ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

কাশফিয়া ধর্ষণ

সাংসদ সিমিন হোসেন রিমির কাছে খোলা চিঠি

সুমি খান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৩
সাংসদ সিমিন হোসেন রিমির কাছে খোলা চিঠি

মাননীয় সাংসদ সিমিন হোসেন রিমি,  আপনি আমাদের ভীষণ শ্রদ্ধার এবং ভীষণ প্রিয় । একজন মানুষ হিসেবে আপনার কাছে আমি একটি মানবিক আবেদন জানাতে চাই।

ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন রিমি আপা, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের নেতা তাজউদ্দিন আহমদের কৃতি কন্যা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর এবং অটল থাকবেন এই প্রত্যাশা কি খুব বেশি চাওয়া?

আপনার এলাকার একটি অসহায় নির্যাতিতা কিশোরী কাশফিয়া বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, তাকে অমানবিক নির্যাতন করেছে আপনার এপিএস কাজল মোল্লা ও তার স্ত্রী রেখা। এ সংবাদ এরই মধ্যে গণমাধ্যমে এসেছে। আপনিও কাশফিয়াকে দেখে এসেছেন। কিন্তু তারপর?

এখনো আপনার দায়িত্বশীল কোন পদক্ষেপের কথা আমরা জানতে পারিনি। কাশফিয়ারা করুণা চায় না কখনো। আমিও কোনভাবেই কাশফিয়ার পক্ষ থেকে আপনার করুণা ভিক্ষা করতে বাংলানিউজের শরণাপন্ন হইনি। আমার বিবেকবোধ আর দায়বদ্ধতা থেকে আপনার কাছে এই খোলা চিঠি। জানি না আমার এ সামান্য চিঠি আপনার কাছে কোন গুরুত্ব পাবে কিনা। তবে  আশার কথা, উচ্চ আদালত এ বিষয়ে যে নির্দেশনা দিয়েছ, তাতে ধর্ষক কাজল মোল্লা, নির্যাতনকারী রেখা এবং তার সহযোগীদের আইনের আওতায় আসতে হবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
 
আপনি জানেন, কাশফিয়া (বাংলানিউজের দেওয়া ছদ্মনাম) আপনার এপিএস কাজল মোল্লার বাসায় পরিচারিকার কাজ করতো। কাজল মোল্লা তাকে ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণেই শেষ নয়। অসহায় এ কিশোরীকে কাজল মোল্লার স্ত্রী নির্মম নির্যাতন করেছে।

রিপোর্টে আরো জানা যায়, ৭ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় কাশফিয়াকে কাপাসিয়া উপজেলা সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায় তার বাবা। কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার খাজা হাবিব সেলিমের বক্তব্য অনুযায়ী, মেয়েটি সেদিন হাসপাতালে ভর্তির দুই-আড়াই ঘণ্টা পর তাকে তার বাবা রিলিজ করিয়ে নিয়ে যায়।

কাশফিয়া, তার পরিবার এবং স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছেন, পুলিশ এ ঘটনা নিয়ে লুকোচুরি খেলছে। কাশফিয়াকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে সন্ত্রাসীরা কোথায় কখন তাকে লুকিয়ে রেখেছে সবই জানতো পুলিশ। কিন্তু তাকে উদ্ধারের কোনো উদ্যোগই নেয়নি পুলিশ। কাশফিয়ার পরিবার সন্ত্রস্ত। তার বড় ভাই বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, কাশফিয়াকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তারা চরম আতংকে আছেন। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা তাদের নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। বাড়াবাড়ি করলে এলাকায় থাকতে পারবে না বলেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কাশফিয়ার পরিবার অভিযোগ করেছে, পুলিশকে জানানোর পরও পুলিশ তাদের সহযোগিতা করছে না।

কাশফিয়া এবং তার পরিবার আরো জানিয়েছে, গত ১৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় স্থানীয় যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক এবং সদর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য কানিজ ফাতেমা রুহিতার সহযোগিতায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা কয়েক দিন আগে কাশফিয়াকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর তাকে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখা হয়। কোথায় কখন তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে সবই জানতো পুলিশ। তারপরও পুলিশ তাকে উদ্ধারের কোনো চেষ্টা করেনি।

পুলিশ জানায়, কাশফিয়া গত কয়েক দিন ধরে বাড়িতেই ছিল। তাকে কেউ গুম করেনি। কিন্তু কাশফিয়া এবং তার পরিবার জানায়, শনিবার দুপুরে পুলিশ কাশফিয়াকে দুপুরের দিকে বাড়িতে দিয়ে যায়, তখন আসাদ এবং রুহিতাও সঙ্গে ছিলেন। এলাকাবাসী জানায়, বাংলানিউজ ইনভেস্টিগেটিভ টিম আসছে জেনেই কানিজ ফাতেমা রুহিতা পুলিশি নিরাপত্তায় কাশফিয়াকে বাড়িতে এনে রেখে যান। বিষয়টি বেমালুম চেপে যায় কাপাসিয়া থানা। বাংলানিউজ সাংবাদিক টিম থেকে টেলিফোন কল করে কাজল মোল্লার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে কাশফিয়াকে ধর্ষণ-নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেছেন; দেখা করতে রাজী হননি।
 
কাশফিয়াদের বাড়ি থেকে ওসি দেলওয়ারের সাক্ষাৎকার নিতে যায় ইনভেস্টিগেটিভ টিম। তখন স্থানীয় এমপি কাপাসিয়াতেই ছিলেন। পুলিশের কাছে এমপির অবস্থান জানতে চাইলে ওসি সাংবাদিকদের বলেন, “এমপির সঙ্গে তো এই মুহূর্তে যোগাযোগ করতে পারবেন না। কারণ তিনি ১০/১২ কিলোমিটার দূরে চালার বাজারে মিটিং করছেন। এলাকাটিতে যাওয়ার ভালো রাস্তা নেই। তাই যেতে পারবেন না। ”

ওসি যখন এই কথা বলছিলেন,  মাননীয় সাংসদ, আপনি  ঠিক সেই মুহূর্তে ভিকটিমের বাড়িতে গিয়েছিলেন বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন কাশফিয়া।

আপনি নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না, আপনার অবস্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রদান পুলিশের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পুলিশের এই লুকোচুরিই প্রমাণ করে তারা ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে।

রিমি আপা, ধর্ষণের মতো বর্বরতার পর ধর্ষিতাকে নির্যাতন যারা করেছে , তারা মানবতার চরম লঙ্ঘন করেছে। আর এই চরম অপরাধ এবং অন্যায় ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টা যারা করছে তারা সমান অপরাধে অপরাধী। একটি অসহায় মেয়ে এবং তার পরিবারের প্রতি মানবতার যে চরম অবমাননা করা হচ্ছে—এ ধারাবাহিকতা আপনার সার্বিক অবস্থান অনেক দুর্বল করে দেবে।

ঘটনার এখানেই শেষ নয়। কাশফিয়ার নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি দেলওয়ার বলেন, “আমার এলাকায় এ ধরনের কিছু হয়নি। মেয়েটি এধরনের কোনো অভিযোগ নিয়েও আসেনি। গত ১৭ জানুয়ারি মেয়েটি তার বাবার সঙ্গে থানায় এসে একটি জিডি করেছে। জিডির নাম্বর ৬৪৬। এতে বলা হয়েছে, পত্রপত্রিকায় এপিএস কাজলের বিরুদ্ধে নির্যাতনের যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা সত্য নয়। ”
 
জিডি সম্পর্কে কাশফিয়া জানায়, তাকে ও তার পরিবারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে গত ১৬ জানুয়ারি বিকেলে আসাদ এবং রুহিতা সাংবাদিকদের সামনে একটি কাগজ পড়তে বাধ্য করেছিলেন। সেই কাগজে যা লেখা ছিল তার ভাষা এবং জিডির ভাষা একই রকম বলে প্রমাণ পেয়েছে ইনভেস্টিগেটিভ টিম।

এ ঘটনায় আগে কোনো ধরনের জিডি বা ডিডি করতে আগ্রহী কেউ এ থানায় আসে নি বলে ওসি দাবি করলেও শনিবার জাতীয় মহিলা আইনজীবী পরিষদের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট সোহেল রানা ও কাশফিয়ার বাবা মামলা করতে থানায় গেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা হুমকি দিয়ে থানা থেকে বের করে দেন।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের সম্পাদকীয় টিম এবং এর এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন কে দায়িত্বশীল সংবাদ সংগ্রহ এবং পরিবেশনের জন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে হয়। পাঁচজন সংবাদকর্মীর একটি টিমের সরেজমিন অনুসন্ধানের মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে এনেছেন আলমগীর হোসেন, যা এদেশের সাংবাদিকতায় অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। এতোদিন এ কাজগুলো আমার স্বপ্নের মতো ছিল। এদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে দায়বদ্ধতার এ দৃষ্টান্ত অনন্য। প্রতিটি সংবাদমাধ্যম যদি এতোটুকু দায়বদ্ধতা অন্তত পালন করে, এ সমাজের অনেক অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। কমে যাবে অপরাধের মাত্রা। সেই দিনটির প্রতীক্ষায় রইলাম।
কাশফিয়ার প্রতি বর্বরতার তীব্র নিন্দা জানিয়ে আমার এই লেখা। আপনার মাধ্যমে দাবি জানাই এ সমাজকে যেন আর কোন কাশফিয়ার চোখের জল দেখতে না হয়। কাজল মোল্লা, রেখা, রুহিতাদের বিচারের মুখোমুখি করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক, যাতে আর কেউ এমন অসভ্য মধ্যযুগীয় বর্বরতার সাহস করার আগে তাদের পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে।

সবশেষে বলি, মাননীয় সংসদ সদস্য, আপনি সরাসরি নির্বাচনে নির্বাচিত স্বল্প ক’জন নারী সাংসদের অন্যতম। আপনাদের প্রতি এ সমাজের সচেতন এবং আশাবাদী মানুষদের অনেক প্রত্যাশা। আপনার সিদ্ধান্তগ্রহণে দুর্বলতা এদেশের আইন এবং শাসনব্যবস্থার প্রতি গণমানুষের আস্থাকে আগের চেয়ে আরো বেশি দুর্বল করে দেবে, যা নারীর ক্ষমতায়নের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে রিমি আপা। সুতরাং কোনভাবেই এটা হতে দেয়া যাবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোহেল তাজের প্রতিবাদী ভূমিকা ভুলে যায়নি জনগণ। তাই বলে তার মতো দায়িত্ব থেকে সরে এসে নয়, আপনার দায়িত্বে থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর থেকে সমাজের শুভশক্তিকে এগিয়ে নিতে হবে  বহুদূর..... অনেকদূর।

সুমি খান: অতিথি লেখকপ্রধান প্রতিবেদক, মোহনা টেলিভিশন
Sumikhan29bdj@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১১২৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৩
আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।