ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

গণমাধ্যম সাক্ষরতা আন্দোলন, শুরু হোক এখনই

তুষার আবদুল্লাহ, বার্তা প্রধান, সময়টিভি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৩
গণমাধ্যম সাক্ষরতা আন্দোলন, শুরু হোক এখনই

অভিযোগ উঠেছে সারাদেশ থেকে যে ধর্ষণের খবর পাওয়া যাচ্ছে, এজন্য গণমাধ্যমই দায়ী। গণমাধ্যমে ধর্ষণের খবরের ব্যাপক প্রচার নাকি প্রণোদিত করছে ধর্ষকদের।

তাই বেড়ে গেছে ধর্ষণের ঘটনা।

অভিযোগকারীদের যুক্তি দিল্লিতে বাসে ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার স্থানীয় গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণাই দেশে ধর্ষণের ঘটনা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের যুক্তির পক্ষের উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ায় বাসে গার্মেন্টস কর্মীর ধর্ষণের শিকার হওয়া। পাটুরিয়ার বাস চালক ও হেলপার দিল্লির গণধর্ষণের ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে বলেও তারা দাবি করছেন। ফুঁ দিয়ে অভিযোগ উড়িয়ে দেবো না। তবে অভিযোগের বিপক্ষে যুক্তি যারা তুলে ধরছেন তাদের বক্তব্যটাও বলি- ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে এটা তারা মনে করছেন না। তাদের মতে, ধর্ষণের ঘটনা, যৌন নিপীড়নের ঘটনা আমাদের চারপাশে নিত্যই হচ্ছে। কিন্তু সেটা মেয়ে এবং তাদের পরিবারেরা এতোদিন চেপে যাচ্ছিল, গণমাধ্যমে দিল্লির গণধর্ষণ এবং পরবর্তীতে টাঙ্গাইল, মধুপুরের ধর্ষণের ঘটনার ব্যাপক খবর পরিবেশন দেখে এখন নির্যাতিতা ও তার পরিবার অভিযোগ করতে সাহসী বা উ‍ৎসাহী হয়ে উঠছে। যে কারণে ধর্ষণের অভিযোগ বা ঘটনা প্রকাশের সংখ্যা গেছে বেড়ে। এটা গণমাধ্যমের একটা ইতিবাচক প্রভাব।

দিল্লির ঘটনার সময় থেকেই আমাদের গণমাধ্যম গুলো ধর্ষণের খবর পরিবেশনে নিজেদের সংশোধন করা শুরু করে। প্রথমত যে নির্যাতিতা তার নাম ও ছবি প্রকাশ না করা। পরবর্তীতে নির্যাতিতার পরিবারের সদস্যদের ছবি প্রকাশ না করা। নির্যাতিতার পরিবারের সদস্যদের সনাক্ত করা যেনো না যায়, সেজন্য কোন কোন টেলিভিশন তাদের কন্ঠস্বরও খানিকটা বিকৃত করে প্রচার করেছে। অনলাইন ও দৈনিক পত্রিকাগুলোর কোন কোনটি দিল্লীর নির্যাতিতা মেয়েটির মতো এখানেও নাম বদলে নতুন নাম দিয়েছে। এসবই ইতিবাচক দিক। তারপরও কোন কোন টেলিভিশন ও পত্রিকা যে ধর্ষণের খবর প্রচারের পুরনো সেই রগরগে ঢংটাই যে ধরে রেখেছে, স্বীকার করতে হয় সেই দুঃখজনক দিকটাও।

অভিযোগের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তির ঘাটতি হবে না। সকল যুক্তিকেই যৌক্তিক মনে হবে। তবে যে বিষয়টি আলোচনায় আনতে চাচ্ছি সেটা হচ্ছে ‘গণমাধ্যম সাক্ষরতা’। আমাদের কাছে প্রযুক্তি ও স্যাটেলাইট দুনিয়া উন্মুক্ত হয়ে পড়ায়, অন্তর্জাল ও টেলিভিশনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের দশদিকের জানালা খুলে গেছে। এক সময় বিটিভি’র ঘুলঘুলি দিয়েই আমরা গণমাধ্যমের আলো বাতাস পেতাম। আমাদের অভ্যস্ততা অতোটুকুতেই ছিল। কুঁয়োর ব্যাঙের মতোই। আচমকা আমরা কুঁয়ো থেকে সমুদ্রে পড়ে গেলাম। এবং সাঁতার শেখা হয়নি বলে ডুবে মরছি। এই সাতাঁর না জানাটাই হচ্ছে ‘গণমাধ্যম সাক্ষরতা’র অজ্ঞতা। আমরা গণমাধ্যমে যে খবর দেখছি, পড়ছি সেখান থেকে শিখছি কি? শেখাটা অবশ্য অনেক দূরের বিষয়। আসলে আমরা আমাদের সামনের সমুদ্রসম গণমাধ্যমকে কি পড়তে পারছি? পারছিনা। পড়তে পারছিনা বলেই গণমাধ্যমে খবর, গান, নাটক, সিনেমার মাধ্যমে যে বার্তাগুলো দর্শকদের জানানো হয়- দর্শক, পাঠকরা তা বুঝে উঠতে পারেন না। যৌণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সচতনতা তৈরির বিষয়ে খবর বা নাটক, সিনেমার মাধ্যমে তথ্য সরবরাহ করা হলেও, দর্শক-পাঠকদের অনেকেই উল্টো সেই নিপীড়ক হয়ে উঠেন, তার উদাহরণ অফুরন্ত। আবার গণমাধ্যম যে কেবল সচেতনতা তৈরির জন্যই খবর, অনুষ্ঠান প্রচার করছে তা নয়। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পাঠক, দর্শকের গণমাধ্যম সাক্ষরতা’র অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে, তারা যৌণ সুড়সুড়ি দেয়া, রগরগে সোজাসাপ্টা ভোগে প্রলুব্ধ করে এমন অনুষ্ঠানই পরিবেশন করছে বেশি। এটা যেমন বাংলাদেশে হচ্ছে, তেমনি হচ্ছে প্রতিবেশি দেশেও। সংস্কৃতির যা চল, তার বাইরের অনেক অনুসঙ্গ চলে আসছে এই দুই দেশের গণমাধ্যমে। যা কেবল পোশাকেই নয়, আচার-আচরণ, কথা-বার্তাতেও প্রতিফলিত হচ্ছে। ফলে সব বয়সের, সকল শ্রেণির পাঠক-দর্শকরা একে সহজে আত্মস্ত করতে পারছেনা। একটি বিষয়তো স্পষ্ট- গণমাধ্যমের পাঠক-দর্শক বা শিক্ষার্থী যাই বলিনা কেনো, এক ক্লাস রুমেইতো থাকে তাদের রকমফের। ফলে একই পরিবার ও গোষ্ঠীর দর্শকরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে গণমাধ্যম দ্বারা প্ররোচিত হচ্ছে রকমারী দিকে।

গণমাধ্যম সাক্ষরতা থাকলে পাঠক, দর্শকরা পত্রিকা, বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্রের কাছ থেকে গ্রহণ প্রক্রিয়াটি আত্মস্ত করতে পারতেন। এখন যে বিষয়টি চলছে যারা গণমাধ্যম পরিচালনা করছেন, অনুষ্ঠান তৈরি করছেন তারা এবং যাদের জন্য গণমাধ্যম উভয় পক্ষই সাক্ষরতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে যে বিষয় বা ঘটনাটি যেভাবে পরিবেশন করার কথা তা হচ্ছেনা- ফলে সাভাবিক ভাবেই অভিযোগ উঠছে ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ বা ইভ টিজিং’র খবর এধরনের আরো ঘটনা সৃষ্টিকে প্রণোদিত করছে। অন্যদিকে পাঠক, শ্রোতা, দর্শকরা গণমাধ্যমের শিক্ষণীয় ও ইতিবাচক তথ্য নেয়ার বিষয় গুলো দূরে ঠেলে দিয়ে শিখে নিচ্ছে-পরকীয়া, অপহরণ, খুন ও ধর্ষণের কৌশল। গণমাধ্যম সাক্ষর দান অক্ষর জ্ঞান দানের মতোই চট জলদি সম্ভব নয়। প্রয়োজন গণমাধ্যম সাক্ষরতার আন্দোলন। প্রাথমিক স্তর থেকেই একে পাঠ্যসূচিতে অর্ন্তভুক্ত করতে হবে। একাজে যতো বিলম্ব ঘটবে, গণমাধ্যম বিষ্ফোরণের কালো দিকগুলো ততোই সমাজ ও রাষ্ট্রে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশ সময় ১৭২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৩
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।