সম্প্রতি জনপ্রিয় অনলাইন দৈনিক বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জাহানারা ইমাম হলে জনৈক প্রথম বর্ষের ছাত্রীকে র্যাগিংয়ের নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত করার আর্তি জানিয়ে একজন সচেতন নাগরিক উপাচার্য বরাবর খোলা চিঠি লেখেন। বোঝা যায় যে, তিনি ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মহত উদ্দেশ্য নিয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছিলেন।
কিন্তু কথা হলো ঘটনা যদি গুজব হয়ে থাকে তবে এই গুজবের পরবর্তী এফেক্ট আমরা কী ভেবে দেখেছি?
খোলা চিঠির উত্তরে জাবি কর্তৃপক্ষ ছাড়াও সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা এই ধরনের র্যাগিংয়ের কোনো ঘটনা ছাত্রী হলে হয় নাই বলে দাবি করছে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, যে ছাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে এমন একটি খবর চাউর হলো, সেই নামের বা বিভাগের ছাত্রী জাহানারা হলে আদৌ ছিল না!! তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ালো যে র্যাগিংয়ের ঘটনা একটি গুজব ছাড়া আর কিছুই নয়।
ব্যক্তিগতভাবে আমি বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে শিক্ষা জীবনের পুরো সময় কাটিয়েছিলাম। পরবর্তীতে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর একটি ছাত্রীহলের হাউজ টিউটর হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করার সুবাদে ছাত্রীহলের নাড়ি-নক্ষত্র খুব ভালোভাবে জানার সুযোগ হয়েছে আমার।
খুব বেশিদিনের কথা নয়। কয়েক বছর আগে যেদিন আমার বাবার হাত ধরে প্রথম আমার নামে বরাদ্দ ছাত্রীহলের গেটে পা রাখি, সেদিন ছাত্রীহলের সামনে অনেক পোস্টার সাঁটা দেখেছিলাম। পোস্টারগুলোতে প্রধানত বিভিন্ন জেলার সিনিয়র আপুদের নাম লেখা ছিল, যারা মূলত তাদের এলাকা থেকে আগত নতুন ছাত্রীদের হলে সহায়তা করতে ইচ্ছুক। আর দেখেছিলাম হলের মধ্যে অনেক আপুদের জটলা, হাসাহাসি, গল্প গুজব। হলের মধ্যে পা রেখেই আমার সবাইকে এত আপন মনে হয়েছিল!! নাম কী, কোথা থেকে এসেছি, কোন ডিপার্টমেন্ট এসব ছোট ছোট প্রশ্ন সবাই আন্তরিকভাবে জিজ্ঞেস করেছিল। আমাকে হলে রেখে বিদায় নেবার সময় আমার বাবার বিষণ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে প্রায় সবাই এগিয়ে এসেছিল তাকে সান্ত্বনা দিতে। সবাই তাঁকে আশ্বস্ত করেছিল যে, এখানে সবাই পরিবারের মতই থাকে, একে অপরকে সাহায্য করে। আমার বাবা সেদিন নিশ্চিন্ত হয়ে মেয়েকে হলে রেখে ফিরতি ট্রেন ধরেছিলেন।
হল জীবনের প্রথম দিন আরও অনেকের সঙ্গেই আমাদের জায়গা হয়েছিল গণরুমে। গাদাগাদি করে অনেক বেড পেতে রাখা হয়েছিল সেখানে। সবার সাথে পরিচিত হয়ে আমরা আমাদের মন খারাপ ভাব কাটিয়ে নিয়েছিলাম।
নির্ঝঞ্ঝাট কাটিয়ে দিয়েছি হল জীবনের প্রথম রাত। দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু হয়েছিল বিভিন্ন ছাত্রী সংগঠনের সিনিয়র আপুদের আমাদের রুমে আগমন। মূলত তারা আসতো আমাদের খোঁজ খবর নিতে। কোনো অসুবিধা হলে যেন আমরা তাদের জানাই, তাদের সংগঠন এই সেই, ইত্যাদি ইত্যাদি পলিটিক্যাল আলাপ করে চলে যেত। আমরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এসব বড় আপুদের ভয় পেতাম এ কথা সত্যি, কিন্তু তাদের মধুর ব্যবহার যে আমাদের ভীষণ ভাল লাগতো, সে কথা না বললে মিথ্যে বলা হবে বৈ কী!! মাঝে মধ্যেই হলের ভিতরে মিছিল করার জন্য তারা আমাদের ডাকতে আসতো। আমরা রুমের লাইট বন্ধ করে ঘুমের ভান করে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকতাম। নন-পলিটিক্যাল সিনিয়রদের কাছে শুনেছিলাম যে, তাদের এই মিছিলে ডাকাডাকি নাকি মাত্র কয়েকদিনের, ওরিয়েন্টেশনের ঝামেলা শেষে ক্লাস শুরু হলে এই ডাকাডাকি এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। আসলেই তাই হয়েছিল। মাত্র কয়েকদিন তাদের এড়িয়ে চলেছিলাম। ব্যস এরপর মিছিলে বা আমাদের গণরুমে তাদের আনাগোনা বন্ধ হয়েছিল।
হল জীবনে আমি মনে করি খুব কম ছাত্রীর তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। বরং পড়াশুনা শেষ করে হলের মজার অভিজ্ঞতার কথাই বেশি মনে পড়ে। সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক, কেউ বাসা থেকে হলে এলে বা কারও বাবা-মা কিছু খাবার নিয়ে এলে সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়া, কেউ অসুস্থ হলে পালাক্রমে সেবা করা, কারও বাসা থেকে টাকা আসতে দেরি হলে সাহায্য করা, সবাই সবার সাথে যেন আত্মিক বন্ধনে আমরা হল জীবনে আবদ্ধ হই।
এখানে র্যাগিংয়ের মতো ঘটনা আমি আমার পুরো হল জীবনে দেখিনি।
এরপর যখন হাউজ টিউটর হয়ে ছাত্রীহলের দায়িত্বে এলাম, তখনও বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেখিনি। এ কথা ঠিক প্রায়ই ডাইনিং-এ খাবার এর মান বৃদ্ধি, মূল্য না বাড়ানো কিংবা বাথরুম এর ক্লিনিঙ্গ বা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ সমস্যা নিয়ে ছাত্রীদের অভিযোগের সম্মুখীন হতে হতো। কিন্তু কখনোই সিনিয়র দিয়ে জুনিয়রের শারীরিক বা মানসিক হয়রানি এমন কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। রুমমেট দ্বন্দ্ব মাঝে মাঝে হয় না তা নয়, কিন্তু সে রকম সমস্যা অভিযোগের গুরুত্ব বিচারে অন্য রূমে সিট বদলে আমরা সমাধান করে দিতাম।
মোটের উপর বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হল নিয়ে কিংবা মেয়েদের হলের জীবনযাপন নিয়ে যে নোংরা ধারণা হলের বাইরের মানুষ পেয়ে থাকে তা মোটেও সত্য নয়। হলে থাকা মানেই কোনো মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইদের মনোরঞ্জন এর বস্তু হয়ে ওঠে না, হলের মেয়ে মানেই নির্যাতনের শিকার নয়, হলের মেয়ে মানেই সতিত্ব বিলিয়ে দেওয়া কোনো নারী নয়।
যেকোনো সেনসিটিভ ইস্যু গণমাধ্যমে প্রচার করার আগে আমাদের অবশ্যই সত্যতা যাচাই করে নেওয়া নৈতিক কর্তব্য। কান চিলে নিয়ে গিয়েছে শুনে মাথার পাশে কান আছে কী নেই পরীক্ষা না করেই আর সবার মতো চিলের পেছনে ছুটতে শুরু করা সচেতন নাগরিকের ক্ষেত্রে শুধু বোকামি নয়, গুরুতর অপরাধও বটে!! কারণ এই গুজবের দ্বারা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট তো হয়ই সেই সঙ্গে সব থেকে আশংকাজনক হলো এই রকম গুজব ছড়িয়ে অভিভাবকদের মনে ছাত্রী হল তথা দেশের সামগ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আতংক সৃষ্টি করা হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে রটানো র্যাগিং গুজব শুধু উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এক্ষেত্রে এই গুজবে বাংলাদেশের মেয়েদের উচ্চশিক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
এভাবে ছাত্রীহলে থাকা মেয়েদের নোংরাভাবে উপস্থাপন করায় আদতে মেয়েদের ক্ষতি হচ্ছে। অভিভাবকেরা মেয়েদের হলে পাঠাতে ভয় পাবে। যাদের পিতামাতার সামর্থ আছে তারা হয়তো মেয়েকে হলে না রেখে বাসা ভাড়া
করে কিংবা বাড়ির আশেপাশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন। আর সারা জীবন হলে থাকা সমগ্র মেয়েদের উপর বিষদগার করে যাবেন। অন্যদিকে সামর্থহিন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মেধাবী মেয়েটির শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাড়ির পাশে কোনও কলেজে পড়তে হতে পারে মেয়েটির। এভাবে এইসব ভিত্তিহীন গুজব সামগ্রিক অর্থে মূলত মেয়েদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মেয়েদের সম্বন্ধে নোংরা ধারণার জন্ম দিচ্ছে।
শুধু তাই নয়, এইসব ভিত্তিহীন গুজব বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেদের সম্বন্ধেও রং মেসেজ দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছেলে মানেই সবাই নারীলোভী, চরিত্র খারাপ এমন ধারনা জন্ম নিচ্ছে। তাই এসব গুজব যাতে না ছড়ায় সে সম্বন্ধে আমাদের সচেতন হতে হবে।
যদি কখনো র্যাগিং নামক নোংরা সংস্কৃতি মেয়েদের হলে চালু হবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও দেখা দেয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। অংকুরেই বিনষ্ট করতে হবে নষ্ট ক্ষতিকর সংস্কৃতি।
আর সচেতন নাগরিক হিসেবে কোনও খবর প্রকাশ করার আগে সত্যতা যাচাই করে নেবার নৈতিক দায়িত্ব কিন্তু আমদেরকেই নিতে হবে। নতুবা গুজবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতি হবে মূলত আমাদেরই।
জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ১১৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৩
আরআর