ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

শাহবাগের গণজাগরণ এবং বিএনপির নিয়তি-২

জাহিদ নেওয়াজ খান, সাংবাদিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৩
শাহবাগের গণজাগরণ এবং বিএনপির নিয়তি-২

শাহবাগ গণজাগরণের ৭ দিনের মাথায় বিএনপি প্রথম যে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয় তা আসলে ছিলো ওই আন্দোলনের ঘৃণার পাত্র যেসব প্রতিষ্ঠান সেগুলোর পক্ষে বিএনপির সরাসরি পরিষ্কার অবস্থান। ‘নিন্দা ও প্রতিবাদ’ শিরোনামে বিএনপির বিবৃতি তাই শেষ হয়েছে এভাবে: ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল দৈনিক আমার দেশ, নয়াদিগন্ত, সংগ্রাম পত্রিকায় (আসলে পত্রিকার কপিতে) অগ্নিসংযোগ এবং নির্যাতিত ও সাহসী স¤পাদক মাহমুদুর রহমান ও দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ড. পিয়াস করিমের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী হুমকির তীব্র নিন্দা, ক্ষোভ ও ধিক্কার জানাচ্ছে।



শত্রু-মিত্র চিনতে তারুণ্য ভুল না করলেও তাদের চেতনাকে এভাবে ‘ফ্যাসিবাদী’ উল্লেখ করে বিএনপির ওই বিৃবতির ২৪ ঘন্টার মধ্যে আরেকটি বিবৃতি দেয় প্রধান বিরোধীদল। বিএনপি চেয়ারপার্সন এবং বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পাস হওয়া প্রস্তাবনা অনুযায়ী দ্বিতীয় বিবৃতিটি দেওয়া হয়।

স্বাগত জানানোর ভাষা
বিএনপির দ্বিতীয় বিবৃতিতে অনেকে ‘গদ গদ’ হয়েছেন। বিশেষ করে টেলিভিশন টক-শোতে যে কথাজীবীরা বিএনপিকে কোনো না কোনোভাবে শাহবাগের আগুনের আঁচ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন, তারা বিবৃতিতে এক ‘স্বাগত’ শব্দ থাকার কারণেই এমনভাবে কথা বলা শুরু করেছেন যেনো বিএনপি এখন শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর এবং প্রজন্মের চেতনার বড় অংশীদার।

তাদের এই অবস্থান যে কতো ভুল, শাহবাগের আন্দোলন যে বিএনপির জন্য কতো ‘গা-জ্বালা’র কারণ দ্বিতীয় বিবৃতির দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেই তা স্পষ্ট যেখানে বলা হয়েছে: ‘সমাবেশ মঞ্চ থেকে সমাবেশটিকে দল নিরপেক্ষ বলে দাবি করলেও ক্রমান্বয়ে এটা প্রতীয়মান হচ্ছে একটি বিশেষ রাজনৈতিক ঘরানার ব্যক্তিদের হাতেই এর নেতৃত্ব কুক্ষিগত করার প্রয়াস চলছে। সমাবেশ মঞ্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় বহুলভাবে উচ্চারিত একটি শ্লোগান স্বাধীনতা উত্তরকালে চরমভাবে দলীয়করণ করার ফলে যা সর্বজনগ্রাহ্যতা হারায় সেই শ্লোগান বার বার উচ্চারিত হওয়ার ফলে জনমনে চরম সংশয় এবং সমাবেশের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ’

জয়বাংলা অ্যালার্জি
বিবৃতিতে স্পষ্ট বাঙালির চেতনার স্ফূরণের ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান নিয়ে বিএনপির এতোই অ্যালার্জি (অথবা ভয়) যে তারা বিএনপির নাম ‘খোদাই’ প্যাডে শব্দ হিসেবেও ‘জয়বাংলা‘ লিখতে রাজি নয়। তবু রক্ষা যে বিএনপি অন্ততঃ এই কথা স্বীকার করেছে যে জয়বাংলা সেøাগানটি ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় বহুলভাবে উচ্চারিত একটি সেøাগান’। তবু রক্ষা যে ইতিহাস বিকৃতির রেকর্ড গড়া দলটি অন্ততঃ এই কথা বলেনি যে মুক্তিযুদ্ধের সেøাগান ছিলো ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ অথবা ‘শহীদ জিয়া অমর হোক’।

আর ‘জয়বাংলা’ স্লোগান ‘স্বাধীনতা উত্তরকালে চরমভাবে দলীয়করণ করার ফলে সর্বজনগ্রাহ্যতা হারায়’ বলে বিএনপির যে দাবি তাতে আরো একবার প্রমাণিত, নিজেরা জড়িত না থাকলেও, ৭৫’র ১৫ আগস্ট জাতির জনকের খুনিদের বড় সমর্থক বিএনপি। ইতিহাস সাক্ষী বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনি মোশতাক চক্রই ‘জয়বাংলা’র জায়গায় প্রথম বেতার এবং টেলিভিশন ভাষণে পাকিস্তানী কায়দায় ‘বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ’ সেøাগান ফিরিয়ে এনেছিলো।

আমরা তখন শিশু এবং আমাদের মনে আছে আমাদের কিভাবে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং ৭ নভেম্বর শিশু-কিশোর কুচকাওয়াজে ‘বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ’ সেøাগান শেখানোর মহড়া চলেছে। এভাবে কয়েকটি প্রজন্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জয়বাংলা’ সেøাগান থেকে দূরে রেখেছেন প্রথমে জিয়াউর রহমান এবং পরে তার সার্থক উত্তরসূরী এইচ এম এরশাদ।

তবে ইতিহাসকে পেছনে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলেও ইতিহাস যে ঠিকসময় ঠিকই সঠিক বাঁক নেয় তার প্রমাণ শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে ‘জয়বাংলা’ সেøাগান, নতুন প্রজন্মের আবারো শিকড়ের কাছে প্রত্যাবর্তন। কয়েক দশক ধরে এভাবে ‘জয়বাংলা’ সেøাগানকে দূরে রাখার নামে স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনাকে মাটিচাপা দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণেই গণজাগরণ মঞ্চে ‘জয়বাংলা’ সেøাগানে বিএনপির গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। কারণ তারা জানে নতুন যে প্রজন্ম দল-মত নির্বিশেষে ‘জয়বাংলা’য় উজ্জীবিত তাদের চেতনাকে বিএনপি ধারণ করতে পারবে না, ক্রমেই বর্তমানের এবং আগামীর তরুণ প্রজন্ম থেকে আরো দূরে চলে যাবে বিএনপি।

ডার্টি গেইম বিড
এ কারণেই তাদের আশা ছিলো, শাহবাগের লাখো মানুষের যে সমাবেশ সেখানে এমন কিছু ঘটবে বা ঘটানোর চেষ্টা হবে যাতে ওই আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়। তেমনই একটি চেষ্টা ছিলো প্রজন্ম চত্বরকে সেøাগানে-সেøাগানে মুখর করে তোলা ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী ‘নতুন অগ্নিকন্যা’ লাকি আখতারের ওপর আক্রমণ চেষ্টা।

অরাজনৈতিক পরিচয়ে শাহবাগের সংগ্রামে নামা রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ধৈর্য্য এবং প্রজ্ঞায় তা ছোট ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ থাকলেও জামায়াত-শিবিরের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য গণমাধ্যম একে নিয়ে জল ঘোলা করার অনেক চেষ্টাই করেছে। সেই চেষ্টা সফল না হলেও প্রথম বিবৃতির মতো বিএনপির দ্বিতীয় বিবৃতিতেও টেনে আনা হয়েছে ওই ঘটনা।

সেই পুরনো আন্তর্জাতিক মান
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বছরের পর বছর ‘পেয়ার-মহব্বত’ চালিয়ে গেলেও গণজাগরণ মঞ্চে তরুণ প্রজন্মের ফুঁসে উঠায় বিএনপিও এখন বুঝতে পারছে ‘জনগণ আজ ১৯৭১ এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। ’

কিন্তু বিবৃতির এর পরের বাক্যটিই বিস্ময়কর। গোলাম আযমের পর শীর্ষ দুই যুদ্ধপরাধী নিজামী এবং মুজাহিদকে মন্ত্রী করে তাদেরকে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত জাতীয় পতাকা উপহার দিয়েছে বিএনপি। সেই বিএনপি এখন বলছে: ‘বিএনপি সর্বদা এই বিচারের পক্ষে। ’

বিএনপি আসলে কতোটা এই বিচারের পক্ষে তার প্রমাণও আছে বিবৃতিতে যেখানে বলা হয়েছে: ‘একই সঙ্গে বিচারটি যাতে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন হয় বিএনপি সে দাবিও জানিয়ে আসছে। বিএনপি’র এই দাবির প্রতি সম্মান দেখালে বিচারটি প্রশ্নবিদ্ধ হতো না। ’

বিচার কি আসলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে? হ্যাঁ হয়েছে। যাদের বিচার হচ্ছে, যারা মনে করেছিলো ৪২ বছর আগের তাদের সব অপকর্ম মানুষ ভুলে গেছে, গণহত্যা-ধর্ষণের পরও যারা খালেদা জিয়ার উপহার হিসেবে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলো; তাদের কাছেতো বিচার অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। আর প্রশ্নবিদ্ধ বিএনপির কাছেও যাদের দাবি তারাও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চায়।

প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার যুক্তি হিসেবে বিএনপি দাবি করেছে: ‘জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলও এই বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। ’ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল যদি আদৌ সেই সংশয় প্রকাশ করেও থাকে তাহলে তা হয়েছে জামায়াতের টাকায় দেশে-বিদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে যে প্রচারণা তার অংশ হিসেবে।

প্রকৃত সত্য হচ্ছে বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে কেউ সংশয় প্রকাশ করেনি, যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নয়ন সহযোগীরা তাদের কথিত সুশীলিয় অবস্থানের কারণে সব সময় আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে স্বচ্ছ বিচারের নিশ্চয়তা চেয়েছে। বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায়ের পরও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্য দেশগুলো যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তাতে স্পষ্ট বিচারের প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই। ভবিষ্যতেও এরকম স্বচ্ছ বিচারই তারা চায়।

আর জাতিসংঘের যে মানবাধিকার কাউন্সিলের কথা বলে বিএনপি এখন বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চায়, সেই মানবাধিকার কাউন্সিল বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকার সময় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কতোবার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে... বিএনপির উচিত সেই কথা স্মরণ করা।

বিচারে আন্তর্জাতিক মানের কথা বলার সময় বিএনপির শহীদ পরিবারগুলোর কথাও স্মরণে রাখা উচিত যারা প্রশ্ন তুলেছে, তাদের পিতা-মাতা-ভাই-বোনকে হত্যার সময় কোন্ আইন অনুসরণ করা হয়েছে, কোন্ আইনে একাত্তরে গণহত্যা চালানো হয়েছে, কোন্ আইনে লাখ লাখ নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে? এখন কেনো এতো আইনের কচকচানি?

শহীদদের সেই কষ্ট মনে রেখেই ন্যায়বিচারের স্বার্থে আন্তর্জাতিক মানের আইন হয়েছে, আন্তর্জাতিক মানের আদালতে বিচার চলছে। এ বিচার বিএনপি-জামায়াত ছাড়া আর কারো কাছে প্রশ্নবিদ্ধ নয়। তবে আন্তর্জাতিক মান বলতে বিএনপি যদি বোঝায় গোলাম আযমদের স্বপ্নভূমি পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে বিচার করে তাদের সাধু এবং সন্ত পুরুষ ঘোষণা করে বেকসুর খালাস দিতে হবে তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।

আতর-লোবানের খুশবু
অতোটা সাহস না পেলেও পরোক্ষভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিএনপির বিবৃতিতে বলা হয়েছে: ‘একটি সভ্য রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে বাংলাদেশ কত ন্যায়নিষ্ঠভাবে মানবাধিকার ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে পারছে। ’

বিএনপির ভাষায় সভ্য রাষ্ট্র হওয়ার জন্য কি যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে বিএনপির সঙ্গে তাদের মহব্বতের কোলাকুলির ব্যবস্থা করে দিতে হবে? মানবাধিকার এবং আইনের শাসন সমুন্নত রাখার নামে কি খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের রূপরেখার তৈরি করতে নিজামী-মুজাহিদদের সশরীর আতর-লোবানের খুশবু ছড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে?

তা না হলে দেশের মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোনা করতো না বিএনপি। দলের স্থায়ী কমিটির বিবৃতিতে আছে: ‘দেশের মানুষের আকাঙ্খা বিবেচনা করে অভিযুক্তদের মৃত্যুদন্ড দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বিচারকদের অনুরোধ জানিয়ে সমগ্র জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সমাবেশ মঞ্চের ঘোষণা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অথচ মানবতাবিরোধী সহ যে কোন অপরাধে অভিযুক্তদের যথাযথ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকার প্রধানের। বিচারকরা তাদের নিজস্ব মূল্যায়ন, যুক্তিতর্ক ও সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে যদি রায় ঘোষণা করতে না পারেন তা হলে সমগ্র বিচারিক প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। এটা আইনের শাসন ও ন্যয়বিচার এর পরিপন্থী। ’

বিএনপি যদি সত্যিই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতো তাহলে সংসদ নেতা হিসেবে জনমানুষের পক্ষে শেখ হাসিনার ওই বক্তব্য সমালোচনা না করে বরং সমর্থন করতো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেখ হাসিনার অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। সেই প্রতিশ্রুতি তিনি পূরণ করছেন। আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এমন বিচার নিশ্চিত করেছেন যাতে সব পক্ষের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়। একইসঙ্গে গত কয়েক বছরে নতুন প্রজন্মের নবচেতনা তিনি হৃদয় দিয়ে পড়তে পেরেছেন। যে কারণে তাঁর ওই বক্তব্য।

অন্য বিষয় নিয়ে শেখ হাসিনার শত সমালোচনা থাকলেও একজন রাজনীতিক হিসেবে এখানেই তাঁর সাফল্য যে তিনি তাঁর চেতনা দিয়ে নতুন প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করতে পেরেছেন। আবার সেই প্রজন্ম যখন গণজাগরণে তাঁর রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে, তখন তিনি সেই জাগরণের চেতনাকে ধারণ করেছেন।

এখানেই বেগম খালেদা জিয়ার ব্যর্থতা; যে খালেদা জিয়া এখনও জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ, কয়েকদিন আগেও জনসভার ভাষণে দাবি করেছেন, কাদের মোল্লারা যুদ্ধাপরাধী নন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বিরোধী জোটকে দুর্বল করার চেষ্টা চলছে। অথচ এখন বিএনপি দাবি করছে ‘বিএনপি সর্বদা এই বিচারের পক্ষে’।

বিএনপির এমন স্ববিরোধিতা আরও আছে। জনচেতনাকে ধারণ করে সংসদে দেওয়া শেখ হাসিনার বক্তব্যের সমালোচনার সময় বিএনপি ভুলে গেছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর বেগম খালেদা জিয়া সংবিধানের সংশোধনী আর রায় ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যদি আদালতের সমালোচনা করতে পারেন তাহলে সংসদে দাঁড়িয়ে সংসদ নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা কেনো আদালতের কাছে জনআকাঙ্খার কথা তুলে ধরতে পারবেন না!

কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বিএনপি
বিএনপির ৬৬০ শব্দের দ্বিতীয় বিবৃতিতে এরপর প্রথম বিবৃতির মতোই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক অনেক ইস্যু তুলে ধরে সেগুলোও শাহবাগের আন্দোলনে যোগ করার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। ক্ষমতায় গেলে বিচারের আশ্বাস দিয়ে বলেছে: ‘বিএনপি যদি নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আসে তাহলে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে এবং অবশ্যই মানবতাবিরোধী অপরাধসহ সকল ধরনের অপরাধের নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করবে। ’

তবে গণজাগরণের চেতনার সঙ্গে বিএনপির আশ্বাস কতোটা পরিপূরক তা বোঝা যায় বিবৃতির পরের বাক্যে যেখানে ‘১৯৭১ সনে হানাদারমুক্ত হওয়ার’ কথা বলা হলেও পাকিস্তানের নাম নেই, জিগরি দোস্তদের নাম নিতে লজ্জা পেয়েছে বিএনপি।

একইভাবে জামায়াতের সঙ্গে শুধু ভোট আর জোটের শক্তি বাড়ানোর সমীকরণই নয়, ঐতিহাসিকভাবে আদর্শিক কারণেই বিএনপি এমন আষ্টেপৃষ্টে আছে যে দু’ জনে দু’ জনার হয়ে একাকার। শাহবাগে গণজাগরণে রূপ নেওয়া গত কয়েক বছরের জাগরণ তাই বিএনপি আমলে নেয়নি, দলীয় ফোরামে তাদের তরুণ প্রজন্ম জামায়াতি সংশ্রব ছাড়ার যে আহ্বান জানিয়ে আসছে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন যেহেতু চূড়ান্ত পর্যায়ে বিদ্রোহের মতো ঘটনা ঘটতে পারে তাই কাউন্সিলের আগে সারাদেশে বিএনপির বর্ধিত সভাও স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।

তারপরও শাহবাগের গণজাগরণকে স্বাগত জানানোর একমাত্র কারণ এই আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করা, নতুন প্রজন্ম মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণে আগামীতে নির্বাচিত না হওয়ার আশংকা। বিএনপি যদি সত্যিই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার চাইতো তাহলে অন্ততঃ শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে জনবিষ্ফোরণের পর জামায়াতের সঙ্গে একই জোটে থাকতো না। কিন্তু তাই করছে বিএনপি, এখনও জামায়াত-বিএনপি এক জোট।

দল হিসেবে এখন তাই শাহবাগের তরুণদের খোঁড়া কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিএনপি। জিয়াউর রহমানের দলের সামনে এখন দুটি বিকল্প:
১. জামায়াতকে কোলে নিয়ে ওই কবরে নেমে পড়া, এবং
২. জামায়াতকে কোল থেকে কবরে ছুঁড়ে ফেলে নিজেদেরকে শাহবাগের গণজাগরণে জনস্রোতে পরিণত করা।

জাহিদ নেওয়াজ খান, বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই (znewaz@gmail.com)

বাংলাদেশ সময় ১৭৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।