ঢাকা, শনিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

দিল্লির বাসে ধর্ষিতা দামিনী ও এসিডে ঝলসানো আঁখি

জিনিয়া জাহিদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৩
দিল্লির বাসে ধর্ষিতা দামিনী ও এসিডে ঝলসানো আঁখি

গত ১৫ জানুয়ারি, ২০১৩ তারিখে জনাকীর্ণ ঢাকা শহরে সবার সামনে এসিডে ঝলসে গেল সম্ভাবনাময় উচ্ছল একটা তরুণী। মেডিকেল রিপ্রেজেনটিটিভ বি বাড়িয়ার মনির উদ্দিনকে বিয়ে করতে অসম্মতি জানানোর জন্যই এসিডে ঝলসে যেতে হল স্বনামধন্য ইডেন কলেজের বাংলায় স্নাতক পড়ুয়া শারমীন আঁখিকে।



আঁখি নামের মেয়েটির সুন্দর আঁখিযুগল থেকে চিরতরে দৃষ্টিশক্তি চলে যাবার আশঙ্কার পাশাপাশি গভীরভাবে পুড়ে গেছে শরীরের ১৫ শতাংশ। আঁখি এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে প্রহর গুণছে। জানিনা সে প্রহর বেঁচে ওঠার, নাকি মরে বেঁচে যাবার!!

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মনির নামক নরপশু আঁখির পূর্ব পরিচিত ছিল। তাদের বিয়ে হয়েছিল, বিচ্ছেদও হয়েছিল। এসিড মারার মত মানসিকতা যে নরপশুর তাকে আঁখি নিশ্চয়ই ভালোভাবে চিনেছিল। চিনেছিল জন্যই সে তাকে পুনরায় বিয়ে করতে অসম্মতি জানিয়েছিল। আর মনির যে নরপশু তা তার পকেটে থাকা ধারালো ছুরি আর বোতল ভর্তি এসিড থেকেই বোঝা যায়।

তাইতো সে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আঁখিকে কাজী অফিস পর্যন্ত সে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল। যে ছেলে বিয়ে করার জন্য কাজী অফিসে যায়, তার পকেটে কেন ছুরি থাকবে, কেন থাকবে এসিডের বোতল? তার মানে কি এই নয়, যে এই অপরাধ সে ইচ্ছাকৃত ও সুপরিকল্পিতভাবেই করেছে? বিয়েতে অসম্মতি জানানোর জন্য অসহায় মেয়েটিকে এলোপাতাড়িভাবে ছুরিকাঘাত করেও মনের ঝাল মেটেনি নরপশুর, তাই পকেটে রাখা এসিডের বোতল থেকে এসিড ছুড়ে ঝলসে দেয় মেয়েটির দেহ।

দুঃখের বিষয় হল পুলিশ এখনো নরপশু মনির উদ্দিন ও তার কুকর্মের সঙ্গী মাসুমকে গ্রেফতার করেনি। এই অপকর্মের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এহেন অপরাধকে মূলত উত্সাহিত করা হবে। যাকে চাই, তাকে যদি না পাই, তবে তাকে এসিড ছুড়ে ঝলসে দেই, বাকি জীবনকে নরক করে দেই, এই মানসিকতা গড়ে উঠবে ডিজিটাল প্রজন্মের মাঝে।  

নরপশু মনির ও তার সহযোগী মাসুম ধরা পড়ুক, ওদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক এই দাবির পাশাপাশি আমাদের নিজেদেরও কিছু কর্তব্য রয়েছে।

পত্রিকা পড়ে জানতে পারি, সকাল সাড়ে ১০টায় ছুরিকাহত ও এসিডদগ্ধ আঁখি নামের হতভাগ্য তরুণী কাজী অফিস ছেড়ে জনাকীর্ণ ঢাকা শহরের রাস্তায় এসে বাঁচাও বাঁচাও করে চিত্কার করে। প্রায় আধা ঘণ্টা মেয়েটি সাহায্য চেয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। আঁখিকে ঘিরে জনগণের ভিড় বাড়ে। সেই ভিড়ে একজন বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিও ছিলেন না যিনি অন্তত অসহায় তরুণীটিকে হাসপাতালের বারান্দায় ফেলে রেখে যেতে পারতেন।

অনেক পরে অনেকটা দায়িত্ব পালনের মতই এসেছিলেন পুলিশের এএসআই বিশ্বজিৎ যিনি এসিডে ঝলসানো শারমিন আঁখিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। না, আঁখির জন্য সাহায্য চেয়ে কেউ তাকে ফোন করে ঘটনা জানান নি। তিনি এসেছিলেন মানুষের জটলা দেখে, ঘটনা কি জানতে উঁকি দিতে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন এসিডে ঝলসানো আঁখির নিথর দেহ।

এসিডে ঝলসে যাওয়া রক্তাক্ত মেয়েটি যখন সাহায্যের জন্য আমাদের কাছে হাত পাতে, জটলায় দাঁড়িয়ে থাকা আমরা কেউ এগিয়ে যাইনা। আমরা সিনেমার শ্যুটিং দেখার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখি। আমরা কেউ মেয়েটিকে তাত্ক্ষণিক প্রাথমিক চিকিত্সা দিয়ে ওর কষ্ট লাঘব করিনা, আমরা কেউ ওকে হাসপাতালে পৌঁছানোর কথা ভবিনা।

এসিডের যন্ত্রণায় কাতর মেয়েটি রাস্তায় গড়াগড়ি খেয়ে অবশেষে নিথর হয়ে পড়ে থাকে। আমরা সবাই তামাশা দেখি। কারণ আমরা কেউ উটকো ঝামেলা পছন্দ করিনা। আমরা ঝুটঝামেলাহীন শান্তিপ্রিয় বাঙালি জনগণ। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি কিভাবে এসিডে পুড়ে খসে পড়ে হতভাগিনীর দেহের বসন। আমরা কেমিস্ট্রি ক্লাসে পড়া থিওরিকে প্র্যাকটিক্যালি মিলিয়ে দেখি পুড়ে যাওয়া ওই হতভাগিনীর শরীরের সঙ্গে এসিডের মানব দেহে বিক্রিয়া। মেয়েটি যখন বাঁচাও বাঁচাও বলে সবার কাছে আর্তনাদ করে, তখন আমরা মানবিক সব কিছু উপেক্ষা করে জাগতিক কাজে মন দেই।

বিশ্বজিতকে যখন কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছিল দর্শকের মত সেখানে নিজেদের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন সাংবাদিকেরা। তারা ফটাফট ছবি তুলে তাদের দায়িত্ব পালন করছিলেন। বিশ্বজিতকে বাঁচানোর কোনরূপ চেষ্টাই তারা করেননি। ঠিক একি ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখি শারমীন আঁখির ক্ষেত্রে। আঁখির ঝলসানো শরীর নিয়ে কাতরানো, রাস্তায় পড়ে থাকা আঁখির নিস্তর দেহ সব কিছুই ক্যামেরাবন্দী হয়, কিন্তু দায়িত্বরত কোনও সাংবাদিককে দেখিনা আঁখিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে!! যেন ছবি তুলে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়াটাই মুখ্য!!এর বাইরে সাংবাদিক হিসেবে কোনও দায়িত্বই তাদের নেই।

সারাদিন সরকার এই করল না, বিরোধীদল সেই করল না বলে আমরা গলা ফাটিয়ে চিত্কার করি চায়ের কাপে, গলির মোড়ে, যেকোনো আড্ডায়। এই দেশটার কিচ্ছু হবে না বলে কতই না হাহাকার করি। কিন্তু যে কাজটা আমরাই করতে পারি, আমাদেরই করা উচিত, তা কি আমরা করি? জনবহুল রাস্তায় এসিডে ঝলসে যাওয়া মেয়েটিকে সরকার বা বিরোধীদের কেউ এসে সাহায্য করবে এই আশায় কি আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম? নাকি এখানেও রাজনীতির কোনও গন্ধ খোঁজার আশায় নিজেদের বিবেককে বিসর্জন দিয়ে শুধু আমাদের নোংরা নাকটাকেই সজাগ রেখেছিলাম?

জনাকীর্ণ শহরে এসিডে ঝলসানো আঁখি আর দিল্লির বাসে ধর্ষিতা দামিনীর মাঝে কি কোনও পার্থক্য আছে? দামিনীকে যখন নরপশুরা বাস থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল, বাঁচার জন্য সাহায্যের আকুতি জানিয়েছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখা আমাদের সাধারণ জনগণের কাছেই। কেউ আমরা এগিয়ে যাইনি। রক্তাক্ত আঁখি এসিডে পুড়ে সাহায্যের আকুতি জানিয়েছিল আমাদের সাধারণ জনগণের কাছেই। জটলায় দাঁড়িয়ে আমরাও তামাশা দেখছিলাম। কেউ আমরা এগিয়ে যাইনি। আমাদের বিবেক মরে গেছে। আমরা নিজেরাই যেখানে পচে  গেছি, ক্ষয়ে গেছি, সেখানে আমরা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখি কোন অধিকারে?  আছে কি এই প্রশ্নের জবাব কারও কাছে?

জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৩ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১২
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।