শাহবাগ চত্বরে যে তারুণ্যের জোয়ার বইছে, সমগ্র জাতির ইচ্ছাকে বাস্তবায়নে যে স্রোতধারা বইছে তাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায় ওয়ার ক্রাইমস্ ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি। ’৭১-এ যারা যুদ্ধ করছে, প্রাণ দিয়েছে, ’৬৯-এর আন্দোলনে যারা ঝাণ্ডা উড়িয়েছে, দেশের সকল প্রান্তে ছুটে ছুটে ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করছে, এ আন্দোলন তারই এক ধারাবাহিকতা।
এই অসাধ্য সাধন করতে যেয়ে শহীদ হলেন তরুণ স্থপতি আহমেদ রাজীব হায়দার। একটি স্ফূলিঙ্গের মৃত্যু নিশ্চিতভাবে শত-সহস্র স্ফূলিঙ্গের জন্ম দেবে, অজুত কণ্ঠে অনুরণিত হবে শহীদের স্লোগান। এর প্রতিবাদে কেবল এক দিনের জন্য কালো পতাকা উড়ালে হবে না, নানা প্রক্রিয়ায় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধকে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। কালোর সাথে লাল ঝাণ্ডা উড়–ক ২৫ মার্চ পর্যন্ত। ঘরে ঘরে প্রতিরোধ করতে হবে অশুভকে। পরিকল্পিতভাবে বিনাশ করতে হবে এদেরকে। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে যেমন এদের সংঘ, সংগঠন নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, তেমনি সংবিধানের ৩৮ ও ৬৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করে এদের রাজনীতি চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে। এদের অর্থনৈতিক সংগঠনের সাথে যারাই থাকবে তাদেরও বয়কট করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
আশা প্রকাশ করছি, এই তরুণরা নানা রাজনৈতিক ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলের প্রভাবমুক্ত থেকে, ব্যক্তি পূজার উর্ধ্বে উঠে, জাতিকে সত্যিকার অর্থে ঐক্যবদ্ধ ও আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলবে। তাদেরকে বুঝতে হবে এবং বোঝাতে হবে যে বর্তমান বিচারের সত্যিকার লক্ষ্যটি। তাদের হৃদয়ে পরিষ্কার হতে হবে আমরা কাদের বিচার চাচ্ছি। তাদের নিজেদের বুঝতে হবে কেন বিচার চাচ্ছি। তেমনি জনগণকে বিচারের প্রয়োজনীয়তা এবং অপরিহার্যতার বিষয়টি বোঝাতে হবে। জনগণের হাজার সমস্যার মাঝে এটা যে কেন মামুলি বিষয় নয়, শুধু কোন আবেগের বিষয় নয়, এটা সবাইকে বলতে হবে।
এই বিচারের মধ্য দিয়ে যেমন দেশে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে, তেমনি জাতির মর্যাদা তথা সমগ্র বিশ্বের মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। বিচারহীনতার মধ্যে দিয়ে জাতি যে নতজানু রাজনৈতিক বৃত্তে পতিত হয়েছিল এবং সামগ্রীকভাবে দেশের মানুষ অন্যায়ের সাথে সমঝোতায় এসেছিল, সেই নষ্টবৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার এটাই সময়।
এই বিচারহীনতা ও সমঝোতার কারণে জাতি যেমন আত্মপরিচয় সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে, তেমনি চুরমার হয়েছে মুল্যবোধ। আজ আমাদের যেমন নির্মাণ করতে হবে আত্মপরিচয়, তেমনি পুনর্নির্মাণ করতে হবে ধ্বংসপ্রাপ্ত মূল্যবোধগুলো। নষ্ট রাজনীতি, লুটেরা সমাজের প্রভাবকে বিনাশ করার লক্ষ্যে সকল তরুণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হতে হবে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। লুটেরা সংস্কৃতিনির্ভর তোষামদের রাজনীতি, ষড়যন্ত্র তথা কূটচালের রাজনীতি দিয়ে যেমন জাতির আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হবে না, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন অস্পষ্ট ও অধরাই থেকে যাবে।
এই তরুণরা পারবে নষ্ট রাজনীতি তথা নষ্ট দর্শনভিত্তিক ধর্মান্ধ রাজনীতি এবং সকল অশুভ প্রভাব থেকে জাতিকে মুক্ত করতে। জেগে থাক তারুণ্যের জোয়ার।
‘বন্ধু শ্রান্ত হয়ো না, ক্লান্ত হয়ো না, হাল ছেড়ো না তুমি। ’ তাদের সবাইকে আবার নতুন করে জানতে হবে বিচারহীনতার নেতিবাচক প্রভাবগুলো।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অভাবে যা হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো -
১. বিচারের প্রতি আস্থাহীনতা।
২. অপরাধ কর্মগুলোর বৈধতাকে পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দিয়ে সমাজে সীমাহীন অপরাধ ও সস্ত্রাসের বিস্তার।
৩. অপরাধীদের মনোজগতে নেতিবাচক পরিবর্তন।
৪. Arrogance of power বা সহিংসতা বৃদ্ধি।
৫. অপরাধীরা ধর্মান্ধ রাজনীতিতে বিশ্বাসী হওয়ায় মৌলবাদের বিকাশ ঘটেছে।
৬. Victim কর্তৃক অপরাধীর অপরাধ নিজ চরিত্র শোষণ। (Theory of absorption of crime *) এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে সমাজে ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা ও হীন স্বার্থপরতাসহ সমুদয় বর্বর কর্মকাণ্ডকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছে।
৭. সামগ্রিকভাবে নারীর মর্যাদা এবং মানুষের মর্যাদার অবনমন।
৮. অন্যায়ের প্রতি সামগ্রিক সহনশীলতার উদ্ভব।
৯. আত্মগ্লানিতে নিমজ্জিত জাতির সম্মানবোধে ফাটল সৃষ্টি।
১০. পরাজিত মনোবৃত্তির উদ্ভব।
১১. আত্মপরিচয়ের সংকট।
১২. শান্তি সম্পর্কিত ধারণায় বিপত্তি। (Confusion in the concept of peace)
১৩. অন্যায় কাজে দ্বিধা সংকোচ লোপ।
১৪. মূল্যবোধে আঘাত ও অবক্ষয়।
১৫. জাতিসত্তা ও অহংকারে আঘাত।
১৬. সামগ্রিকভাবে বিবেকের অবক্ষয়।
ইহজগতে ন্যায় বিচার না পেয়ে মানুষ হতাশাগ্রস্থ হয়েছে। এতে করে যুক্তির পথ ছেড়ে তারা অদৃষ্টবাদিতা এবং নানা ধর্মীয় কুসংস্কারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ’৭১-এ হত্যা, ধর্ষণ ও রাহাজানির মাধ্যমে বিত্তের উত্থানের বিষয়টি যথাযথ মনোযোগ না পাওয়ায় সমগ্র দেশে লুটেরা সংস্কৃতির বিস্তৃতি ঘটেছে এবং সামগ্রিকভাবে সমুদয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রবণতা সীমাহীনভাবে বেড়েছে। ন্যায় ও সত্যের প্রতি আস্থা হারিয়ে মানুষ মূল্যবোধ চূড়ান্ত অবক্ষয়ের সম্মুখীন হয়েছে।
জেগে থাক তারুণ্যের স্পৃহা, পর্বতের শৃঙ্খে উঠার অধম্য ইচ্ছা, সমুদ্রের তলদেশ থেকে জাতির স্বপ্নকে ফিরে আনবার প্রেরণা। ইচ্ছা থাকলে, শক্তি থাকলে, হিমালয়কে এ-ফোড় ও-ফোড় করা যায়।
‘অনতিক্রম্যকে অতিক্রম করে বিজয় মোরা আনবই’Ñ এটাই হোক তারুণ্যের স্লোগান। ‘ন্যায়ভিত্তিক সমাজের জন্য লড়ব, সত্য, ন্যায় ও জাতির মর্যাদা গড়ব’Ñ এমন স্লোগান উচ্চারিত হোক দেশের প্রতিটি কোনায়। নির্বাপতিত হবে না কখনও সত্যের অগ্নিশিখা।
এক্ষেত্রে সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো জামায়াতের কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে ছয় মাস থেকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা। নির্বাচন কমিশনকেও বাতিল করতে হবে তাদের নিবন্ধন। প্রয়োজনবোধে এবং বাস্তবতার আলোকে তাদের দর্শনভিত্তিক এবং সদস্যভিত্তিক নতুন দল গঠনও চিরতরে বন্ধ করতে হবে। রাজনীতি বন্ধ করতে হবে ঘাতকের। এই কাজটি করতে হবে কেবল একাত্তরে তাদের বিতর্কিত ভূমিকার জন্য নয়, দেশের বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ শুরু করার হুমকি দেবার জন্য। রাজনৈতিক দল হিসাবেও তাদের নিষিদ্ধ করতে হবে। অবৈধ ঘোষণা করতে হবে তাদের নষ্ট দর্শন ও রাজনীতি।
ঘাতক জামায়াত ও ইসলামি ছাত্রসংঘসহ যারাই একাত্তরে পাকিস্তানিদের দোসর ছিল বা আল-বদর বাহিনীর সদস্য ছিল তাদের সকলকে বিচারাধীন করতে হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। সেখানে দলেরও বিচার হতে পারে। ’৭১-এ এবং বর্তমানে সময়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য সামরিক আদালতেও তাদের দ্রুত বিচার হতে পারে। আর নয় স্বাধীনতাবিরোধীদের ঔদ্ধত্য ও তাণ্ডব।
লেখক: আহ্বায়ক, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি; সিইও ও জিএস, রিসার্চ ইনিশিয়াটিভস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট; প্রেসিডেন্ট ও চিফ সায়েন্টিস্ট, অ্যালার্জি অ্যাজমা অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৩
আরআর