প্রকৃতিতে এখন পৌষ মাস। দেশজুড়ে শীত জেকে বসেছে।
চারদিকে শীতের জয়জয়কার। বুঝিবা সেকারণেই ’তারা‘-যাদের গরম কাপড়ের অভাব নেই- চেষ্টা করে আমজনতাকে কিছুটা হলেও উষ্ণ রাখতে। আর এক সাথে ১৬ কোটি মানুষকেতো আর গরম কাপড় দিয়ে উষ্ণ করা যায়না। সেটি অনেক বড় খরচের ব্যাপার। তাই একটিমাত্র ইস্যু আছে-হরতাল। যার মাধ্যমে ইদানিং একটি ঘোষণা দিলেই এ কাজটি খুব সহজেই হয়ে যায়।
দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার দাবীতে গতকাল (১৭ ডিসেম্বর)হরতাল দিয়েছিল ভূইফোড় দল- ’গড়বো বাংলাদেশ বিপ্লবী দল’। দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে তিনি (ড. শাহেদা) কি নেত্রী হিসেবে আবিভুত হতে চান?
১/১১-এর সময়ে আমরা মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের চেষ্টা দেখেছিলাম। সে (অপ) চেষ্টার সাথে শরীক ও নেতৃত্ব দিয়েছিল দেশের খ্যাতনামা অনেকে। তাদের মধ্যে মিডিয়ারও কেউ কেউ ছিল। আমি চেষ্টার সঙ্গে ’অপ’ লাগিয়েছি একারণেই যে- সে চেষ্টা সফল হয়নি। সফল হলে কী হতো কিংবা সফল হওয়ার প্রয়োজন ছিল কিনা তা নিয়ে অনেকে বিতর্ক করতে পারেন।
কিন্তু আমরা সকল রাজনৈতিক বিতর্কে আসল বিষয়টিই মিস করি- রাজনীতিতে গুণগত পরিবতর্ন। সেটি না হলে দুই নেত্রীকে বাদ দিয়েও আদতে কোনো লাভ হবে না। আমাদের বুঝতে হবে- দুই নেত্রী অন্ততঃ জনগণের ব্যালটের অধিকারকে বিশ্বাস করে- বুলেটের নয়। ব্যালটের অধিকতর নিরাপত্তার জন্যই আমাদের পদ্ধতিগত রাজনীতি ও রাজনৈতিক আন্দোলনের পথে চলতে হয়।
কিন্তু এতো কিছুর পরও ড. ওবায়েদ যথারীতি ঘোষণা দিলেন যে তাদের হরতাল সফল। পৌষ মাস তাই অনেক মা-বোনেরা শীতের তীব্রতাকে পরাভূত করে লেপের নীচ থেকে রান্না ঘরের দূরত্বকে অতিক্রম করতে পারেন নি। আমার স্ত্রীও তাদের মধ্যে একজন। কাজেই আমিও বলতে পারি, হরতাল সফল।
আবার দেখুন, আজও হরতাল। ডানের সহায়তার বামের হরতাল।
আজকের হরতাল যে সফল তাতো রাস্তাঘাটের অবস্থা দেখেই বোঝা যায়। জনগণ একটি হরতাল সফল কি বিফল তা বিচার করে প্রাথমিকভাবে রাস্তাঘাটের অবস্থা দেখে। রাস্তাঘাটে যদি যানবাহন চলাচল না করে তবেই হরতাল সফল। এক্ষেত্রে হরতালকারীরা ও হরতাল বিরোধীরা পরষ্পর বিরোধী বক্তব্য দেবে এটাই স্বাভাবিক।
আজকের হরতালে সরকার ও পুলিশের ভূমিকা ব্যাপক। ছবিতে দেখা যায়, কুয়াশার মধ্যে দূরে লাল পতাকাবাহী একজন মানুষ দাঁড়িয়ে- যার আশেপাশে কোনো জনমানব নেই। হরতাল পালনে বাম দলের একজনই একশ’ জনের সমান!
প্রতিবেদনে দেখলাম, পুলিশ নাকি যানবাহন চলাচলে সবাইকে নিরুৎসাহিত করছে। ক্ষেত্র বিশেষে বাঁধাও দিচ্ছে। কাজেই বাম দলের আজ ‘একাই একশ’ অবস্থা বিরাজ করছে।
বামের হরতালের ইস্যুগুলো যেহেতু সরকারের জন্য সহায়ক ও আরামদায়ক তাই তারা সমথর্ন দিচ্ছে। বিরোধী দলের হরতাল যেহেতু সরকার বিরোধী তাই সেখানে পুলিশ-ছাত্রলীগ ভাই-ভাই।
লক্ষ্যণীয়, কোনো দলের কাছেই জনস্বার্থ বড় বিবেচ্য বিষয় নয়। সরকার বিরোধী দলের হরতালের সময় যানবাহন চলাচলে বাঁধাপ্রদানকারীদের প্রতিহত করে আর আজকের হরতালে নিজেরাই সে কাজটি করছে। কাজেই, জনস্বার্থ মূল বিষয় নয়। আসল কথা হলো দলের স্বার্থ।
আজকের হরতালের ইস্যুগুলো হলো-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আইন করে নিষিদ্ধ করা। সেই সাথে আরো কিছু চটকদার ও লোক দেখানো ইস্যুও আছে।
কিন্তু দেখুন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন হবে কীভাবে? রাস্তায় আন্দোলন করে, হরতাল দিয়ে? নাকি এটি একটি প্রক্রিয়া যা আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আচরণের মধ্যে দিয়ে বিকশিত হবে?
আন্দোলন করে কোনো চেতনা বাস্তবায়ন করা যায়? বাম-তাত্ত্বিকরা তা আরো ভালো জানেন। বাম ভাবাদৃশের তকমা আওড়িয়ে ডানের সহায়তায় হরতাল করে আদতে কোনো লাভ নেই। আসল ক্ষমতা জনগণের হাতে।
যুদ্ধাপরাধীর ইস্যু নিয়ে কিছু বলতে চাইনা। এদেশের আপাময় জনতা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চায়। কিন্তু সরকার, বিরোধী দলসহ সবাই এ জাতীয় ইস্যুটিকে নিয়ে যে রাজনীতিতে লিপ্ত হয়েছে তা জাতির জন্য শুভ নয়।
বামদলের হরতালের বিষয়- ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা’-এটিও যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক বিষয় নয়। কারণ, বিচার করার জন্য একটি আদালত আছে। সে আদালতই তার বিচার করুক। আদালত ন্যায়বিচার নিশ্চিৎ করার জন্য যতটুকু সময় লাগবে সে সময়ের মধ্যেই বিচার করবে।
আদালতের কাছে মূল বিবেচ্য হলো- ন্যায় বিচার। সেটি নিয়ে কারো কোনো আন্দোলন নেই। কারো আন্দোলন বিচার দ্রুত করা কারো, আন্দোলন বিচার বিলম্বিত করা। কেউ ন্যায়বিচারের কথা বলছেনা।
আমাদের মনে রাখতে হবে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে ন্যয়বিচার নিশ্চিৎ না করতে পারলে শহীদদের প্রতি আমরা অবিচার করবো।
শুরু করেছিলাম পৌষ মাস থেকে। আজ পৌষের ৪। এরই মধ্যে দুই দিন হরতাল হলো। সামনে আরো হরতাল হবে। রাজনীতিবিদদের কাছে আমরা আর কিই আশা করতে পারি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১২
সম্পাদনা: সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর/আরআর