ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও এর প্রভাব

জিনিয়া জাহিদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৩
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও এর প্রভাব

নতুন বছরের শুরুতেই বর্তমান সরকার তার শাসনামলে ৫ম বারের মত জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে আবার সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে বিরোধীদলের হরতাল ও প্রতিবাদ রাজপথে পরিলক্ষিত হয়েছে।

প্রতিবাদে সামনে রয়েছে বামদলগুলোর হরতাল।

অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, আন্তর্জাতিক বাজারে এখন তেলের দাম স্থিতিশীল থাকলেও বাংলাদেশের প্রধান দাতাসংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপের কারণেই মূলত এই দাম বৃদ্ধি।

প্রসঙ্গত গত বছর বাংলাদেশ সরকার আইএমএফ এর বর্ধিত ঋণ সুবিধার অধীনে ১০০ কোটি ডলারের একটি ঋণের জন্য বহু দেনদরবার করেছিল। এ ঋণের পিছনে ধর্ণা দেওয়ার মূল কারণ হিসেবে ক্রমাগত রফতানি আয় হ্রাস, আশংকাজনকভাবে বিশাল আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, প্রবাসীখাতের আয় তথা রেমিট্যান্স হ্রাস এবং আশানুরূপ বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহ কমে যাওয়াকেই দায়ী করা হয়।

একদিকে অর্থের ইনফ্লোর তুলনায় অর্থের আউটফ্লোর পরিমাণ আশংকাজনকভাবে বাড়তে থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ ভারসাম্য রক্ষা করার চাপ, অন্যদিকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দাতাসংস্থার কাছে নেওয়া ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের দায়। সব কিছু মিলিয়ে লেজেগোবরে অবস্থায় পড়া সরকার তাই অর্থনৈতিক এই ভয়াবহ সংকট উত্তরণের জন্য কঠিন শর্তে আইএমএফ এর কাছে ঋণ গ্রহণের জন্য হাত পাতে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে চার দফা সংস্কারের শর্তে আইএমএফ অবশেষে ১০০ কোটি ডলার ঋণ প্রদানে সম্মত হয়।  

বহু দেনদরবারের আলোচিত সমালোচিত আইএমএফ কর্তৃক ১০০ কোটি ডলারের এই ঋণ মূলত অনুমোদন করা হয়েছিল বাংলাদেশের আর্থিকখাতে গতিশীলতা আনা, সম্পদের সংগ্রহ বাড়ানো, সামাজিক ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ঘাটতি কমিয়ে আনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, রপ্তানিমুখী বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য আর্থিকনীতি, মুদ্রানীতি ও বিনিময়হার, আর্থিকখাত ও বিনিয়োগখাত এই চারটি খাতে সংস্কার এর জন্য।

উল্লেখ্য, শর্তানুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্পে প্রথম কিস্তির অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণের রিপোর্টের সন্তুষ্টির ওপরই নির্ভর করবে দ্বিতীয় কিস্তি এবং দ্বিতীয় কিস্তির পর তৃতীয় এবং এভাবেই একেকটা উন্নয়ন প্রকল্পের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে দেওয়া হবে মোট ১০০ কোটির ঋণ। এই ঋণের প্রথম কিস্তি হিসেবে গত ২৫ এপ্রিল ২০১২, বাংলাদেশ সরকার আইএমএফ এর কাছ থেকে ১৪.১ কোটি ডলার পেয়েছে। প্রথম কিস্তির ঋণের এই অর্থ প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই সেসময় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ১০.০০৪ বিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১০.১৫৩ বিলিয়নে পৌঁছেছিল।

কিন্তু ইতিহাস বলে যে, দুর্নীতির চাপে এদেশে ঋণের অর্থ কখনোই যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয় না। বলাবাহুল্য আইএমএফ এর প্রথম কিস্তির ঋণের অর্থের ক্ষেত্রেও এরকম কিছুই হয়েছিল। শর্তানুযায়ী যথাযথ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড না হবার কারণে নাখোশ আইএমএফ দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। যা চুক্তি অনুযায়ী গত নভেম্বর ২০১২ তে দেওয়ার কথা ছিল।

দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পেতে মরিয়া সরকার দাতা এই সংস্থার সঙ্গে আবারও বহু দেনদরবার করে । অবশেষে, আইএমএফ দ্বিতীয় কিস্তির ১৪ কোটি ১০ লাখ ডলার জানুয়ারি মাসে দিতে সম্মত হয়।

এ কথা তো সত্য, আমাদের দেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানির জন্য সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হয়। এছাড়াও বিদ্যুতের ঘাটতি কমানোর জন্য ছোট ছোট বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলো চালাতে ও কৃষিকাজে উত্পাদন অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সেচকাজে জ্বালানি ভর্তুকি দেওয়া হয়। কারণ, এসব খাতে ভর্তুকি না দিলে উত্পাদন খরচ বেড়ে যায়। উত্পাদন খরচ বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়।

রপ্তানিমূলক শিল্পের ক্ষেত্রে উত্পাদন খরচ বেড়ে যাওয়া কখনোই কোনও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য কাঙ্খিত নয়। এর ফলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকাজের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে। আইএমএফ জ্বালানি আমদানিতে ভর্তুকি বন্ধসহ বিদ্যুৎ ও সারের দাম সমন্বয়ের জন্য সরকারকে চাপ দিয়ে আসছিল। এর ফলশ্রুতিতে আইএমএফকে সন্তুষ্ট করে ঋণের টাকা পেতে সরকার নির্বাচনের এই জটিল সময়েও পুনরায় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করতে অনেকটাই বাধ্য হয়েছে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর গন্ধ পেলেই আমাদের দেশে খুব দ্রুত কিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। তাহলো, বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যায়, যেকোনো ধরনের শিল্পোৎপাদন ও কৃষির উৎপাদন খরচ ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায়। এর ফলে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায় বহুগুন। অন্যদিকে সরকার সেচ কার্যে ভর্তুকি দিলেও কৃষকের উত্পাদিত পণ্যের ন্যায্যদাম না পাওয়ায় সে সুফল মূলত বৃহত্ জনগণের কেউই ভোগ করতে পারে না।

উপরন্তু বাজার ব্যবস্থার সমন্বয়ের অভাবে নিজেদের উত্পাদিত পণ্য বহু গুণ দাম দিয়ে কিনতে গিয়ে জনগণ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। যেহেতু জ্বালানি বাড়ার খবর পেয়েই পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায় কয়েকগুণ, সেক্ষেত্রে পরিবহন ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। আর একবার কোনও কিছুর দাম বেড়ে গেলে তা পুনরায় কমার রেকর্ড আমাদের দেশে নাই বললেই চলে। হাজার আইন কানুন কিছুই তোয়াক্কা করে না পরিবহন মালিকরা ও ব্যবসায়ীরা।

দফায় দফায় জ্বালানির দাম বাড়িয়ে ও ঋণের টাকায় দেশ চালিয়ে ক্রমবর্ধমান সমস্যার সমাধান কখনোই সম্ভব নয়। অর্থনীতির এ জটিল সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে অবশ্যই বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। নিতে হবে দীর্ঘ মেয়াদী ও কার্যকরী পরিকল্পনা। কৃষকের উত্পাদিত পণ্যের ন্যায্যদাম নিশ্চিতকরণে সরকারকে বাজার ব্যবস্থা উন্নয়নে নজর দিতে হবে।

দাম ঠিক রাখার জন্য প্রয়োজনে অতিরিক্ত পণ্যের রপ্তানি বাজার তৈরি করতে হবে। মধ্যসত্বভোগীদের কঠোরভাবে দমন না করলে কোনভাবেই সরকারের কোনও ভাল পরিকল্পনাই কখনো বাস্তবায়িত হবে না, এ বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই আমলে নিতে হবে।

যেহেতু আমাদের সরকার সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দিয়ে থাকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে, কাজেই আমাদের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকে প্রাধান্য দেওয়া দরকার সবার আগে। কুইক রেন্টালের গুণগান গেয়ে সরকার যতই নাচানাচি করুক না কেন, এতে মূলত সরকারের জ্বালানি তেল আমদানির খরচ ও ভর্তুকির পরিমাণও অনেক বেড়ে যায়।

আর তা দ্বারা সাময়িক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা ডিজইনভেস্টমেন্ট হিসেবেই গণ্য হয়। তাই এই মুহূর্তে দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ী বিদ্যুত্খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনই পারে ভবিষ্যতে জ্বালানি তেলের আমদানির ওপর চাপ অনেকাংশেই কমিয়ে নিতে।  

জ্বালানি তেলের ভর্তুকি কমিয়ে জনগণের কাছে দাম বাড়িয়ে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য আগামী দিনগুলোতে বিশাল এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিবে। এ কথা তো বলাইবাহুল্য জ্বালানির দাম বৃদ্ধির চরম প্রভাব খেটে খাওয়া জনগণের ওপরেই পড়ে। আর তার সামগ্রিক চরম মূল্য ভবিষ্যত নির্বাচনের ওপর পড়ার আশংকাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না!!

জিনিয়া জাহিদ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১২
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর eic@banglanews24.com;জুয়েলমাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।