ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আই ওয়াশের রাজনীতি, প্রহসনের বিচারিক রায়!

সুকান্ত পার্থিব, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৩

‘যুদ্ধাপরাধ’ ধারণাটা খুব জটিল নয়। কিংবা ৭১’এ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে মরিয়া বাঙালিকে দমন করতে পাকহানাদারদের হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও পাশবিক নির্যাতনে কারা সামিল হয়েছে এটা কারও অজানা নয়।



জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠার নামে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞে নেতৃত্ব দিয়েছেন গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী, কাদের মোল্লা, আব্দুল আলীম, আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু, প্রয়াত ফজলুল কাদের চৌধুরী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আরো অনেকেই ।

এদের অনেকের রিবুদ্ধে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার হচ্ছে। রায়ও হয়েছে দুইজন অপরাধীর।

প্রথমজনের রায় নিয়ে জাতি যতটা খুশি হয়েছিলো ঠিক তার ব্যতিক্রম হলো দ্বিতীয় রায়টা নিয়ে।

অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরেও কেন ফাঁসি না হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো, খটকাটা ওখানেই। তাহলে কি রায় নিয়ে কেউ রাজনীতি করছে! জনগণকে গোলকধাধা দেখাচ্ছে। না প্রহসনের বিচার হচ্ছে ? আসলে হচ্ছেটা কি? জাতির কলঙ্ক মোচনের প্রথম দিনটি আসে ২১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে পলাতক বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। শোভাযাত্রা বের হয় দেশজুড়ে। ফেসবুব-টুইটারে আনন্দ বার্তার ঝড় ওঠে।

দ্বিতীয় রায়টাও এমন হবে আশা নিয়ে শোভাযাত্রার জন্য অপেক্ষা করছিলো দেশবাসী। কিন্তু এবার তা হলো না। আনন্দ শোভাযাত্রার বদলে বের হলো প্রতিবাদ র্যালি, বিক্ষোভ মিছিল। সবচেয়ে বিষ্ময়কর ও ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হওয়া সত্বেও কাদের মোল্লা ওরফে মিরপুরের কাদের কসাই একাত্তরে অপকর্মের জন্যে শুধু যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেলেন|

ট্রাইব্যুনালে আনা কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ, তিনি একাত্তরের ৫ এপ্রিল মিরপুর বাsলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন।

দ্বিতীয় অভিযোগ, একাত্তরের ২৭ মার্চ তিনি সহযোগীদের নিয়ে স্বনামধন্য কবি মেহেরুননিসা, তাঁর মা এবং দুই ভাইকে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের বাসায় গিয়ে হত্যা করেন।

তৃতীয় অভিযোগ, একাত্তরের ২৯ মার্চ বিকেলে সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে আরামবাগ থেকে কাদের মোল্লা ও তাঁর সহযোগীরা জল্লাদখানা পাম্পহাউসে নিয়ে জবাই করে হত্যা করেন।

এই তিন অভিযোগের ব্যাপারে কাদের মোল্লাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে।

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে চতুর্থ অভিযোগ অনুসারে, ২৫ নভেম্বর কাদের মোল্লা ও ৬০-৭০ জন রাজাকার কেরানীগঞ্জ থানার ভাওয়াল খানবাড়ি ও ঘাটারচরে (শহীদনগর) শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করেন। এই অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তা থেকে কাদের মোল্লাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে পঞ্চম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনা ও অবাঙালি রাজাকারদের সঙ্গে কাদের মোল্লা মিরপুরের আলোকদী (আলুব্দী) গ্রামে হামলা চালান। ওই ঘটনায় ৩৪৪ জনের বেশি মানুষ নিহত হন।

ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৬ মার্চ কাদের মোল্লা, তাঁর সহযোগী ও পাকিস্তানি সেনারা মিরপুরের ১২ নম্বর সেকশনে হযরত আলী লস্করের বাসায় যায়। কাদের মোল্লার নির্দেশে হযরত, তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা করা হয়, ধর্ষণের শিকার হন এক মেয়ে।

এ দুই অভিযোগে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

লোক দেখানো প্রহসনের বিচারে যখন অভিযুক্ত ছয়টি অপরাধের মধ্যে পাঁচটি মারাত্মক গুরুতর অপরাধ, অগনিত হত্যা-ধর্ষণ প্রমাণিত হলো| এর মধ্যে সবচেয়ে সহিংস অপরাধ পল্লবীর আলোকদি (আলুব্দী) গ্রামে ৩৪৪ জনের বেশি মানুষের উপর পাশবিক হত্যাযজ্ঞ|

কিন্তু এ রায় সাধারণ মানুষের বিবেকে প্রশ্নবিদ্ধ হলো, তারপরেও বিচারপতি বা বিচারক কোন বিবেকে বা কোন অসাম্য আইনের ফর্মুলায় সেই মহাপরাধীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেন? সত্য কি আজও ভূলুণ্ঠিত হলো জামায়াত-শিবিরের `গৃহযুদ্ধ` নামের ভয়ের তোপে অসহায়ত্বের কলঙ্কিত কালিমায়?

ভোটের রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে জনগণকে তুলোধুনো করে, নির্বাচনী ইশতেহার দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার তথা মহাজোট এই ধরণের জঘণ্য ও ন্যাক্কারজনক বিচারের রায়ের জন্যে কি নির্বাচনী আই-ওয়াশ করতে প্রতীক্ষায় রেখেছে আপামর গণমানুষকে?

বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে কোন মহাপরাধীর অপরাধ প্রমাণিত হবার পরেও রায়ে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি `মৃত্যুদণ্ড` দিয়ে তা কার্যকর করা হয় না স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার নামে| এ ধরনের বিচার ব্যবস্থা বহাল থাকলে ও ভোট নামের ট্রামকার্ডে সরকার পরিবর্তন হলে সেই রায়ের কার্যকারিতা ওখানেই হয়তো থেমে যাবে।

এরপর আসামী রাষ্ট্রপতির দ্বারে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়ে অতীতেও বেকসুর খালাস পাবে। এরকমটা আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হতে পারে|

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘দালাল আইন’ করে এই দেশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। সে সময় এই আইনে বেশ কিছু রাজাকার ও আলবদর নেতা আটক হয়, বিচারও হয় কারো কারো |

অন্যদিকে, তখন এই আইনের অপপ্রয়োগ নিয়েও অভিযোগ ওঠে। একপর্যায়ে ১৯৭৩ সালে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বাদে বাকি সবার জন্য ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করা হয়।

এর ফাঁক দিয়ে অনেকেই বের হয়ে আসে।

১৯৭৫ এ শেখ মুজিবকে সপরিবারে b„শংসভাবে হত্যা ও জাতীয় চার মহান নেতাকে হত্যার পর বন্ধ হয়ে যায় বিচারের কার্যক্রম|

লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বৈধ হওয়ার সাথে সাথে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সক্রিয় ব্যক্তিরাও সমাজে, রাজনীতিতে আবারও ফিরে আসতে থাকে রাতের অন্ধকারে কোন অতৈন্দ্রিয় শক্তির উপর ভর করে।

জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাকামী গণমানুষের চেতনায় রচিত সংবিধানের মূল চারটি স্তম্ভ- গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এই চারটি স্তম্ভের দুটিতে সজোরে আঘাত হানেন। এরপর একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনেকটাই ভূলুণ্ঠিত হয় লাগামহীন ক্ষমতার দাপটে।

চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে জিয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যার পরে ক্ষমতার মসনদে বসেন আরেক সামরিক শাসক লে. জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রচিত সংবিধানের মূল স্তম্ভ ধর্মনিরেপক্ষতায় আঘাত হেনে সেখানে অযাচিতভাবে জনসমর্থন পাবার লোভে ক্ষমতাকে পরিপক্ক করার আশায় রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ সংযোজন করেন।

মুক্ত মানুষের মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেখানে সব ধর্মের মানুষের বসবাস করেন সেখানে রাষ্ট্রের কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম থাকা অবাঞ্ছনীয়। যা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় সামরিক জান্তা এরশাদের কঠিন কঠোর কলঙ্কিত কালিমায়।

বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ এ পরিণত করার আগেই আপামর জনতা আর ছাত্র জনতার কঠোর আন্দোলনে তোপের মুখে পড়ে দশ বছর শাসকের আসনে থেকে গণঅভ্যূত্থানে পতন ঘটে স্বৈরাচারী এরশাদের।

পরে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার গঠনে সমর্থন দিয়ে নাগরিকত্ব হারানো রাজাকার-আলবদরের লিডার গোলাম আযমকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমির ঘোষণার সাহস পায় জামায়াত।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জন্য গোলাম আযমের দোয়া চাইতে গেলে দেশব্যাপী ক্ষোভ ও হতাশা বেড়ে যায়|

এসবের প্রতিক্রিয়াতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলন এক নতুন পর্বে প্রবেশ করেছিলো সেসময়।

১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) কাজী নূরুজ্জামানের বাসায় প্রথম এ বিষয়ে সভা হয়। কয়েক দফা সভার পর গঠিত হয় ১০১ সদস্যবিশিষ্ট ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। যার প্রধান তথা আহ্বায়ক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা রুমি হারানো শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।

দ্রুত এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে গণমানুষের চেতনার গভীরে। পরে এই কমিটির সঙ্গে আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে অনেক বাম দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠিত হয় ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’। এরও আহ্বায়ক হন জাহানারা ইমাম।

১৯৯২ সালের মার্চ মাসে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক গণ-আদালত অনুষ্ঠিত হয়।

যখন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এই বিশাল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তখন তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত। এই ক্যানসারেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯৪ সালে। তাঁর মৃত্যুর পর থমকে পড়ে এই বৃহত্তর আন্দোলন।

১৯৯৬ সালে স্বাধীনতার পঁচিশ বছর পর আর ক্ষমতা হারানোর একুশ বছর পর ক্ষমতার আসনে বসার পূর্ণ বাঞ্ছায় মরিয়া হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ। তাই, সেইসময় ক্ষমতায় যাবার তাগিদে স্বাধীনতার এই পক্ষের শক্তি নামে পরিচিত স্বীকৃত দলটি বিএনপির পতনের জন্যে ‘জনতার মঞ্চ’ নির্মাণ করতে অসহযোগ আন্দোলনের সাথী হি‡mবে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা বেছে নেন রাজাকার গোলাম আজম-নিজামীর জামায়াত-শিবিরকে। একই মঞ্চে বক্তব্য রাখেন দুই দলের নেতাকর্মীরা। তারপরের ইতিহাস সবারই জানা।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের মুখে যুদ্ধাপরাধী শব্দ শোনা যায়নি, ভুলক্রমেও উচ্চারিত হয়নি সরকারের কারো মুখে, বিচার তো দূরে থাক।

কেননা, সেইবার ক্ষমতায় আসার জন্যে আওয়ামী লীগকে ব্যাপক সহযোগিতা করেছিলো জামায়াত। এরপরের ইতিহাস আশা করছি সবারই জানা।

যে আওয়ামী লীগ এরশাদের পতনের জন্যে রাজপথে আন্দোলন করেছে ২০০৮ এ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তার মহাজোট তৈরিতে প্রধান কারিগর হি†m‡e জোটে অন্তর্ভূক্ত করলো এরশাদের জাতীয় পার্টিকে।
আর আওয়ামী লীগের কাছে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর প্রত্যাখিত হয়ে জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ দৌড়ে ঢুকে পড়লো বীর মুক্তিযোদ্ধার গড়া দলের কাণ্ডারী বেগম খালেদা জিয়ার দলে। কী নির্লজ্জ বাংলাদেশের রাজনীতি!!!

তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হবার জন্যে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধ তথা একাত্তরের মানবতাবিরোধী সব অপরাধের অপরাধীর সুষ্ঠু ও ন্যায্য বিচার করবে আন্তর্জাতিক মানের। আর তাই, এই এক দাবিকে কাজে লাগিয়ে জনগনের সরলতার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় আসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি নামে খ্যাত ও সুপরিচিত দল আওয়ামী লীগ।

ক্ষমতায় আসার পর বিচারস্থান আর বিচারপতি নির্ধারণ করতেই সরকারের কালক্ষেপন হয় দুই বছর।

তারপরেও বিচারপতি ও স্বচ্ছ বিচারের নামে সময় অতিবাহিত হয় এমনিতেই।

প্রধান প্রধান যুদ্ধাপরাধী তথা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী গ্রেফতার হন। স্বচ্ছতার প্রশ্ন তুলে অনেক সময়ই এমনকি রায়ের কিছু আগেও ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি’কে পরিবর্তন করা হয় বিচারের রায় নিয়ে ইন্টারনেটের স্কাইপি সংলাপের জন্যে।

পলাতক বাচ্চু রাজাকার আর মানুষ কসাই কাদের মোল্লার রায়ের পর এখন দেশবাসী প্রতীক্ষা করছে ধর্মের মুখোশধারী আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী’র ওরফে দেলু বা দেইল্লা রাজাকারের রায়ের|

কাদের মোল্লার রায় সাধারণ জনগণ ও শহীদ পরিবার থেকে শুরু করে সরকার দলীয় সাংসদ, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, আর্টনি জেনারেল, বুদ্ধিজীবী মহল, সুধী সমাজ কেউই এই ধরনের লঘু শাস্তি মেনে নিতে পারেন নি। বিবেকের কাছে বার বার প্রশ্ন করেছেন | কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসির রায় হওয়া দরকার ছিলো। কিন্তু তা আর হলো না। এখন দেখবার বিষয় পরবর্তী রায়গুলো কতটা অস্বচ্ছ হতে যাচ্ছে|

জামায়াতের বর্তমান †RvU বিএনপি পরবর্তীতে ক্ষমতায় গেলে নিশ্চিতভাবে কাদের মোল্লা বেকসুর খালাস পাবে, এমন শঙ্কা করা মনে হয় অমূলক হবে না।

ধর্ম মহাপুরুষদের সৃষ্টি হলেও তাতে বিশ্বাস এবং তাকে পুঁজি করে ব্যবসা এক নয়। ধর্মকে পুঁজি করে বিভিন্ন দেশের মতো এদেশেও পাকিস্তানের আবুল আলা মওদুদী’র সৃষ্ট জামায়াতে ইসলামী ধর্মের নামে রাজনীতি তথা অপরাজনীতি করে আসছে। এছাড়াও অনেক রাজনৈতিক দল ধর্মকে ঢাল বানিয়ে ধর্মের বাণীকে তলোয়ার হি‡m‡e চালিয়ে রাজনীতির নামে অপরাজনীতি করছে।

তারা যখন দেশদ্রোহীদের পক্ষ নিয়ে রাজপথে কর্মসূচি দেয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে; আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়; নিরীহ পথযাত্রীদের আতঙ্কের সৃষ্টি করে তখন বুঝে নিতে মানুষ হয়ে অমানুষের বীভৎস রূপধারণ করে ধর্ম ও স্রষ্টা তথা আল্লাহ শব্দটির চরম অবমাননা করছে তারা।

মধ্যপ্রাচ্যের তেল বিক্রির টাকার ইন্ধনে এরা রাজপথে মানুষ হত্যার রাজনীতিতে মুখর, যেমনটি করতে এরা বা এর দোসরেরা কুণ্ঠাবোধ করেনি একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে নিরীহ মানুষদের নির্বিচারে হত্যা-ধর্ষণ করে। এরা শিবির নামের দল খুলে প্রকাশ্যে শিক্ষাঙ্গণে কিংবা রাস্তায় মানুষের রগ কাটছে, নির্দ্বিধায় গুলি চালাচ্ছে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে।

এদের প্রতিহত করতে না পেরে সরকারও লেলিয়ে দিচ্ছে তার ছাত্র ও যুব সংগঠনকে দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্যে। প্রতিহিংসার রাজনীতিতে দলিত হয়ে সহজ-সরল ‘বিশ্বজিত’ –এর মতো প্রাণ হারাচ্ছে অগণিত নিরীহ মানুষ।

অপরাধ করলে তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকলে তার বিচার হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিপথগামী হয়ে অন্ধ বিশ্বাসে মগ্ন থেকে জ্বালাও পোড়াও কিংবা মানুষ হত্যা করে হরতালে অরাজকতা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তা দমিয়ে রাখা অসম্ভব ব্যাপার।

যুদ্ধাপরাধের কলঙ্কের কালিমা মুছতে বেপরোয়া বিপথগামী ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রতিহত করে স্বচ্ছ সুষ্ঠু বিচারের বাস্তবসম্মত যুক্তিযুক্ত রায় সময়ের প্রয়োজনে গণমানুষের ঐক্যবদ্ধ চেতনার স্ফুরণে এখন খুবই জরুরি।

কাদের মোল্লার বিচারের রায় সরকার পক্ষ আইনজীবীর মাধ্যমে পুনঃবিবেচনা করা হোক সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানে। না হলে, এই বিচারের রায় দেখে সাধারণ অপরাধী অজস্র ধর্ষণ, চার-পাঁচ`টা হত্যা করেও বেকসুর খালাস পাবে, তাই না?

আর কত? অনেক হয়েছে আওয়ামী লীগ -বিএনপি`র দৌরাত্ম্যের কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতির নামে অপরাজনীতি। এরা দুদলই ধর্ম ব্যবসার দল জামায়াত ইসলামীকে একবারের জন্যে কাছে ডেকে নেয় আবার দূরে সরিয়ে দেয়। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে জামায়াত নামের ‘রাষ্ট্রীয় বিষবৃক্ষ’ –কে ব্যবহার করে।

আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে জামাত-শিবিরের মিছিলে-শ্লোগানে আগ্রাসী বক্তব্যে যে বীভৎস প্রতিক্রিয়াশীলতার উচ্ছাস, তা দেখলেই টের পাওয়া যায়, একাত্তরে এদের পূর্বপুরুষ বা এরা কী ছিলো? এখন কী জামায়াতের হুংকার গৃহযুদ্ধ এড়াতে সবকটি প্রমাণসাপেক্ষ্য রায় সত্যের জানালা দিয়ে ভোঁ দৌড়ে পালিয়ে যাবে?
এইরকম স্ববিরোধী দেশমাতাদ্রোহী রায়ে উৎসাহিত হয়ে অপরাধী বা বিপথগামী যুবক আরো কঠিন অপরাধ করতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না এই স্বাধীন বাংলাদেশে।

পরিশেষে, সবকটি মানবতা বহির্ভূত বিচারের সর্বোচ্চ রায় কামনা করছি। এখনো দুঃখিনী মা ভোলেনি তার স্বামী সন্তান হারানোর বেদনাবিধুর দিনের কথা, এখনো ধর্ষিত বোন ভোলেনি সেই কালরাত্রির কথা, এখনো মুক্তিযোদ্ধা বাবা ভোলেনি অসহায়ত্ব জীবনে পঙ্গুত্বের কথা!

আমরাও ভুলিনি, ভুলবো না। আমরাও জেগে আছি অতেন্দ্রীয় প্রহরীর মতো।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।