ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি কোনো সমাধান নয়

আকাশ চৌধুরী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৩
উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি কোনো সমাধান নয়

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে পরিবারের অনন্য ভূমিকা, সেই পরিবারের বীর সন্তান দেশপ্রেমিক অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনকে যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হয় তখন দেশবাসী স্বাগত জানিয়েছিল। ওই সময় ছাত্রদের দীর্ঘ আন্দোলনে অচলাবস্তা হয়ে পড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শরীফুল এনামুল কবীরকে সরিয়ে নয়া উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার কারণে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে এসেছিল।

যদিও কেউ কেউ দলীয়করণের মাধ্যমে একতরফা ভাবে স্বার্থ আদায়ের চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন! তবে নয়া উপাচার্য নিয়োগে সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে দেশের জনগণ মনে করেন। তাঁর মতো একজন দক্ষ, সৎ, নিষ্ঠাবান বীর শিক্ষাবিদ আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় প্রয়োজন ছিল। আর সেই বীর সন্তান ১৩ ফেব্রুয়ারি এক ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় পদত্যাগের ঘোষণা দেন। যদিও পরে শিক্ষামন্ত্রী ও ছাত্রদের চাপে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পাল্টান।

১৩ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও ওয়েব সাইটে বলা হয়েছে, ‘ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভাঙচুরের পর শিক্ষকদের সঙ্গে মতদ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। মঙ্গলবার রাতে হামলা ও ভাংচুরের পর বুধবার শিক্ষক সমিতির বৈঠকে শিক্ষকরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেন। ওই হামলা শিবির চালিয়েছিল বলে উপাচার্যে বক্তব্য ‘সঠিক’ নয় বলে দাবি করেন তারা। এরপর বৈঠক থেকে বেরিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার সাংবাদিকদের বলেন, “শিক্ষকদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আজকেই এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করব। ” এরপর তিনি যখন সবার চাপে সিদ্ধান্ত পাল্টান তখন শিক্ষকরা শুরু করেন কর্মবিরতি।

মঙ্গলবার এক ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্রকে করে শিবির চক্র বিশ্ববিদ্যালয়ে যে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে তার কোনো প্রতিকার না করে উল্টো একশ্রেণীর শিক্ষকদের উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা আমার জানা নেই। শুধু এতটুকুই বলা যায়, জামায়াত-শিবিরের ঘাড়ে চেপে থাকা গোষ্ঠী বিশ্ববিদ্যালয়কে অশান্ত করে তোলার পাঁয়তারায় লিপ্ত রয়েছে। আমরা সবাই জানি যে, একজন উপাচার্য রাষ্ট্রীয় অনেক কাজসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকেন। প্রতিটি বিভাগের জন্য নির্দিষ্ট লোকজন রয়েছেন। সেখানে কিছু হলেই উপচার্যের পদত্যাগের দাবি তোলা ঠিক নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক তথ্যে জানা গেছে, ঘটনার দিন উপাচার্য ছিলেন পাবনার একটি অনুষ্ঠানে। বিশ্ববিদ্যালয়ে না থাকায় দায়িত্বে ছিলেন অন্য একজন। প্রশ্ন হচ্ছে, যে-ই দায়িত্বে থাকুন না কেন অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনার জন্য পদত্যাগ কি সঠিক সমাধান? ইতোমধ্যে লক্ষ্য করা গেছে, কেউ কেউ বলছেন, উপাচার্য বহিরাগত (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। তাহলে কি ধরে নেয়া যায় বহিরাগত হওয়ার কারণেই কি পদত্যাগের নামে আন্দোলন? কে বহিরাগত এবং কে এলাকার এটা কোনো কথা নয়। কথা হলো- প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ঠিক ভাবে হচ্ছে কি-না। আর তা যদি না হয় সবারই উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে উপাচার্যকে সুপরামর্শ দেওয়া। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কখনো ক্লাস বর্জন করা ঠিক নয়।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে শিক্ষকদের মধ্যে যে দলাদলি তা শিক্ষাব্যবস্থাকে ঠেলে দিচ্ছে বিপর্যয়ে। ব্যক্তিগতভাবে মতাদর্শ থাকতে পারে। কিন্তু ব্যক্তি স্বার্থে দলাদলি কাম্য নয়। বর্তমানে এমন স্বার্থই লক্ষ্য করা যাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিরোধী শক্তিগুলো সুযোগের অপেক্ষায় থাকার কারণেই এ অবস্থা বলা যায়। প্রতিষ্ঠানটির পূর্বসূরিদের ইঙ্গিতেই এমনটি হচ্ছে। নয়তো ঘটনার দিন উপাচার্য যখানে ঘটনাস্থলেই ছিলেন না, সেখানে পদত্যাগের কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল সুযোগ-সুবিধা থাকবে এটা আমরাও চাই। তা যদি না থাকে সেজন্য পরিকল্পিত ও সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। পদত্যাগ কোনো সমাধান দিতে পারবে না। আর শিক্ষকরা হয়তো ভুলে যাননি যাঁর পদত্যাগ দাবি করা হচ্ছে দিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। সেখান থেকেই পরিকল্পনা করেন কীভাবে দেশ স্বাধীন করা যায়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ও এ দেশের জন্য তাকে নানাভাবে নির্যাতিত হতে হয়েছে।

ড. আনোয়ার হোসেনকে পরিচয় করে দেওয়ার মতো সাহস আমার নেই। তাকে চেনেন না এমন কেউ আছে বলে আমার জানা নেই। তবুও নতুন প্রজন্মের কাছে আজ আমি দেশপ্রেমিক এই বীরকে সামান্য উপস্থাপন করতে চাই। কারণ তাঁর সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে এ প্রজন্মের অনেকে অবগত নয়।

অধ্যাপক আনোয়ার শুধু একাত্তরই নয়; পরবর্তী জিয়াউর রহমানের শাসনামল এবং সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও তিনি বীরের মতো লড়ে প্রমাণ করেছিলেন তার মধ্যে কতোটুকু দেশপ্রেম ছিল। তাকে যখন জাবির উপাচার্য করা হয়, তখন সুদূর আয়ারল্যান্ড থেকে বড় ভাই সাজেদুল চৌধুরী রুবেল আমাকে বলেছিলেন, “যা হোক, দেরিতে হলেও আমরা তাকে মূল্যায়ন করতে পেরেছি। ” তিনি আমার কাছ থেকে এও জানতে চান যে, নেত্রকোনার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যে বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছি তা আনোয়ার স্যারকে দেখিয়েছি কি-না। তিনি জানতেন, আমি এ ব্যাপারে পূর্বে স্যারের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা নিয়েছি।

এটা অনস্বীকার্য যে, মহান মুক্তিযুদ্ধে যে পরিবারের অনন্য ভূমিকা, সেই পরিবারের কৃতি সন্তান অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন কোনো ব্যক্তির নাম নয়। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। গর্বিত এই বীর পুরুষ নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামের মরহুম মহীউদ্দিন আহমদের পুত্র। তিনি শহীদ কর্নেল তাহেরের ভাই। জেলার যে সাতজন খেতাবপ্রাপ্ত হয়েছেন তার মধ্যে তাদেরই চার ভাই। তারা হলেন- শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম, আবু ইউসুফ বীর বিক্রম, শাখাওয়াত হোসেন বাহার বীর প্রতীক ও ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীর প্রতীক এমপি।

ছাত্রজীবন থেকেই বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন ড. আনোয়ার। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জুলুমবাজ শাসকদের হাতে বার বার নির্যাতিতও হতে হয় তাঁকে। বিপ্লবী রাজনীতি, জিয়ার শাসনামল থেকে শুরু করে সর্বশেষ গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশ রক্ষার আন্দোলনে ব্যাপক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে তরুণ প্রজন্মের যে দাবি উঠেছে তাতেও ড. আনোয়ার হোসেনের বীরদর্পের একাত্মতাও অনেকের সহ্য হয়নি। তাই মাননীয় শিক্ষকদের প্রতি অনুরোধ, পদত্যাগ বিষয় থেকে সরে এসে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে সবাই একাত্ম হয়ে কাজ করুন।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি দৈনিক সংবাদ, সিলেট অফিস

বাংলাদেশ সময়: ২১২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।