১৮৮৫ সালে ভারতবাসীর অধিকার আদায়ের জন্য নিখিল ভারত কংগ্রেস নামে প্রথম একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছিল। তারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলে সফল হয়।
এই যে এতকিছু হচ্ছে, এত প্রতিবাদ! এত স্লোগান! কিসের জন্য? কেন হচ্ছে? কেউ কেউ বলতে পারেন রাজাকারদের বিচারের দাবিতে পুরো জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে কোনো ধরনের প্রহসন বাঙালি জাতি মানবে না। একথা অবশ্যই ঠিক। কিন্তু অনেকেই ভাবছে, এই আন্দোলন কতদিন চলবে? কিংবা কতদিন চালানো সম্ভব? প্রথম দিকে অনেকেই বলেছিলেন, এই আন্দোলনের রূপরেখা কি? ইতোমধ্যে, আমাদের তরুণ নেতৃত্ব আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করেছে। শুরু থেকে এখনো অনেকে বলছেন, এদের কোনো নেতা নেই। তাই এই আন্দোলন টেকসই হবে না কিংবা সফল হবে না। কিছু লোক বলছেন, “অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট” আন্দোলনের মতো এটাও এক সময় ঝিমিয়ে পড়বে। কিংবা মিসরের তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনের মতো ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমাদের তরুণ ব্লগার এবং ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্টরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইন সংশোধন করাতে সক্ষম হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের মুল দাবি “ফাঁসি চাই” দাবিটি পূরণ হবে না। আসলেই কি তাই? শেষ পর্যন্ত কি হয়? তা দেখার জন্য অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে। আগ বাড়িয়ে এখনই নেতিবাচক কথা বলার সময় আসেনি।
নেতিবাচক গুজব প্রচারের ভুমিকা রাখছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ইসলামী এবং তার দোসর কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও মিডিয়া। তারা গনজাগরণের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিচ্ছে। তাদের পদলেহী কিছু দলকানা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে জাতিকে বিভ্রান্ত করার অপচেস্টায় লিপ্ত। তাদের ঘটে যদি এতই বুদ্ধি থাকে কিংবা কলিজায় যদি এত সাহস থাকে তারা যেন শাহবাগে এসব বুদ্ধি একবার ফলিয়ে যান। বিপ্লবী জনতা তাদের সমুচিত জবাব দেবে। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন রকমের সহিংস কর্মকাণ্ড চালিয়ে ১৯৭১ এর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধকালে তারা সমগ্র দেশবাসীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানিদের সঙ্গে নিয়ে ইতিহাসের নারকীয় হত্যা, খুন ধর্ষণ চালিয়েছিল। এখন আবার তারা একটি অহিংস আন্দোলনে ভীত হয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা চালাচ্ছে। তারা আবারো একটি ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। তারা গৃহযুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন তারা দেশের মুক্তিকামী মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে তেমনি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালেও প্রখ্যাত লেখক হুমায়ুন আজাদ, কবি শামসুর রাহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সনৎ কুমার সাহা, অধ্যাপক ইউনুসের উপর হামলা করেছে। বর্তমান সময়েও তারা রাস্তায় নেমে মানুষ হত্যা করছে। এসব কর্মকাণ্ড থেকে আমরা কি ধারণা করতে পারি? শাহবাগ চত্বরের এই আন্দোলন থেমে গেলে কিংবা আন্দোলন চলাকালেই জামায়াত-শিবির রাজাকাররা কোনো না কোনোভাবে আমাদের তরুণ সংগঠকদের উপর হামলা করতে পারে?
এই আন্দোলনের একাধিক প্রতিপক্ষ আছে। তারা সময় এবং সুযোগের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে আছে। কিন্তু প্রতিপক্ষ কে বা কারা? এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ এখন পর্যন্ত জামায়াত ইসলামী, তাদের মিডিয়া এবং তার সহযোগী সমমনা রাজনৈতিক দল। কারো কারো মতে, সরকারও। কারণ, এই আন্দোলনকে সরকারও কব্জা করতে চাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে একাধিক প্রতিনিধিকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা কারো হাতের পুতুল হতে রাজি নয়। তারা তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বাংলার জনগণকে ডাক দিয়েছে, বাংলার মানুষ তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছে। তাই তারা কারো লেজুড়বৃত্তি করতে রাজি নয়। তারা আপামর জনসাধারণের মনের কথা জানে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার ভাষা তারা বোঝে। তাই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের হৃদস্পন্দন তাদের কানে বাজে। তারা জনগণের ভাষায় স্লোগান দিচ্ছে, জনগণ তাদের ভাষায় স্লোগান দিচ্ছে। তারা জনগণ তারা পরিচালিত, তারা জনগণ দ্বারা সমর্থিত, তারা জনগণ দ্বারা মনোনীত। তারা কোনো নেতা-নেত্রীর আর্শীবাদপুষ্ট নয়। তারা জনগণের আর্শীবাদপুষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের পর এমন বাংলাদেশ কেউ কখনো দেখেনি। এমন ফাল্গুন এই দেশে আর কখনো আসেনি।
প্রিয় পাঠক, ঐতিহাসিক দিন ক্ষণ সব সময় আসে না। এক একটা সময় আসে ইতিহাস পরিবর্তনের। এক একটা সুযোগ আসে নেতৃত্ব দেয়ার। এক সময় নিখিল ভারত কংগ্রেস থেকে মুসলিম লীগ নামক একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছিল। মুসলিম লীগের নেতৃতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল। সেই মুসলিম লীগ ভেঙে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ে যখন আওয়ামী মুসলিম লীগ উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারছিল না তখন আওয়ামী লীগ গঠন করা হয়েছিল। এবং আওয়ামী লীগ তখন সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব আওয়ামী লীগ আর এখনকার আওয়ামী লীগ কি একই রকম আছে? এখনকার আওয়ামী লীগ কি বাংলার মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের রাজনীতি করছে? নিশ্চয়ই না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যদি তা করতো তাহলে আজ আর লাখো মানুষের বজ্রকণ্ঠে “রাজাকারের ফাঁসি দাবি” উচ্চারিত হতো না। পদ্মাসেতু কিংবা শেয়ারবাজার কেলেংকারি হতো না।
তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে? এদেশের মানুষ স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসরা সব সরকারের আমলেই কমবেশি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তারা প্রেসিডেন্ট হয়, মন্ত্রী হয়, এমপি হয়। তার মানে কি? আজকের এই আন্দোলন গত ৪২ বছরের হতাশার বহিঃপ্রকাশ এবং তার বিস্ফোরণ। আমরা লক্ষ্য করেছি, গত চার বছর যাবত বিএনপি-জামায়াত জোট বহু রকমের আন্দোলনের ডাক দিয়েছে কিন্তু তাদের ডাকে মানুষ আর ঘর থেকে বাহির হয়নি। আজকের বাংলাদেশে যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো জাতির উদ্দেশে কোনো ডাক দিলে দেশের মানুষ ভয়ে, অনাস্থায়, অবিশ্বাসে এবং ঘৃণায় ঘরের ভেতরের ঘরে মুখ লুকিয়ে থাকে। সেখানে এই অজ্ঞাতপরিচয় কিছু তরুণ বাঁশির কী এমন সুর বাজালো যে শাহবাগ আজ জনসমুদ্রে পরিণত হয়ে গেল? বড় বড় রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাবান নেতা-নেত্রীরা যখন বছরের পর বছর ধরে মানুষের মনের কথা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে কিংবা বুঝতে চাননি।
সুতরাং বাংলাদেশে এখন এমন কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা নেতা-নেত্রী নেই যে বা যারা মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পেরেছে কিংবা পারবে। এরকম একটি পরিস্থিতিতেই আজ আমাদের তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশের মানুষকে সেই গান গেয়ে শোনাচ্ছে যে গান শোনার জন্য এদেশের মানুষ অনেক বছর ধরে কান পেতেছিল। তারা চেতনার শিখায় মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ শিখা চিরন্তন। এই শিখা জ্বলবে। প্রত্যক বাঙালির বুকের মধ্যে এ শিখা জ্বলবেই।
এখন কথা হচ্ছে, তারুণ্যের এই অসীম শক্তি, অসীম ক্ষমতা, আকাশের মতো বিশালতাকে আমরা কি শুধু ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই’ দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ দেখতে চাইবো? যে তারুণ্যের শক্তিতে আমরা রক্ষা করতে পেরেছিলাম আমাদের মাতৃভাষা, যে তারুণ্য আমাদের একদিন এনে দিয়েছিল ইতিহাসের মহত্তম অর্জন মহান স্বাধীনতা। সেই তারুণ্য আজ আবার জেগেছে। আবার আমাদের সময় এসেছে। আবার আমাদের সুযোগ এসেছে। দিন এবার সত্যি সত্যিই বদলাবে।
হে তরুণ! আমি তোমাদেরই একজন। আমি প্রত্যেক দিন তোমাদের সাথে একই সুরে একই কথায় স্লোগান দিতে শাহবাগ যাই। আমিও তোমাদের সাথে নীরবতা পালন করি। তোমাদের সাথে চেতনার প্রদীপ জ্বালাই। আমি বিশ্বাস করি, তোমরা আমার হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছো, আমি তোমাদের সকলের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। আমি জানি তোমাদের বয়স অভিজ্ঞতা আমার মতোই। আমাদের বয়সী তরুণদের দ্বারাই পৃথিবীর বহু বিপ্লব সাধিত হয়েছে। আমরাই পারবো। বাংলার মানুষ এখন তা বিশ্বাস করে। এদেশের ১৬ কোটি মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের কথা শোনার জন্য কান পেতে আছে। আমাদের দেখানো পথে হাঁটার জন্য মানুষ পা বাড়িয়ে আছে। হে তরুণ নতুন একটি পথ দেখাও। এদেশের মানুষ আমাদের ডাকে ঘরের বাহির হয়েছে।
প্রজন্ম চত্বর থেকেই একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করো। সেই নতুন রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ঘোষণা করো। তাহলে এই আন্দোলনের দাবি-দাওয়া স্থায়ী রূপ লাভ করবে। প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোকে মানুষ আর বিশ্বাস করে না। তারা একটি বিকল্প চায়। বিকল্প একটি প্লাটফর্ম অনেকদিন থেকেই খুঁজছে। গত ২০ বছরে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এবং এনজিও ব্যক্তিত্ব রাজনৈতিক দল গঠন করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা স্বার্থ হয়েছেন। কারণ, তাদের আপামর জনসাধারণ বিশ্বাস করেনি। প্রচলিত ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’ (একদিন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে আরেকদিন রাজাকারের সাথে জোট করে) ধরনের রাজনৈতিক দলগুলো গণজোয়ারের কাছে হারিয়ে যাবে। ঐসব রাজনৈতিক দলের তরুণ ভোটাররা আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। আজকের সমবেত জনতা কোনো না কোনো দলের ভোটার, তারা আমাদের সমর্থন জানাচ্ছে। বাংলার মানুষ আমাদের বিশ্বাস করেছে, আমরা ব্যর্থ হবে না। এদেশের মানুষ আমাদের ছেড়ে যাবে না। এদেশের মানুষ আমাদের সাথে আছে। জয় আমাদের হবেই। জয় আমাদের সুনিশ্চিত।
শাখাওয়াৎ নয়ন: ব্লগার, ঔপন্যাসিক, পিএইচডিরত গবেষক। ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসল, অস্ট্রেলিয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৩