ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

রক্তের সম্পর্কে বিয়ে ও জেনেটিক ডিজঅর্ডার

রোমান মাহবুব হাসান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০১৩
রক্তের সম্পর্কে বিয়ে ও জেনেটিক ডিজঅর্ডার

বাংলাদেশে একই পরিবারের মধ্যে (রক্তের সম্পর্ক আছে এমন) বিয়ের ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু এর ফলে অনেক পরিবারেই দেখা দেয় জেনেটিক ডিজঅর্ডার।

নতুন বংশধরদের অনেকেই হয়ে যাচ্ছে অন্ধ, বোবা ও কালা। অথচ পরিবারের মধ্যে বিয়ে না করলেই এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হতো না। যে সব জিন এই জেনেটিক ডিজঅর্ডারের জন্য দায়ী (ডিফেকটিভ জিন), সেগুলি সাধারণত প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে। অর্থাৎ আমাদের দুই সেট ক্রোমোজোমের মধ্যে যদি একটিও ডিফেকটিভ হয় তাহলে সুস্থ জিনের জন্য রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় না।

একই পরিবারে বিয়ে হলে সন্তানের মধ্যে দুটিই ডিফেকটিভ জিন হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। ফলে পরবর্তী প্রজন্মে সুস্থ (একটি ডিফেকটিভ জিন) এবং প্রতিবন্ধী (দুটিই ডিফেকটিভ জিন)—এই দুই ধরনের সন্তানই দেখা যায়।

সমীক্ষা-১: গত দুই সপ্তাহ ধরে আমি আর পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের কবির ভাই (উনি পিএইচডি করছেন চোখের রোগের বংশগতি নিয়ে) সিলেট অঞ্চলে চোখে দেখতে পায় না এমন অনেক পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের কাছ থেকে রক্ত নিয়েছি গবেষণার জন্য, মাঝেমধ্যে তাদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছি। তারা উৎসাহের সঙ্গে আমাদের সহায়তা করেছেন। এদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেল, সবকটি ক্ষেত্রেই একই পরিবারের মধ্যে বিয়ে করাটাই মূল কারণ। আর এদের পরিবারের মধ্যে একাধিক অন্ধ বা বধির সন্তান আছে। আগেই বলে রাখছি, আমরা ডাক্তার নই। আমরা গবেষক। আমরা এই রোগের বংশগতির কারণ তা বের করতে চাই। বের করতে চাই, আরো কোনো নতুন জিন এই রোগের জন্য জড়িত কিনা।

সমীক্ষা-২: ঘটনাস্থল সুনামগঞ্জের দুয়ারা বাজার উপজেলার প্রতাপপুর। হারিস মিয়ার বাড়ি। হারিস মিয়া উনার চাচাতো বোনকে বিয়ে করেছেন। তার এক ছেলে, তিন মেয়ে। এর মধ্যে বড় মেয়ে এবং এক ছেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। রাত আর দিন ছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারে না। জগতটা তাদের কাছে হয় একটু আলো, না হয় অন্ধকার। কিন্তু তারা দমে নেই। মেয়েটি চতুর্থ শ্রেণীতে আর ছেলেটি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। বাড়ির পাশেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সারাদিন ক্লাস করে। ক্লাসে যা শুনে সন্ধ্যায় তা মনে করে। নিজে নিজে পড়ে। তারপর পরীক্ষা দেয়। ওরা বলে দেয় আর ওদেরই সহপাঠী কেউ একজন লিখে দেয় খাতায়। এভাবেই ওরা এগিয়ে চলেছে। কথা হয়েছিল ছেলেটির সঙ্গে, নাম হাফিজ আলী। জানতে চাইলাম, “দ্বিতীয় সাময়িকে কতো নম্বর পেয়েছ”? সে বলল, “৩২৫। ” মানে ৫০ শতাংশের বেশি। আমার আগ্রহ আরো বাড়ল। আরেকটু কি বেশি পাওয়া যাবে? বলল “নিজে লেখতাম পারি না। আরেকজন লেখি দেয়। তাই পারিয়ার না!”(নিজে লিখতে পারি না। আর একজন লিখে দেয়। তাই পারি না)। শেষে অনেক দ্বিধা নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, “ভাই তুমি কি হতে চাও বড় হয়ে? বলেছিল, “মানুষ”। মানুষের মানে ওর কাছে আর জানতে সাহস হলো না।

এরকম যত পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের প্রতিবন্ধী সন্তানটি কিছু না কিছু একটা করছে। কেউ কেউ রোজগারও করছে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে। আমাদের দেশটা যে এগিয়েছে তা এদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায়। ওরাই এগিয়ে আসে গবেষণায় সাহায্য করার জন্য কারণ ওরা চায় না আর একজনও তাদের মতো এমন প্রতিবন্ধী হোক। ওরাই প্রতীক্ষায় থাকে গবেষণার ফল জানার জন্য। জয়তু “হাফিজ আলী”।

লেখক: স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১২
আরআর; সম্পাদনা:জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।