ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

নো ল্যান্ড ফর নারীজ!

মারিয়া সালাম, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৩
নো ল্যান্ড ফর নারীজ!

‘মাগো ভাবনা কেন?..........তোমার ভয় নেই মা, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি । ’

সেই ছোটবেলা থেকেই গানটি আমার খুব প্রিয়।

আমি খুব নিরীহ প্রকৃতির দেখে আমার মা আমাকে নিয়ে খুব ভয়ে থাকতেন ছোটবেলা থেকেই। ভয় পেতেন যে কোনো জায়গায় একা ছাড়তে। মায়ের সেই ভয় দেখে মনে মনেই হাসতাম, আর গেয়ে উঠতাম এই গান।

মায়ের সঙ্গে আমার বেশিদিন এক সঙ্গে থাকা হয়নি। বড় হয়েছি মামাদের কাছে। যখনই বিপদে পড়েছি, ভয় পেয়েছি, কষ্ট পেয়েছি, বুকে মুখ লুকিয়ে কান্না করার জন্য পাশে কাউকে চাইনি; মনে মনে গেয়েছি  ‘তোমার ভয় নেই মা, আমরা ( আমি ) প্রতিবাদ করতে জানি। ’

কত সহস্র বার এই একই গান গেয়েছি তার কোনো হিসাব আমি রাখি নি।

সৌভাগ্যই বলতে হবে। ছোটবেলা থেকেই খুব স্বাধীনভাবে ঘুরেছি। রাত নেই, দিন নেই মামাদের চোখরাঙানি-বকাঝকা সব হজম করে হৈ হৈ করে বন্ধুদের সঙ্গে ছুটে বেড়িয়েছি। একদিন বগুড়া তো অন্যদিন নাটোর। রাত করে ফিরেছি বাড়িতে, একটুও ভয় হয়নি। মনে ছিল অন্যরকম জোর আর সেই শক্তি যোগানো গান।

কিন্তু, যত দিন যাচ্ছে চারপাশের সবকিছু দেখে সেই জোর কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। গান গাইতে গেলেও গলায় যেন আর সে জোর পাই না। হঠাৎ, কিসের এতো ভয় আমার? প্রশ্নটা নিজেকে ইদানিং বারবার করি, আর ভাবি ভয় কি শুধু আমার? না, ভয় আজ এই দেশের প্রত্যেক নারীর, তা সে শিশুই হোক আর ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধাই হোন না কেন।

অ্যাসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, ইভ টিজিং, যৌতুকের দায়ে অত্যাচার এসব তো ছিলই, ইদানীং নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা।

নারী তুমি কোথায় নিরাপদ, কার কাছে নিরাপদ? যুতসই কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। বাবা, ভাই, স্বামী, ছেলে অথবা খুব কাছের কেউ, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি আর সম্পর্ক থেকে সম্পর্কভেদে অত্যাচারের মাত্রা ভিন্ন, ধরন ভিন্ন, কিন্তু কষ্টগুলো ফিরে আসে বারে বারে নতুন করে। ঘরে-বাইরে-কর্মক্ষেত্রে, কোথায় নেই নিরাপত্তাহীনতার ভীতি!

নারী সাংবাদিক রুনিকে হত্যা করা হলো, আর আমাদের নারী প্রধানমন্ত্রী বললেন, সরকার কারও বেডরুমে পাহারা বসাতে পারবে না। সে না হয় মেনে নিলাম, কিন্তু সুবিচার করতেও পারবে না, সেটা আমার মতো প্রতিবাদী গান গাওয়া মেয়ে কীভাবে মেনে নিতে পারে? আর মানবেই বা কেন?

বেডরুম ইস্যু না হয় বাদ দিলাম । একজন ডাক্তার যখন তার কর্মক্ষেত্রে গিয়ে ফিরছেন লাশ হয়ে, একটি ১১ বছরের শিশু খাবার দিতে যেয়ে হচ্ছে লালসার শিকার, একজন গারমেন্টস কর্মী নাড়ীর টানে বাড়ি যাওয়ার পথে নিজের সব খুঁইয়ে লজ্জায় মুখ ঢেকে কাঁদছে, তখন আমাদের সরকারের ভূমিকা কী? আর এসময় আমার মতো গান জানা প্রতিবাদী মেয়ের প্রতিবাদের ভাষাটা ঠিক কী, বুঝে উঠতে পারছি না।

আজ একজন প্রতিবন্ধী নারীও রেহাই পাচ্ছে না। হায়রে আমাদের দেশের প্রতিবাদী বীর জনগণ! রাস্তায় একা পেলেই, একটু বোকাসোকা পেলেই পিটিয়ে মারছে নারীদের। অথচ তাদের সামনেই যখন খুন করা হচ্ছে বিশ্বজিতদের, অপহরণ করা হচ্ছে পরাগদের, মন্ত্রীর এপিএসের গাড়ি থেকে পাওয়া যাচ্ছে ঘুষের টাকা, এমপির এপিএস ধর্ষণ করছে গৃহকর্মীকে ......সবাই যেন সেধিঁয়ে যাচ্ছে মায়ের পেটে, ভয়ে।

আর সুযোগ পেলেই পিটিয়ে মারছে ছিঁচকে চোর, অসহায় নারী, নিরপরাধ কলেজ ছাত্র আর নিরীহ কিশোরদের। ভয়ানক বীরত্বের কাজই বটে! কবি এখানে যেন নীরব।

ভূতের ভয় কোনোদিনই আমার পিছু ছাড়ে না। সেই ছোটবেলা থেকে আজ অবধি, দেশ থেকে বিদেশে। কাঠফাটা দুপুর হোক আর ভয়াবহ বৃষ্টির রাত, ভূতকে ভয় পাইনি, একথা বুকে হাত দিয়ে বলতে আমি পারবো না।

আজ মনে হচ্ছে আমার সবটাই যেন ভুলের ওপর দাঁড়িয়ে, আমি যে ভুলের দেশে জন্মেছি গো! এখানে প্রতিবাদী গান গেয়ে তোমাকে মরতে হবে বেঘোরে, বেইজ্জত হয়ে আর ভূতের চেয়ে ভয় পেতে হবে মানুষকে…………কজ দিস ল্যান্ড ইজ নট ফর ইউ…………….নো ল্যান্ড ফর নারীজ!

বাংলাদেশ সময়: ১৩০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।