ঢাকা: হারিয়ে যাওয়ার গল্প-১: আলীম (ছদ্মনাম) বাংলাদেশি একজন তরুণ। বয়স আনুমানিক ২২, আনুমানিক কারণ এই ছেলেটি তার নাম, ঠিকানা, বয়স, বাবা-মার নাম কোনো কিছুই বলতে পারে না।
না, এটি মানসিক প্রতিবন্ধী কোনো যুবকের গল্প নয়। একজন তরতাজা তরুণের গল্প, যে হয়তো পেটের দায়ে পাড়ি জমিয়েছিলো মালয়েশিয়ায়। কবে, তা আমি জানতে পারিনি। তবে, এটুকু জেনেছিলাম, গল্পটা যখন শুনছিলাম সে তার চেয়েও বছর দু’য়েক আগে ছিল মালয়েশিয়ার একটি জেলে, তারপরে একটি ডিটেনশন ক্যাম্পে। এটি এমন এক জায়গা যেখানে মালয়েশিয়ার অবৈধ অভিবাসীদের রাখা হয়, তাদের সাজার মেয়াদ শেষ হবার পরে, যতদিন না তারা দেশে ফিরতে পারে। কেউ কেউ ফেরে, আর বাকিরা আলীমের মতো পাগল হয়ে আমৃত্যু প্রহর গোনে ‘গুস্ত’ দিয়ে ভাত খাবার জন্য।
শুনেছি সেদেশে জেলও বরং ভালো, কারণ পচা-বাসি যাই হোক অন্তত পেটপুরে খাবারটা তো পাওয়া যায়, কিন্তু এ ক্যাম্পে বেচেঁ থাকাই যেন স্বপ্নের মতো।
হারিয়ে যাচ্ছে আলীম……………..।
হারিয়ে যাওয়ার গল্প ২
অ্যারেস, ২৮ বছরের ইন্দোনেশিয়ান তরুণ। স্বচ্ছল ভবিষ্যতের স্বপ্ন চোখে নিয়ে একদিন উঠে বসেছিল মালয়েশিয়াগামী একটি ছোট জাহাজে, তবে অবশ্যই অবৈধভাবে।
বিধি বাম, জাহাজটিতে আগুন লেগে যায়, প্রায় সবাই মারা যান, বেঁচে যান অ্যারেস (মারা গেলেই হয়তো বেঁচে যেতেন)। আহত হন, পুরো পিঠ-ই আগুনে ঝলসে যায়। সে অবস্থাতেই ধরা পড়েন। নামে মাত্র চিকিৎসা হয়, জেলও হয়, জেলেও কিছু চিকিৎসা হয়, তারপর যেতে হয় ক্যাম্পে। সামান্য চিকিৎসা সেবাটিও বন্ধ হয়ে যায়। ছেলেটির পিঠের স্থানে স্থানে হঠাৎ ফেটে যায়, হলুদ তরল বের হয়, ঘা হয়ে যায়, বেচারা চিৎ হয়ে শুতে পারে না কতোদিন, সামান্য স্পর্শেই ব্যথায় কাতরে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে, না করেও উপায় নেই, কে বাঁচাবে তাকে, দেশে খবর গেলেও তার পরিবার কি পারবে আবার এতগুলো টাকা খরচ করে তাকে ফিরিয়ে নিতে?
হারিয়ে যাওয়ার গল্প ৩
আন, ২৫ বছরের মিষ্টি চেহারার একটি মেয়ে। মালয়েশিয়ায় এসেছিলেন জীবিকার তাগিদে অবৈধ উপায়ে। বেশ ভালই ছিলেন প্রথম একটি বছর, ভালবাসা হয়েছিলো নেপালি এক ছেলের সঙ্গে, দু’জন থাকতেনও এক সঙ্গে। তারপর একদিন ধরা পরেন ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে, তখন সে সন্তান সম্ভবা। তিন মাসের জেল, তারপর সোজা ডিটেনশন ক্যাম্পে। টাকা খরচ করে তাকে ছাড়ানোর মতো বা দেশে ফেরত পাঠানোর মতো পরিচিত কাউকেই পাওয়া গেলো না, তার ছেলেবন্ধুটিও যোগাযোগ করলো না ( হয়ত নিজে ধরা পড়ার ভয়ে)।
আনের আর কোনো উপায় রইলো না…………..আমৃত্যু কোনো সুযোগের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া। সান্ত্বনা শুধু একটাই, তার সন্তানটিকে (যদি সে জীবিত থাকে) তার সঙ্গে এখানে থাকতে হবে না, বাচ্চাটিকে হয়তো রাখা হবে স্থানীয় কোনো অনাথ আশ্রমে অথবা হোমে, আর আন হারিয়ে যাবে চিরতরে, সবার অগোচরে।
গল্পগুলো আমাকে শুনিয়েছিলেন এ ক্যাম্প ফেরত এক ভাগ্যবান বাংলাদেশি যুবক- মুকুল।
মুকুল তিনমাস ছিল এমনই এক ক্যাম্পে। অনেক কাকুতি মিনতি করে, দেশে ফিরে টাকা শোধ দেবে এই শর্তে পাকিস্তানি এক বন্ধুকে সে রাজি করিয়েছিলো দেশে ফিরতে সাহায্য করতে। মুকুল মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলো আর দশজনের মতো বড়লোক হওয়ার জন্য।
দশটি বছর ভালোই কেটেছে...ফুটপাথ থেকে ফাইভ স্টার হোটেল... সেখান থেকে জেল । অন্য আরেকজন বাংলাদেশিই নাকি তাকে হিংসা করে ধরিয়ে দিয়েছিলো। জেলে ছিল তিন মাস, পরে স্থান হয় ক্যাম্পে। ভাগ্য ভালো দেশে ফিরে আসে দেড় বছর আগে, নরক যন্ত্রণা ভোগ করে।
তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এক প্রাক্তন সহকর্মীর ফিল্মের সেটে। ফিল্ম মানেই হৈচৈ, মাতামাতি, কাজের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা। শুধু মুকুল মামাকেই ( সবাই মামা বলেই ডাকছিলো) দেখলাম একদম চুপচাপ, সিগারেটের পর সিগারেট ফুঁকে চলেছে, অস্থির, উদাস, ভিড় থেকে দূরে ।
প্রথমে ভাবলাম ফিল্মের লোক বলে ভাব বেশি, কিন্তু চোখাচোখি হতেই মনে হলো কি যেন একটি কষ্ট তাকে তাড়া করে ফিরছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম, বললাম, “কি মামা রাতে ঘুম হয় ৎনি নাকি, এমন লাগছে যে?” বেশ নিস্পৃহ উত্তর এলো, “আজ দেড় বছর আমি ঘুমাতে পারি না, তন্দ্রার মতো হয় আর কি!”
কথা এগিয়ে চললো, মানে আমিই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার করলাম। শুনলাম তার প্রবাসের গল্প, জেলের গল্প, কষ্টের গল্প। সে জানালো সে আবার ফিরে যাবে। আমি বললাম, “সে কি মামা, আবার সেই নরকে, ধরা পরলে আবার জেল, আবার ক্যাম্প, আর এবার কি ফিরতে পারবেন?”
বেশ দৃঢ় উত্তর এলো, “আমার যেতেই হবে ভাগনি। ” আমি বাঁকা চোখে বললাম, “ কি মামা, গার্লফ্রেন্ড?” সে বললো, “ সে একজন ছিল, তবে এবারের ফিরে যাওয়া তার জন্য নয়। ” তবে? প্রশ্নটি এমনিতেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর যা শুনলাম, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, এরকম অসহায় বোধে অনেক দিন ভূগিনি।
সে জানালো, “ আমি ফিরে যাব আলীম, অ্যারেস আর আনের জন্য। ওদের কথা দিয়েছিলাম ওদের বের করে আনব, যেভাবেই হোক। ভাগনি, আপনি জানেন আমি আজ দেড় বছর একটা দিনের জন্যও মাংস দিয়ে ভাত খেতে পারিনি। ”
আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। সে ধাক্কা না সামলাতেই তিনি হঠাৎ করে বেশ অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, “আপনার কি মনে হয় অ্যারেস বেঁচে আছে ? অথবা ওরা এতদিনে কোনোভাবে বের হয়ে গেছে? ”
কি বলব বুঝে ওঠার আগেই সে অস্থির পাঁয়চারী শুরু করে দিলো। ক্ষীণ একটি বাক্য কানে এলো, “মেরে আনেতাক ইনতেজার কারনা অ্যারেস, টিকে রাহেনা ইয়ার। ”
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে মুকুল মামা কি পারতেন না, আলীমের আসল পরিচয় জানতে আর আন ও অ্যারেসের দেশের ঠিকানায় খবর দিতে? আমার সাংবাদিক মনেও একই প্রশ্ন উঁকি দিয়েছিলো। উত্তরও পেয়েছিলাম, সেটি গ্রহণযোগ্য কিনা তা পাঠকই বিবেচনা করবেন।
মামার উত্তর ছিল: নথি ঘাঁটলে হয়তো আলীমের পরিচয় পাওয়া যেতো, দেশে তার পরিবারকে জানানো যেতো, কিন্তু, সে সময় তার পক্ষে এ কাজটি করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। একজন জেল খাটা অবৈধ অভিবাসী হয়তো এতটা সাহস আর বুদ্ধি রাখে না।
আন থাকতো মহিলা ক্যাম্পে, তার সঙ্গে মুকুলের দেখা হয় মাত্র দু’দিন, কোর্টে হাজির হবার সময়। আর আসার সময় দেখা করার সুযোগ হয় নি।
অ্যারেস অবশ্য তার পরিবারকে একটি চিঠি লিখে মুকুলকে দিয়েছিলো পাঠানোর জন্য, মুকুল সেটি মালয়েশিয়ায় এক বন্ধুকে দিয়ে আসে পোস্ট করার জন্য। এরপরে এ ব্যাপারে আর কিছু জানা যায় নি।
আর ফেরার সময় এবং ফেবার পরেও বেশ অনেকদিন এই মামাও নাকি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন, পরে আরেকজনের কাছে ব্যাপারটি জানতে পারলাম।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর/আরআর