ঢাকা: আমি ফেসবুক ব্যবহার করিনা। স্বীকার করি, হালের অনেক ঘটনা, অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির মনের ভাবনা যা কি না তারা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে প্রকাশ করে থাকেন এই সব আমার জানা হয় না।
স্বনামধন্য রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী মিতা হকের “ক্ষ” ব্যান্ডের আমার “সোনার বাংলা” গানটি নিয়ে তার লেখা ফেসবুক স্ট্যাটাস ব্লগের মাধ্যমে আজ আমার নজরে এসেছে। একজন ব্লগার ইংরেজিতে স্ট্যাটাসটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন যা হুবহু নিচে তুলে দিলাম,
“আজ, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, ছাত্রী, সুগায়িকা সেতুর বিয়েতে অংশগ্রহণ করে সিরাজগঞ্জ থেকে বাড়ি ফিরলাম। এসে কন্যা জয়িতার ল্যাপটপে আজ প্রথম ’ক্ষ’ ব্যান্ডের গায়িকা সোহিনী’র কণ্ঠে- ‘আমার সোনার বাংলা’ শুনলাম।
আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, প্রথমত যে বাদ্যযন্ত্রগুলো প্রিলিউড হিসেবে এবং পুরোটা গানের সঙ্গে বেজেছে, সেটি প্রশংসার দাবি রাখে পরিমিতি বোধের জন্য। গানটি আমরা যেভাবে গাই, গানের যে নোটেশন আমরা ফলো করি, সোহিনীও তাই করেছে।
এই মিউজিক ভিডিও’তে গানটা শোনার সাথে সাথে ভোকালিস্টের এবং মিউজিশিয়ানদের অভিব্যক্তি গানটির প্রতি তাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং পুরো উপস্থাপনাটিতে তাদের সিনসিয়ার ইমোশনের প্রকাশ আমাকে মুগ্ধ করেছে।
সোহিনী গানটির সঞ্চারী থেকে শুরু করেছে, এটি হয়ত নিয়ম বিরুদ্ধ, কিন্তু মেয়েটির গানের সঙ্গে তার আত্মিক সংযোগ আমাকে একটা নির্মল দেশপ্রেমের আভাষ দিয়েছে। সেই ক্ষেত্রে সোহিনীর এই সঞ্চারী থেকে গান ধরাটাকে আমি গুরুত্ব দেব? নাকি গভীর দেশপ্রেম নিয়ে ৪ জন্য ভিনদেশি বাদক নিয়ে কোন অতিরঞ্জণ ছাড়া সুন্দরভাবে একটি সঙ্গীত শুরতে পাওয়াটাকে গুরুত্ব দেব? গানটি আমাকে কমপ্লিটলি মিউজিকাল মনে হয়েছে। সেখানে মেয়েটি প্রপার ইমোশন দিয়ে এবং অসম্ভব সুরে গানটি গেয়েছে, গানটিকে সুখশ্রাব্য করেছে।
আশা করি গানটি নিয়ে মতামতের যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে সেটি এরপর বিলুপ্ত হবে।
সোহিনী এবং তার মতো আরো ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রনাথের গানকে এভাবেই প্রাণে ধরুক পরিমিতি বোধ এবং সততা নিয়ে এই শুভ কামনা।
মিতা হকের ফেসবুক স্ট্যাটাসের লিংক –
https://www.facebook.com/notes/mita-huq/khio/341547939294650”
সম্মানিত পাঠক, স্বনামধন্য শিল্পী এই মিতা হকই গত ২৮ জানুয়ারি, ২০১৩ তে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমকে “সোনার বাংলা” গানটি নিয়ে নিম্নের উক্তি করেছিলেন।
“জাতীয় সঙ্গীত ভুলভাবে গেয়ে কেউ পার পেয়ে যেতে পারে না”
শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতের অন্যতম শিল্পী মিতা হক আরও বলেন, “….কাজটিকে ন্যক্কারজনক বলে মত দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কালোত্তীর্ণ শিল্পী মিতা হক বাংলানিউজকে বলেন, সারাজীবন এসব উল্টোপাল্টা অপসংস্কৃতির চর্চার বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। এদের বিষয়ে কথা বলার রুচিও হারিয়ে ফেলেছি।
তিনি বলেন, ‘ক্ষ’ অনেক দূরের একটি বিষয়। এদের নিয়ে কথা বলতে চাই না। তবে একটি কথা বলবো শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ছেলে মেয়েরা এমন কাজ করতে পারে না। যারা বাংলাদেশের ইতিহাস পড়েছে, যারা বাংলার রূপ দেখেছে, সভ্যতা সংস্কৃতির কথা জেনেছে তারা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে এমন অপকর্মে লিপ্ত হবে না। ”
বিজ্ঞ পাঠক, এখন আপনারাই বলুন মিতা হক কি স্ববিরোধীতা করছেন না? তিনি যদি ২ ফেব্রুয়ারি কন্যা জয়িতার ল্যাপটপে প্রথম ’ক্ষ” ব্যান্ডের গায়িকা সোহিনী’র কণ্ঠে- ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি শুনে থাকেন, তবে না শুনেই কেন ২৮ জানুয়ারি বাংলানিউজকে সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন? এটা কি একজন প্রতিথযশা শিল্পীর দায়িত্বহীনতা ও মিথ্যাচার নয়?
আমরা যেকোনো তর্কে বিতর্কে তাঁদের বিশেষজ্ঞ মেনেই রেফারেন্স প্রদান করে থাকি। আর তারাই যদি এক মুখে দুরকম কথা বলে থাকেন, তবে বিভ্রান্তি বাড়ে বৈ কমে না।
আপাতত পল্টিবাজ রাজনীতিবিদদের মত কিছু না শুনেই গণমাধ্যমে মন্তব্য করার অপরাধ থেকে মিতা হককে সাময়িকভাবে দূরে রেখে সমালোচিত "ক্ষ" ব্যান্ডের "আমার সোনার বাংলা" নিয়ে কিঞ্চিত বিশ্লেষণ করি।
এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, মিতা হক "আমার সোনার বাংলা" গানটিকে রবীন্দ্র ও জাতীয় দুই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে থাকতে পারেন(?)। মিতা হকের কথানুযায়ী ধরে নিচ্ছি যে, রবীন্দ্র সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া গানটি ঠিক ছিল, কিংবা গায়িকা সোহিনীর কথা মত, রবীন্দ্র সঙ্গীত কিছুটা এপাশ-ওপাশ করে গাইলেও এমন কোনও দোষের কিছু না। কিন্তু গানটি যখন একটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃত তখন মূল কথা ও সুরকে এপাশ ওপাশ করে গাওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।
বাংলানিউজ লাইভ আড্ডায় সোহিনী আলম বলেছেন, "আমার সোনার বাংলা" শুধুই রবীন্দ্র সঙ্গীত হিসেবেই তারা গেয়েছেন। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এই গানটি তারা প্রথম রিলিজ দেয় ২৬ মার্চ, এর পর এই গানের ভিডিও রিলিজ করে ১৬ ডিসেম্বর।
শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতই যদি হবে, তবে তারা এই গানের জন্য আমাদের স্বাধীনতা ইতিহাসের বিশেষ দিনগুলোকেই কেন বেছে নিয়েছিল? তবে কি তারা লাইম লাইটে আসার জন্য ইচ্ছে করেই আমাদের জাতীয় সঙ্গীতকে বেছে নিয়েছে? এছাড়াও যদি রবীন্দ্র সঙ্গীত হিসেবে গানটি তারা গেয়েও থাকে, তাহলে জানতে চাই, প্রবাসে বড় হওয়া সোহিনী কী জানে না যে এটা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত!!
গানটিকে যতই তারা সঞ্চারী থেকে শুরু করে জাতীয় সঙ্গীত থেকে ভিন্নতা আনার দাবি করুক না কেন, এ কথা তো সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবে যে, আমার “সোনার বাংলা” যতটা না রবীন্দ্র সঙ্গীত তার থেকে বাঙালি জাতির কাছে তা "জাতীয় সঙ্গীত" হিসেবেই সুপরিচিত।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘সোনার বাংলা’ গানটি এ দেশে ব্যাপকভাবে গাওয়া হয় ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলনের সময়। স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় আপামর জনগণের মনে বিশেষ স্থান করে নিয়েছিল গানটি।
গানের প্রতিটি লাইনে রয়েছে বাংলা মাযের প্রতি অভূত ভালোবাসা। ১৯৭১ সালে এই গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচার হতো। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে গানটির প্রথম ১০টি লাইন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃত হয় (সুত্র: উইকিপিডিয়া)। এ গান আমাদের সংগ্রামী চেতনার সঙ্গে যেমন গাঁথা হয়ে গেছে তেমনি জড়িয়ে আছে আপামর জনগণের অসীম ভালোবাসায়।
অনেকেই দাবি করছেন যে, গানটি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে দেশপ্রেমের জন্ম দিচ্ছে, গান শুনে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুন প্রজন্ম চোখের পানি ফেলছে। জানতে চাই, গানটি কি হিসেবে দেশপ্রেমের জন্ম দিচ্ছে? রবীন্দ্র নাকি জাতীয় সংগীত হিসেবে? রবীন্দ্র সঙ্গীত হিসেবে দিলে অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।
কারণ আমাদের তরুণ প্রজন্মের নড়বড়ে দেশপ্রেমকে জাগিয়ে তুলতে হয়তো এরকম একটি সঙ্গীতের বড় দরকার ছিল!! আর যদি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে দিয়ে থাকে তবে প্রশ্ন থেকে যায়। জাতীয় সঙ্গীত যে ল্যাপটপে বা আই প্যাডে যত্রতত্র যেকোনো অবস্থায় সর্বদা শোনা জাতীয় সংগীত বিধিমালাতে নিষেধ আছে, সে কথা কি আমাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তরুণ প্রজন্ম জানে?
জাতীয় সঙ্গীত শুনে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলাটা যদি উদ্দেশ্যই হতো, তবে যত্রতত্র জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া ও শোনার অনুমতি জাতীয়ভাবেই প্রদান করা হতো। বছরে যদি অন্তত ৩/৪ বারও জাতীয় সঙ্গীত আমরা শুনে থাকি তাতে কি আমাদের দেশপ্রেমে ঘাটতি পড়বে?
জাতীয় সঙ্গীত আজ "ক্ষ" গাইছে একভাবে, কাল "ন্" গাইবে আরেকভাবে, পরশু "শ" গাইবে আরেকভাবে। এভাবে সবাই যদি সবার মনমত জাতীয় সঙ্গীতকে রবীন্দ্র সঙ্গীত হিসেবে ট্রিট করে এক্সপেরিমেন্ট করা শুরু করে, তবে ভবিষ্যতে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত স্বকীয়তা হারানোর আশংকা থেকে যায়। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কোন ভার্সনে জাতীয় সঙ্গীত গাইবে তা নিয়ে হবে কনফিউজড, যা কখনোই একটি জাতির জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
একাত্তরের রক্তক্ষয়ী এক সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি স্বাধীন একটি দেশ, একটি মানচিত্র। আমরা পেয়েছি আমাদের দেশপ্রেমের চেতনায় আবৃত একটি জাতীয় সঙ্গীত। মনে রাখা দরকার যে, ‘সোনার বাংলা’এখন শুধু রবীন্দ্র সঙ্গীত নয়, বাঙালি জাতির জাতীয় সঙ্গীত যার সঙ্গে যুক্ত আছে আমাদের ইতিহাস, আমাদের স্বাধিকার চেতনা।
জিনিয়া জাহিদ,বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নরওয়ে থেকে "ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ইকনমিক্স" এ এমএস শেষ করে বর্তমানে তিনিঅস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন। অস্ট্রেলিয়াতে তিনি বাংলাদেশের "খাদ্য নীতি"নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেনিয়োজিত আছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১২
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর