ঐতো ক‘মাসই হলো বিশ্বজিতের নৃশংস হত্যার। সারা জাতি কি রক্তের ঐ চিহ্ন আজও মন কিংবা স্মৃতি থেকে ভুলে যেতে পেরেছে ? যাদের ন্যূনতম বিবেকবোধ আছে, হত্যা-নির্যাতন দেখলে যারা বিচলিত হয়, তাদের জন্যে বিশ্বজিতের হত্যা ঘুম হারাম করার মতো একটা ব্যাপার।
বিশ্বজিতের খুনি কারা ? এটা জানতে কি প্রশ্ন করতে হবে কাউকে? যাদের নাম এসেছে, তাকে কোপানোর চিত্র যারা দেখেছে তাদের সামনে সব কিছুই পরিষ্কার। সরকার জানে, প্রশাসন জানে। তাই তো ধরা পড়েছে বিশ্বজিতের হত্যাকারী।
এই হত্যাকারীদের মাঝে যাদের নাম এসেছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নাম এসেছে ছাত্রলীগের। ছাত্রলীগ কিংবা প্রশাসন কিংবা সরকার দায় বাঁচাতে বলতেই পারে, এ সন্ত্রাসীরা ছাত্রলীগের নয়। এরা বহিষ্কৃত। কিন্তু বললেই দায় থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ?
বিশ্বজিতের রক্তের দাগ শুকায় নি এখনও। কিন্তু ছাত্রলীগ ঠিকই আছে। ছাত্রলীগ-ছাত্রদল লড়াই তো আছেই। সিলেটের শতবর্ষী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস পুড়িয়ে উল্লাস করেছে কারা ? টিভি‘র ফুটেজ কিংবা মিছিলের চিত্র জানিয়ে দিয়েছে তা দেশের জনগণকে। আগের বছরের কথাগুলো না হয় বাদই দিলাম। তাদের ভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বে পুড়ছে যেন সারা দেশ। আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতে রক্তাক্ত লড়াইয়ে তারা নিজেরাই মরছে।
তাদের নিজেদের দ্বন্দ্বে এমনকি মরতে হয়েছে নিষ্পাপ দশ বছরের শিশু রাব্বিকে, ময়মনসিংহে। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেন রাজনীতির বিকারে আচ্ছন্ন কিছু বিকারগ্রস্ত শিক্ষক কিংবা ভিসি। এরা লেলিয়ে দেন ঐ ছাত্রলীগকে। আর তাইতো ভিসি‘র পক্ষ নিয়ে ছাত্রলীগ তাদের শিক্ষকদের উপর এসিড মেরেছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়,ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতিতে নাকি ভিসি‘র পক্ষাবলম্বন করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাণ্ডব ঘটিয়েছে ---এমনকি শিক্ষকদের উপরও। এ ঘটনাগুলো জাতিকে শুধু লজ্জাই দেয় না, গোটা শিক্ষাব্যস্থাকেই করে তোলে প্রশ্নের মুখোমুখি।
স্বাভাবিকভাবে তাই ছাত্রলীগ আজ প্রশ্নবোধক। মহাজোট সরকারের ঘরের শত্রু এখন ছাত্রলীগ--- যেন রামায়নের উল্লেখিত রাবণের ছোটভাই বিভীষণ। এই অসংখ্য বিভীষণই যেন বধ করছে আওয়ামী লীগকে। মহাজোট সরকারের উল্লেখযোগ্য সফলতাকে ম্লান করে এরাই সরকারের জনপ্রিয়তাকে টেনে নামাচ্ছে শূন্যের অতলে।
২) এই ছাত্রলীগ যখন বিশ্বজিতকে কুপিয়ে মারছিলো তখন পুলিশের তরুণ বড় অফিসার তা দূর থেকে দেখছিলেন, তার সম্মুখেই না-কি বিশ্বজিতকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো। এই অফিসার সংসদের বিরোধী দলীয় চিফ হুইপকে পিটিয়েছেন। সে চিত্রও দেখেছে বাংলাদেশের জনগল।
কিন্তু ঐ হারুনই পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট পদক (পিপিএম)। সবচেয়ে বিস্ময়ের সাথে আমাদের শুনতে হয়েছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সেই কথাটি ‘জয়নুল আবেদীন ফারুককে মারার ঘঠনাটিও’ না-কি তার পদক প্রাপ্তির বিবেচনায় স্থান পেয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ কথাটি তো কোনো ভব্যতা বা শিষ্টাচারের সাথে যায় না। কারণ বিরোধীদলের চিফ হুইপকে ‘পিটানো‘ শব্দটা মোটেও পজিটিভ কোনো শব্দ নয়।
যদিও জনাব ফারুকের ঐদিনের ভিডিও ফুটেজটি আমাদের আশাহত করেছে। তার কথাবার্তায় সংসদ সদস্য সুলভ আচরণ পরিলক্ষিত ছিলো না। হারুনের অন্য কোনো অবদান থাকতেই পারে পুলিশ বিভাগে, তা বিবেচনায় নিতেও পারে তাদের বিভাগ। কিন্তু সেজন্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটা সমালোচিত-নিন্দনীয় ঘটনার পক্ষ নেবেন, এটাতো আমরা আশা করতে পারি না।
৩) সোমবার বাংলাদেশে হয়ে গেছে আরেক তাণ্ডব। ইসলামী ছাত্রশিবির তাণ্ডব চালিয়েছে সারা বাংলাদেশে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটককৃত নেতাদের মুক্তির দাবীতে তারা বিক্ষোভের নামে চালিয়েছে এ তাণ্ডব। সারা দেশের প্রত্যেকটি জেলায় এমনকি উপজেলায় একযোগে পুলিশের উপর হামলা, গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ গুলি বিনিময় প্রভৃতিতে সারাটা দেশ যেন এক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিলো। এমনকি অর্থমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত গাড়িটিও রক্ষা পায় নি। এর আগেও আমরা দেখেছি পুলিশের উপর হামলার চিত্র। এবারেও দেখেছি গাড়ি পোড়ানোর দাউদাউ আগুন। শত-সহস্র শিবিরকর্মী পুলিশের উপর হামলে পড়েছে।
পুলিশ কি করলো! এর আগের দিন ঢাকার পুলিশ কমিশনার বললেন শিবির পেলে গুলির নির্দেশ দেবেন। পুলিশ কমিশনারের এরকম উক্তি বরং শিবিরকর্মীদের আরও মারমুখি। অথচ বাস্তবতা কি ছিলো ? সরকার বলতে গেলে ছিলো সহনশীল। পুলিশ মার খেয়েছে। ৩০ জন পুলিশ আহত হয়েছেন এরমাঝে গুলিবিদ্ধ অফিসাররাও আছেন।
বামপন্থিদের অহিংস হরতালে পুলিশ মরিচ (পিপার)স্প্রে ব্যবহার করে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিলো মিছিলকারী কিংবা মানববন্ধনকারী কর্মীদের। আমরা বলি না শিবিরের বিক্ষোভে পুলিশ স্প্রে ব্যবহার করুক,কিংবা গুলি করুক কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে তো মনে হয় ভালো কোন উদ্যোগই নিতে পারে নি নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ।
প্রশ্ন জাগে এত গরম কথাবার্তা বলেও তাণ্ডব থামাতে পারলো না কেন পুলিশ। লালবাগের ডিসি একজন হারুন একজন ফারুককে পেটাতে পারেন। কিন্তু হারুন কিংবা সেই ডিসি যিনি বলেছিলেন গুলি করবেন, তারা কি করলেন। গুলি আমরা চাই না।
কিন্তু দু‘শ গাড়ি বাঁচাতে পারলো না কেন পুলিশ। তাদের সতীর্থদের গুলি থেকে বাঁচাতে পারলো না কেন তারা। প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ে অবস্থানকালে তারই পাশাপাশি জায়গায় বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হলো। অর্থমন্ত্রীর নিরাপত্তা প্রদানকারী গাড়িটি হামলার শিকার হলো, নিরাপত্তা পুলিশ সমদস্যও আহত হলেন। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গোয়েন্দা বিভাগ এর আগে থেকেই এসব জানতো, সেজন্যেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিলো।
এমনকি পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদও সে কথাটারই প্রতিধ্বনি করলেন, কিন্তু আগাম তথ্য জানা সত্ত্বেও কেন তারা ব্যবস্থা নিতে পারলো না, সে উত্তর দিতে পারেন নি।
এমনকি মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ২১ টি বোমা বিস্ফোরিত হলো। সোমবারের সন্ত্রাসী তান্ডবের পর মঙ্গলবার খোদ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘঠলো এরকম বোমা হামলা। প্রশ্নতো আসবেই গোয়েন্দা বিভাগ কি করে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, ছাত্রলীগকে যে পুলিশ পাহারা দেয় বলে একটা কথা প্রচলিত আছে, সেই পুলিশই ছাত্র শিবিরকেও কি পথ করে দেয়------ পুলিশ পেটানোর কিংবা গাড়ি পোড়ানোর মওকা পায় কিভাবে তারা। এবং লাগাতার চালিয়ে যাচ্ছে তাদের তাণ্ডব।
আর এখানেই ছাত্রলীগ আর ছাত্র শিবিরের মাঝে কোন তফাৎ নেই। ভিন্নতা নেই এমনকি পুলিশের মাঝেও। ছাত্রলীগ পাহারা দিতে যেমন পুলিশ আছে, সেভাবে ছাত্রশিবির পাহারা দিতেও কি পুলিশ থাকে ? এ প্রশ্নটি আমাদের নতুন করে ভাবনা জাগায়। তাহলে গোয়েন্দা বিভাগ কি ব্যর্থ? অর্থমন্ত্রী কিন্তু সেরকম কথা-ই বলেছেন।
না-কি নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো গ্রুপ এ সহিংসতার পথ করে দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্নটা আসতেই পারে পুলিশ বিভাগেও কি জামাত-শিবিরের বাহিনী ঘাপটি মেরে বসে আছে।
সেজন্যে আমরা মিলিয়ে নিতে চাই ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের সাথে শিবির সন্ত্রাসীদের। সন্ত্রাসীদের কোনো জাত নেই, অন্য কোনো পরিচয় নেই। এরা ছাত্রলীগ করলেও সন্ত্রাসী, শিবির করলেও সন্ত্রাসী। শুধু সন্ত্রাসের মাঝে তফাৎটা একটা জায়গায়। ছাত্রলীগ সন্ত্রাস করে টেন্ডার আর চাঁদাবাজি নিয়ে, কিংবা সন্ত্রাসী হিসেবে লাইমলাইটে আসার জন্যে। আর শিবির সন্ত্রাস করে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বাঁচানোর জন্যে। শিবিরের বরং তার একটা নিজস্ব ‘আদর্শ’ কাজ করে। শিবির তাদের রাজনৈতিক দর্শন (!) কামিয়াব হওয়ার লক্ষ্যে চালিয়ে যাচ্ছে ঐ গোলাগুলি আর পোড়ানোর সংগ্রাম, দিতে চাচ্ছে মরণ কামড়।
যে যেভাবেই চালাক না কেন, এই সন্ত্রাস দেশটাকে দিন দিন নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সরকারের শেষ সময়ে এসে বিভীষণদের বাড়াবাড়ি দেশজুড়ে আওয়ামী লীগবিরোধী সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি শিবির সন্ত্রাসীরাও সুযোগ নিচ্ছে একের পর এক। আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। তাই ঐ বিভাগকে নিয়েই ভাবতে হবে। গোটা বিভাগটাকেই যেন ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। কে কিভাবে ব্যবহার করছে সরকারের ঐ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগটি, কোন কলকাঠি কি নড়ছে কোন অদৃশ্য হাতের ইশারায়, তা এখন ভেবে দেখার সময়। দমন করতে হবে শিবির সন্ত্রাসীদের, বন্ধ করে দিতে হবে ধর্ম নিয়ে খুন-খারবির রাজনীতি, রুখতে হবে ছাত্রলীগ নামক বিভীষণদের।
ফারুক যোশী: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Faruk.joshi@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৪স ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৩
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর