধরো, সকাল বিকাল নাস্তা করো’।
এসবই চোখের সামনে ভাসে। মনে পড়ে, এক সহপাঠি একদিন হোস্টেলের রুমে সামান্য বিষয়ে বিছানার নিচ থেকে বিশাল আকারের রাম দা বের করে ধাওয়া দিয়ে জানান দিলো সেও এক শিবিরকর্মী। অথচ কলেজ জীবনের দুটি বছরে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ বন্ধুই ছিলাম। এর আগে ঘুনাক্ষরেও জানতে পারিনি সেও রগকাটা দলের কর্মী। তার বিছানার নিচে লুক্কায়িত এত বড় রাম দা।
মেধাবীদের টার্গেট করে কর্মী বানানো শিবিরের পুরোনো স্টাইল। শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই-একজন সহপাঠীও নাকি শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো। ওরা অবশ্য কোনো জানান দেয়নি। আজও না। তাই কখনো বলি না। কিন্তু জানি। সেই শিবির ছিলো জঙ্গি, মারমুখী। কিন্তু তখন ছাত্রদল, ছাত্রলীগও কম শক্তিশালী ছিলো না। সে শক্তি ছিলো তাদের রাজনৈতিক শক্তি। পেশিশক্তি নয়। ফলে কলেজের সেই দিনগুলোতে ছাত্রদল বা ছাত্রলীগের মিছিলে দেখেছি স্লোগানের শক্তিতে, রাজনৈতিক বিশ্বাসে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তিতে বলীয়ান। যে শক্তিতে ৯০ এর গণতান্ত্রিক আন্দোলন সফল হলো, স্বৈরাচারের পতন হলো। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু তারপরে কী হলো? এই ছাত্রলীগ, ছাত্রদল হয়ে উঠলো দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের পেশিশক্তি। দেশ যখন এই দলের সরকার যায় ওই দলের সরকার আসে তার মধ্য দিয়ে পার করছে ততদিনে জামায়াত-শিবির নিজেকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। ২০০১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি, দেশবিরোধী শক্তি জামায়াতের নেতাদের গাড়িতে উঠলো জাতীয় পতাকা।
সময়ের প্রত্যাশায় সেই নেতারা অবশ্য এখন যুদ্ধাপরাধের মামলায় আদালতের কাঠগড়ায় হয়তো ফাঁসির আদেশের অপেক্ষায়। কিন্তু বাইরে? বাইরে এক ভয়াল পরিবেশের সৃষ্টি করেছে জামায়াত-শিবির। জ্বালাও-পোড়াও-ভাংচুর-ককটেল-বোমা এইসবে চলছে তাদের আন্দোলন। উদ্দেশ্য একটাই--- নেতাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকানো। বিএনপি’র কাঁধে ভর করে জামায়াত কেবল রাজনীতিতেই প্রতিষ্ঠিত নয়। তাদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনেও এখন আরো বেশি জঙ্গি, মারমুখি। আর এতে আগের মতোই প্রধান শক্তি শিবির।
বিএনপি’র উদ্দেশ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই পরবর্তী নির্বাচন নিশ্চিত করা। তারা স্বপ্ন দেখছে, অতীতের সকল দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ভুলে জনগণ এবার আবার তাদের ক্ষমতায় বসাবে। আর জামায়াত-শিবিরের স্বপ্ন কাঠগড়া থেকে কিংবা ফাঁসির মঞ্চের দোরগোড়া থেকে দলের নেতাদের মুক্ত করে আনবে। বিএনপি’র সঙ্গে যোগসাজশ রেখে আরেকবার ক্ষমতায় যেতে পারলেই সে পথ পরিষ্কার হবে। তা-না হলে বিএনপিকে থোড়াই পাত্তা দেয় জামায়াত-শিবির। কারণ শিবিরের কর্মীবাহিনী এখন কেবলই জঙ্গি নয়, তাদের আন্দোলন সংগ্রাম অনেক বেশি গোছানো। জেনেছি গত ৯ ডিসেম্বর রোববার রাজপথ অবরোধ সফল করার নীল-নকশা শিবিরের হাতেই তৈরি। তাদের দেওয়া নকশা বাস্তবায়ন করে কর্মসূচিতে সাফল্য পাওয়ার পর বিএপি নেতারা বুক ফুলিয়ে জানিয়েছেন সেকথা। আর সেই সাফল্যের ক্রেডিট নিয়েই ওদিনের জ্বালাও-পোড়াওয়ের দায় মাথায় নিয়ে এখন কারাগারে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার গ্রেফতার হওয়ার প্রতিবাদে বিএনপি যে হরতাল গত মঙ্গলবার পালন করলো তা ছিলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল। অনেকের মতে ওই দিন শিবির কম সক্রিয় থাকাতেই এমনটা হয়েছে।
বৃহস্পতিবারেও শিবির খুব একটা সক্রিয় নয়। অবশ্য ভোররাতে ধানমন্ডি থেকে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ডা. শফিকুর রহমান গ্রেফতার হয়েছেন। এ নিয়ে জামায়াত শিবির হয়তো আবারও নেমে পড়তে পারে ভাংচুরে। কিন্তু একটি বিষয় দেখা যাচ্ছে- শিবিরের টার্গেটে রয়েছে পুলিশ। যেখানেই তারা পারছে পুলিশের ওপর হামলা চালাচ্ছে। পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর কাঁটাবনে শিবিরকর্মীরা তিন পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের আহত করেছে। বেলা বাড়তেই রায়েরবাজারে আহত হয়েছেন পুলিশের একজন এসআই।
শিবির এখন পাল্টা স্লোগান দিচ্ছে- ‘একটা দুইটা পুলিশ ধরো... সকাল বিকাল নাস্তা করো’।
বাংলাদেশ সময় ১০৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১২
এমএমকে