২০০৪ সালের কথা। সাউথ এশিয়া ফ্রি মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন-সাফমা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের লাহোরে।
ক্ষোভ আর বিদ্বেষ বুকে নিয়েই পা রেখেছিলাম পাকিস্তানের মাটিতে। পাকিস্তানের সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় সেই ক্ষোভের কথা প্রকাশ করেছি অকপটে।
’৭১ এ নিজেদের বর্বরতার জন্য দেশটির সুশীল সমাজ লজ্জিত বোধ করে-সেকথা আগেও জানতাম। তবে ধারণা ছিলো না দেশটির একেবারে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ আমাদের কি চোখে দেখে, বাংলাদেশ নিয়ে তাদের অনুভূতি কি। ওই সময়ে লাহোরের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে আমরা তিনজন বাংলাদেশি সাংবাদিক একটি সাধারণ বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢুকে পড়েছিলাম। একেবারে সাধারণ নিম্নবিত্ত পাকিস্তানি বিয়ের আয়োজন। পরিচয় জানতে পেরে যে আন্তরিকতা আর আপনজনের হৃদ্যতা নিয়ে আমাদের তারা বুকে টেনে নিয়েছিলো তা ভোলার নয়! পাঞ্জাবী ভাষায় তারা যা বলেছিলেন তার বাংলা হলো, আমরা এক ছিলাম। এখন আলাদা হয়ে গিয়েছি। কিন্তু তোমরা তো আমাদের বোনের মতো। তাদের এই কথায় কোনো কৃত্রিমতা ছিলো না। অনাহুত হলেও পেয়েছিলাম পরম আতিথেয়তা। সেবার এক ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে দেশে ফিরেছিলাম। তবে কিছুটা সংকোচ আর দ্বিধায় সেই অনুভূতির কথা কাউকে জানাতে পারি নি। পরে অনেকবার ভেবেছি, বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রটি না থাকলে তারা কি আমাদের একই চোখে দেখতেন? কিংবা সেখানে অনুপ্রবেশ করার মতো ততটা আত্মবিশ্বাস কি আমাদের থাকতো? এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা বৃথা। কারণ পরাধীন জাতিসত্তার অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মুক্তুযোদ্ধারা আমাদের দিয়ে গেছেন সম্মানজনক সত্তা, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। তাই অতীত না ভুলেও নতুন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে চাই।
প্রায় আট বছর পর ২০১৩ এ আবার সেই লাহোর, দক্ষিণ এশিয়ার সাংবাদিকদের সেই একই সম্মেলন। তবে এবারের সম্মেলনস্থল এই অঞ্চলের সবচেয়ে বিরোধপূর্ণ দুই দেশ ভারত-পাকিস্তান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ভারতের অমৃতসর আর সমাপনী পাকিস্তানের লাহোরে। দুই দেশ, কিন্তু প্রদেশের নাম এক--পাঞ্জাব। এই পাঞ্জাবের ভেতর দিয়ে শের শাহ সুরী প্রায় আড়াইশ বছর আগে নির্মাণ করেছিলেন গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড। আফগানিস্তানের কাবুল থেকে পাকিস্তান-ভারত হয়ে বাংলাদেশের সোনারগাঁ পর্যন্ত। গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড পাঞ্জাবে এসে ওয়াহগা সীমান্তে ভারত পাকিস্তানকে দুভাগ করেছে। বহু বছর সেই পথ দুই দেশের মানুষের জন্য বন্ধ ছিলো। সম্প্রতি তা সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়া হয়েছে। শুধু পাঞ্জাব নয়, এই অঞ্চলে দেশে দেশে সীমানা প্রাচীরের নামে মানুষে মানুষে গড়ে তোলা হয়েছে অদৃশ্য দেয়াল। একটি জাতির ভাষাকে ধরা হয় সেই জাতিসত্তার প্রথম পরিচয়। উপমহাদেশের অধিকাংশ ভাষার উৎস একই--সংস্কৃত। জীবন যাপনের সংস্কৃতিতে যেমন বৈচিত্র রয়েছে তেমনি রয়েছে সুগভীর মিল। শের শাহ সূরী একজন দূরদর্শী কল্যাণকামী শাসক হিসেবে এই অঞ্চলের মানুষে মানুষে বন্ধন অনুভব করেছিলেন, বৃটিশ শাসক গোষ্ঠী তাতে চিড় ধরাতে চেয়েছে। ’৪৭ সালে দেশভাগের সময় স্থায়ী সংঘাত বাঁধিয়ে রাখার নীল নকশা করে। ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলু-খাগড়ার প্রাণ যায়’- সেই ফর্মুলায় উপমহাদেশ এখনো বৃটিশদের নীল নকশার জালে জর্জরিত।
সাকর্ভূক্ত দেশগুলোর মানুষের মধ্যে অদৃশ্য দেয়াল ভাঙ্গার সংকল্প নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় সাফমা’র অষ্টম বৈঠক। এবারের প্রতিপাদ্য ছিলো ‘ওপেনিং মাইন্ডস, ওপেনিং বর্ডারস। এই আয়োজন মূলতঃ দক্ষিণ এশিয়ার আটিটি (আফগানিস্তান সহ) দেশের মধ্যে যে মেলবন্ধন আছে তা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের জন্য একটি একক ভোগলিক কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যেই ২০০০ সাল থেকে সাফমা কাজ করছে এবং সার্কের একটি অঙ্গ সংগঠনের স্বীকৃতি পেয়েছে। পাকিস্তানের প্রায়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো রাজনৈতিকভাবে এমন একটি আঞ্চলিক বলয় গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় পারস্পারিক সংঘাত সন্দেহ আর অবিশ্বাস পরস্পরকে কেবল দূরেই ঠেলেছে।
যদিও এই অঞ্চলের মানুষে মানুষে সম্পর্কের বন্ধন বাড়াতে এরই মধ্যে সার্কভূক্ত দেশগুলোতে সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে সার্ক ভিসা। লাহোরে সমাপনী অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, শিগগিরই দেশটি সাংবাদিকদের জন্য ভিসামুক্ত করার উদ্যোগ নেবে। ভারতের অমৃতসরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশীদ জোরালোভাবে তার বিশ্বাসের কথা বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, আমাদের প্রজন্মের জীবদ্দশাতেই আমরা একটি ভিসামুক্ত দক্ষিণ এশিয়া দেখে যেতে পারবো। ”
বাংলাদেশ সময় ১৫৩৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৩
এমএমকে;জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর