বেশ কিছুদিন ধরে জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া নিয়ে বিতর্ক চলছে। ‘ক্ষ’ ব্যান্ডের ভোকাল সোহিনী আলমের বিকৃত সুরে গানটি গাওয়া নিয়েই এই আলোচনা-সমালোচনা।
প্রথমেই বলতে চাই, সঙ্গীতটিকে আধুনিক করার যথেষ্ঠ চেষ্টা চালানো হয়েছে। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, আর হঠাৎ মধ্য থেকে শুরু করে এভাবে ‘জাতীয় সঙ্গীত’ হয়তো আজ পর্যন্ত কেউ শোনেনি। শনিবার বাংলানিউজের লাইভ অনলাইন আড্ডায় গায়িকাও যথার্থ বলেছেন, তিনি তো আর জাতীয় সঙ্গীত গাননি। তাহলে কি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন। হ্যাঁ তাই তো গেয়েছেন তিনি। যদিও অনেক শ্রোতাই যারা রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন না, বুঝতে ভুল করতে পারেন এটি কি লালনগীতি, মৌসুমী ভৌমিকের কোনো আধুনিক গান, নাকি অত্যাধুনিক রবীন্দ্রসঙ্গীতই শুনছেন। সাহিত্যের একজন শিক্ষার্র্থী হিসেবে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, হঠাৎ রবীন্দ্রসঙ্গীতের আধুনিকীকরণের কি প্রয়োজন পড়লো আমাদের। শত বছর আগের এই নোবেলজয়ী আজো কেন তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের জনক। তারপর কত কবি এসেছেন, আবার হারিয়েও গিয়েছেন, তবে কি কবির ভাষায় বলতে হয় ‘কিসের মহিমায় পাঠক হৃদয়ে আজো তিনি বেঁচে রইলেন। ’
সৃজনশীলতার কথা বললেই বাহবা। কিন্তু একবার ভাবুন তো সৃজনশীল কিছুকে সৃজনশীল করাটা সরকারি স্কুলকে সরকারি করার মতো নয় কি। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে সৃজনশীল ‘ক্ষ’ নামের এই ব্যান্ডটি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত নিয়ে ‘বিকৃত’ সুরে গেয়ে সৃজনশীল হওয়ার কি প্রয়োজন ছিল। মৌলিক কোনো গান কম্পোজ করেই না হয় সৃজনশীলতার পরিচয় দিতেন একবিংশ শতাব্দীর এই সঙ্গীতশিল্পী।
বাংলানিউজের লাইভ আড্ডায় সোহিনী বলেছেন, রবীন্দ্রনাথকে কেউ দেখেনি কিংবা কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। তাই রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন ভিন্ন লোকের কাছে ভিন্নরকম। কিন্তু আমি গায়িকা সোহিনীকে বলতে চাই- রবীন্দ্রনাথ আর তার শিল্পকর্ম বুঝবার জন্য তাকে দেখবার দরকার হয় না। তাকে অন্তরে লালন করতে হয়। একটু সহজ করেই বলি, পথেঘাটে চলতে ফিরতে বাংলাসিনেমার অনেক গান যেভাবে শোনা যায়, রবীন্দ্রসঙ্গীত কিংবা নজরুল গীতি সেভাবে শোনা যায় না। কারণ এই গানের ভাবার্থ আর মাহাত্ম্য বুঝতে হলে শ্রোতাকেও সেই দাবি পূরণ করতে হয়। রবীন্দ্রসঙ্গীত কখনোই কানের সস্তা শ্রুতি তৃপ্ত করে না। বরং মনের খোরাক মেটায়। তাই ইউটিউবে গানের শ্রোতা সংখ্যা দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উচ্চতা পরিমাপ করা সম্ভব নয়, যেটি অনেকের কাছে অবশ্য বিখ্যাত হওয়ার মাপকাঠি হিসেবে গণ্য হতে পারে।
অ্যারিস্টটল, ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো বিশ্বখ্যাত মনীষীরা বলেছেন, “শিল্পের মুখ্য উদ্দেশ্যে হলো আনন্দদান”। তাই হয়তো অনেকেই এভাবে বলতে চেয়েছেন, “আমার ভালো লেগেছে তাই গাওয়া সার্থক হয়েছে। ”
ইতিহাস থেকে জানা যায়- প্লেটো তার রাজ্যে সকল কবিতার বই প্রকাশ নিষিদ্ধ করেছিলেন। কারণ কবিদের বিভ্রান্তিমূলক কবিতা মানুষের রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় চেতনাবোধ অবক্ষয় ঘটাতে শুরু করেছিল। যা-ই হোক, মাথা কেটে কখনো মাথাব্যথা নিরাময় করা যায় না। কিন্তু একটি কথা ভেবে অবাক লাগছে, প্রায় আড়াই হাজার রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে ‘ক্ষ’র জাতীয় সঙ্গীতকে ‘বিকৃত’ করে গাইবার সাধ কেন হলো। লন্ডনে বড় হয়েও রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন ওই শিল্পী। কিন্তু একটি দেশের ‘জাতীয় সঙ্গীত’ সম্বন্ধে নয়? নাকি রাতারাতি আলোচনায় আসার জন্য এর চেয়ে সহজ পন্থা আর কিছু তিনি খুঁজে পাননি।
সোহিনী আলম বাংলানিউজের আড্ডায় মৌলিক গান করবেন কিনা—এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেন, বাংলা তার দ্বিতীয় ভাষা। তাই এই ভাষায় কাজ করবেন। তবে এখন তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি ও লালন নিয়ে কাজ করছেন। আমি আবার দ্বিধায় পড়ে গেলাম-‘বাংলা তার দ্বিতীয় ভাষা’! বিদেশে কারও কৈশোর কাটলে কি তবে বাংলা দ্বিতীয় ভাষা হয়ে যায়। বাংলা যদি তার দ্বিতীয় ভাষাই হয়ে থাকে তবে এই ভাষা নিয়ে এত বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন কেন। তার প্রথম ভাষা নিয়ে কেন সৃজনশীল কিছু করছেন না।
তিনি ওই আড্ডাতে আরো বললেন, সাদি মহাম্মদ তার মাঝ থেকে গানটি শুরু করার বিষয়টিকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমতুল্য বলেছেন। আর এটি নাকি তাকে বেশ কষ্ট দিয়েছে। কারণ রাষ্ট্রদ্রোহিতার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এটা ভেবে শিল্প প্রিয় মানুষদের খুব অদ্ভুত লাগতে পারে একটি গান গাওয়ার শাস্তি কি তবে ফাঁসি? কিন্তু এটি শুধু একটি গান নয়, আমার স্বাধীনতা, স্বকীয়তা আর সার্বভৌমত্বের প্রতীক। একথাটি হয়তো বিদেশে লালিত-পালিত, শিক্ষিতা গায়িকা সোহিনী আলমকে নতুন করে বলে দিতে হবে না।
লেখক: ইসরিত ইয়াসমিন
শিক্ষার্র্থী (ইংরেজি সাহিত্য), নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৩
আরআর