জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য নির্বাচিত হয়েই বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন।
প্রতিশ্রুতি রক্ষায় প্রথমেই উপাচার্য নির্বাচন দেন অধ্যাপক আনোয়ার।
যদিও অনেক শিক্ষকই বিরোধিতা করেন ওই নির্বাচনের। পাছে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগী উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির আবারো নির্বাচিত হয়ে না যান সে ভয়েই ওই বিরোধিতা। তাদের ভয় সত্যে পরিণত করে ফের বিপুল ভোটে উপাচার্য প্যানেলের শীর্ষ স্থান দখল করেন শরীফ এনামুল কবির। যদিও সরকার তাকে পুনরায় উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ না দিয়ে ভোটের ব্যবধানে তার চেয়ে পিছিয়ে থাকা আনোয়ার হোসেনকেই উপাচার্য নিয়োগ দেয়।
আর উপাচার্য নির্বাচনে সফলতার পর বিভিন্ন অনুষদের ডীন নির্বাচন দিয়ে আর একটি সফল দৃষ্টান্ত মেলে ধরেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। এরপর অধ্যাদেশ ’৭৩ অনুযায়ী তিনি সিন্ডিকেট সদস্যসহ আরো কিছু নির্বাচন দেন। সব নির্বাচনেই সফল হন তিনি।
একের পর এক নির্বাচন আয়োজনের সফলতা অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন দিতে উৎসাহ যোগায়। বিভিন্ন সভা, সেমিনার, এমনকি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালেও আগামী জানুয়ারি নাগাদ জাকসু নির্বাচন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে এক সেমিনারেও তিনি জাকসু নির্বাচন দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
এই নির্বাচন আয়োজনের পন্থা নিয়েও নিজস্ব চিন্তা আছে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের। তার মতে, জাকসু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হল একটি পরিবেশ পরিষদ গঠন করা। এ পরিষদের সভাপতি হবেন উপাচার্য। আর বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা হবেন প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য। এই পরিষদের প্রধান কাজ হবে জাকসু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
এমনকি এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা তার কাছে গেলেই তিনি পরিষদ গঠন করবেন বলেও জানান উপাচার্য।
এছাড়াও তিনি মনে করেন, ক্যাম্পাসে সব রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান জরুরি।
জাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। যেহেতু তাদের পার্টিই সরকারে তাই এমন পরামর্শ উপাচার্যের।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- ছাত্রলীগ কি নির্বাচন চায়? শিক্ষার্থীরা কি ভূমিকা পালন করছে এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে?
জাকসু নির্বাচনের জন্য ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো মাঠগরম করা বক্তব্য দিয়ে আসছে। প্রথম দিকে মুখ না খুললেও নতুন কমিটি পাওয়ার পর থেকে নির্বাচনের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছে ছাত্রলীগও। কিন্তু প্রশ্ন, আসলেই কি তারা নির্বাচন চায়?
প্রকৃতপক্ষে এতো দিন যারা জাকসু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেছিল তারাই এখন চুপসে গেছে। প্রগতিশীল সংগঠনগুলো দু’টি কারণে এখন এই ইস্যু থেকে সরে এসেছে।
এক. জাকসু নির্বাচন হয়ে গেলে তারা আর যাচ্ছেতাই ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করতে পারবে না। দুই. এই নির্বাচনে তাদের পদ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
এদিকে ছাত্রলীগ প্রকাশ্যে এই বিষয়ে কোন আগ্রহ বা অনাগ্রহ না দেখালেও প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে তারা জাকসু নির্বাচনের পক্ষেই অবস্থান করছে। তবে পরোক্ষভাবে তাদের অবস্থান ঠিক উল্টো। প্রকৃতপক্ষে তারাও এই নির্বাচন চাচ্ছে না।
গত জানুয়ারিতে জুবায়ের হত্যার পর থেকে ছাত্রলীগের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনোভাব নেতিবাচক। তাই তাদের টপকে অন্য কোন দলের প্রতিনিধিরা জাকসুর নেতৃত্বে উঠে আসতে পারেন। আর সেটা হলে আরো বেকায়দায় পড়বে ছাত্রলীগ। ফলে এই নির্বাচন আয়োজন করে নিজ পায়ে কুড়াল মারতে অনেকটাই নারাজ ছাত্রলীগ নেতারা।
এছাড়া জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রশাসনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরাও তাদের ক্ষমতা ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কায় এই নির্বাচনের বিরোধিতা করছেন। যদিও তাদের এই বিরোধিতা প্রকাশ্যে নয়।
প্রশাসনের বিরোধিতা করার কারণ হলো- জাকসু নির্বাচন হলে প্রশাসন আর একচেটিয়া কাজ করতে পারবে না। বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার বেলায় অনিয়ম ও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যা ছাত্রসংসদ নির্বাচন হলে তাদের এমন বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া মুশকিল হবে। কোন খাতে কতো টাকা আয়, কোথায় কতো টাকা ব্যয়, তা জানার অধিকার রাখে ছাত্রসংসদ।
এ পরিস্থিতিতে জাকসু নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান করছেন কেবল উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। তবে তার সঙ্গ দিতে প্রস্তুত জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোকে ছাড়া সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষে নির্বাচন করা আদৌ সম্ভব নয়।
তাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ নির্বাচন এখন অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যেই রয়েছে। তবে আমার সব যুক্তি মিথ্যা প্রমাণ করে অবিলম্বে জাকসু নির্বাচন হোক এ প্রত্যাশাই করি।
লেখক: শিক্ষার্থী, লোক-প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১২
সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর