১. সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্ণ হলো আজ। রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে নিজ বাসায় তাদের খুন করা হয়।
স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ বা তদন্ত সংস্থা সঙ্গে সঙ্গেই হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে পারেনি। এটা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব।
সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন হত্যাকারীদের ধরার জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় চাইলেন। আমরা আশান্বিত হলাম। যদিও কোনো খুন বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মোটিভ বা কারা এতে জড়িত সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য ৪৮ ঘণ্টা অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট নয়।
অপরাধ জগতের পরিসংখ্যানমতে সাধারণ গড়পরতায় ১০-১৫ দিনের মধ্যেই অধিকাংশ অপরাধের তথ্য বেরিয়ে আসে। অন্যান্য দেশে অবশ্য এ রকমই চিত্র। যদিও আমাদের দেশের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। আমাদের দেশে কত খুন বা অপরাধের তথ্য যে সারাজীবনেও উদঘাটন হয়নি বা হয়তো হবেওনা সেটি ভিন্ন কথা।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সেই ৪৮ ঘণ্টা পার হয়েছে অনেক আগেই।
তার গদিও বদল হয়েছে। এসেছে নতুন মন্ত্রী। এসেছে একের পর এক আশ্বাস ও নাটকীয়তা। সেই নাটকের কুশিলব একেক সময় একেক জন। কিন্তু এক বছর পার হলেও নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের মূল কুশিলবরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। কোনো কুল-কিনারা করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
সবশেষে যোগ হয়েছে বাড়ির দাড়োয়ান এনামুল।
নাটকীয়ই হোক বা কাকতালীয়, এ হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূরণ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে গ্রেফতার হলো দারোয়ান এনামুল। এনামুল কবির ওরফে হুমায়ুন কবির সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সময় রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে তাদের বাড়ির দারোয়ান হিসেবে কর্তব্যরত ছিল।
গ্রেফতারের পর র্যাব তার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন জানায় ও যথারীতি আদালত তার ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। আসামি শনাক্তকরণের লক্ষ্যে আগে পাঠানো ডিএনএ প্রোফাইলের সঙ্গে ম্যাচিং করার জন্য এনামুলের ডিএনএ আমেরিকায় পরীক্ষার জন্য পাঠানো প্রয়োজন বলে দাবি করে র্যাব। এর আগেও ডিএনএ পরীক্ষার নামে সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে ওঠানো হয়। কিন্তু এর পরেও অপরাধী বা হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই কোনো তথ্য দিতে পারেনি। কালক্ষেপন ছাড়া আর কিছুই মেলেনি এক্ষেত্রে।
আগেই বলেছি, এ ঘটনায় নাটকীয়তার শেষ নেই। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর গদিনসীন হওয়ার পর গত বছরের ৯ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বলেন, “হত্যার রহস্য উন্মোচিত হয়েছে এবং আট জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ” পলাতক আসামি হুমায়ুন ওরফে এনামুলকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয় সেদিন।
সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পুলিশ বা র্যাবের যে সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করতে পেরেছে তাদের তো পুরস্কার পাওয়ার কথা। যদি আমজনতা পুরস্কার পেতে পারে তবে পুলিশ কেন পাবে না? প্রকৃত হত্যাকারী ধরা পড়ুক বা নাই পড়ুক এনামুল তো ধরা পড়েছে।
এর আগে পরের ঘটনার ফিরিস্তি সবারই জানা। সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে তুলেছি, কিন্তু যে ন্যায়বিচারকে আমরা কবর দিয়েছি তাকে এখনো তুলতে পারিনি। ন্যায়বিচারকে কি আমরা চিরতরে কবর দিয়েছি, নাকি সে মেঘের আকাশে নতুন করে আলোর শিখা রুপে ফিরে আসবে সেটিই আজকের প্রশ্ন।
২. জেসিকা লাল। নয়াদিল্লির ডাকসাইটের এক মডেল ও রেস্টুরেন্ট কর্মী। ১৯৯৯ সালে খুন হন তিনি। হত্যাকারীর নাম সিদ্ধার্থ ওরফে মানু শর্মা। মানু শর্মা হরিয়ানা অঙ্গরাজ্যের প্রভাবশালী নেতা বিনোদ শর্মার সুযোগ্যপুত্র। বিনোদ শর্মা হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী ভূপিন্দর সিং হুদার খাস লোক।
জেসিকা তার সহকর্মী মডেল ও অভিনেতা বিক্রম জাই সিংকে নিয়ে রাতের আয়োজন শেষে রেস্টুরেন্টের পানশালা (বার) বন্ধ করছিল। সে সময়ে এসে হাজির হলো দুই বন্ধুসহ মানু শর্মা। তার সুরা পান করতে চায়। জেসিকা জানাল, সময় শেষ আজ আর হবে না। মানু শর্মাতো অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। ইতনে বাড়া হিম্মত ওয়ালা? মুখ্যমন্ত্রীর বন্ধুর ছেলের সঙ্গে বেয়াদবি। খুলি উড়িয়ে দেব। সামান্য দুই পয়সার নাচনেওয়ালী কিনা মুখ্যমন্ত্রীর বন্ধুর ছেলেকে সুরা পানে বাধা দেয়।
যেমন কথা তেমন কাজ। গুলি করে ওপারেই পাঠিয়ে দিল বেচারি জেসিকাকে। তার আর নামি মডেল হওয়ার সাধ মিটল না। জেসিকার পরিবার হলো নিৰস।
ন্যায়বিচারের জন্য দারে দারে ঘুরতে থাকলো জেসিকার পরিবার। মানু তার পরিবারের প্রভাব খাটিয়ে গায়েব করে দিল সমস্ত আলামত। মুখ বন্ধ করে দিল সাক্ষীদের।
জেসিকার বোন সাবরিনা অনেক চেষ্টা করেও ন্যায়বিচার পেলেন না, বোনের হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি দাড় করাতে পারলেন না।
দীর্ঘ সাত বছর মামলা চললেও ২০০৬ সালে আদালত মানু ও অন্যান্য আসামিদের বেকসুর খালাস দেয়। আদালতের হাত-পা বাঁধা। কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকলে আদালত কিই বা করতে পারে।
কিন্তু হরিয়ানার আমজনতা এ রায় মেনে নিতে পারেনি। তারা রাস্তায় নেমে এল। আইন-আদালত-প্রশাসন বাধ্য হয়ে আবার মামলা চালু করল। এবার মানু দোষী প্রমাণিত হলো ও তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও দেয়া হলো। জনতার বিচার কায়েম হলো।
সংক্ষেপে জেসিকার গল্প এখানেই শেষ।
২০১১ সালে এই কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা রাজকুমার গুপ্ত এটি নির্মাণ করেন।
৫৭তম ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের জন্য ছবিটি মনোনিত হয়। সবচেয়ে ভালো ছবি, সবচেয়ে ভালো অভিনয়সহ চারটি ক্ষেত্রে এটি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।
শুধু তাই নয় এটি Star Entertainment Award, Dadasaheb Phalke Academy Awards, Anandalok Purushkar, Apsara Award-সহ আরো অনেক পুরস্কার পায়।
৩. পাঠক, দুটো ঘটনার সঙ্গে খুব বেশি মিল রয়েছে সে দাবি আমি করি না। কিন্তু ন্যায়বিচারের প্রশ্নে ভেবে দেখুন খুব বেশি ব্যাবধানও কি আছে। সাগর-রুনি খুনের একবছর পার হলো- আমরা আজো তার মোটিভ জানতে পারলাম না। ওদেরেকে দুইবার দাফন করলাম। ভেবে দেখুন ওদের বাবা-মা’র কথা। কি নিদারুন কষ্ট যাতনা নিয়ে তারা বেঁচে আছে। সাবরিনার সঙ্গে কি আমাদের রুনির ভাইর কোনো মিল নেই? মানু শর্মার হাতের চাইতেও কি সাগর-রুনির হত্যাকারীদের হাত বেশি লম্বা?
মেঘের আকাশে ফিকে হয়ে আসছে সাগর-রুনির স্মৃতি। ওর আকাশে কোনোদিনই ওর বাবা-মা বৃষ্টির মতো স্নেহ ভালোবাসার পরশ বুলাবে না। ক্ষমা করো মেঘ।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৩
জেডএম/