টানা ১৭ দিন অবস্থানের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক গণজাগরণের প্রথম পর্ব শেষ করলো শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ। এবার তার দ্বিতীয় পর্ব যেখানে আদর্শিক লড়াইয়ের আসল পরীক্ষা।
সেই লড়াই শুরুর আগে গণজাগরণ মঞ্চ নিশ্চয়ই তার আন্দোলনের প্রথম পর্বের সাফল্য-ব্যর্থতা পর্যালোচনা করবে। তবে মিত্রদের মতো তার শত্রুরাও নিশ্চয়ই বসে নেই, তারাও অনেক হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত। যদিও দ্বিতীয় পর্বের সংগ্রাম শুরুর আগে গণজাগরণ মঞ্চের হাতে একদিনও বাড়তি সময় নেই তারপরও তার নিজেকে নিয়ে নিজের বোঝাপড়া করতে হবে। তার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ শত্রুরা সম্ভাব্য কি ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করেছে সেই ধারণাও থাকতে হবে সংগঠকদের।
তবে সবার আগে গণজাগরণ মঞ্চের তার নিজের অর্জনগুলো জানা বেশি জরুরি। এই পর্যালোচনায় যেমন আত্মতুষ্টিতে ভোগা ঠিক হবে না, ঠিক তেমনই কোনো অর্জনকে খাটো করে দেখাও ভুল হবে। যদি প্রশ্ন করা হয় ১৭ দিনের টানা আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্য কি? তাহলে আমি নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা জানাবো। ব্লগারদের স্ফূলিঙ্গ থেকে দাবানল হয়ে উঠা আন্দোলনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে যে অভিজ্ঞতা ছোট করে ওই বিষয়গুলো আমি ফেইসবুকে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করেছি। অন্যদেরও নিশ্চয়ই একই রকম অভিজ্ঞতা। তারপরও ফিরে দেখা যাক আরো একবার।
প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনের দুই দিনের মাথায় ফেইসবুকে আমি লিখেছিলাম: শাহবাগ আন্দোলনের পরিণতি কি? এই প্রশ্ন এখন সবার। কিন্তু আমি তার উত্তর খুঁজছি না। কারণ আমার ৮ বছরের কন্যা এবং ৬ বছরের ভাতিজা যখন জিগগেশ করলো, দেশে নাকি আবার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে; তখন নিশ্চিত হয়েছি এরইমধ্যে দীর্ঘস্থায়ী এক ইতিবাচক পরিণতি পেয়েছে শাহবাগের আন্দোলন।
পরদিন ছিলো গণজাগরণ মঞ্চের প্রথম মহাসমাবেশ। সেদিন তারা দু’জনই শাহবাগে গিয়েছিলো। এরপর তাদের আর প্রজন্ম চত্বরে যাওয়া না হলেও প্রতিদিন সকাল-বিকাল এক ফ্ল্যাট থেকে আরেক ফ্ল্যাটে যাওয়ার সময় আরও কয়েকজনসহ তাদের স্লোগান দিতে দেখেছি। কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবির সঙ্গে তাদের স্লোগানে ছিলো ‘জয়বাংলা’ আর ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’।
ফেইসবুকে তাদের ছবি দেখে নিউইয়র্ক থেকে সাংবাদিক আমান-উদ-দৌলা লিখেছিলেন, ‘২০২০ সালের পর এরাই আরেকটি শাহবাগের সূচনা করবে। আজ তারা দেখছে, শিখছে। ’ আমার উত্তরটাও এখানে উল্লেখ করবো যেখানে বলেছিলাম: ‘শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যখন আন্দোলন শুরু করেছিলেন তখন আমার এক ভাতিজি ক্লাস ওয়ানে পড়ে। একদিন তার সাধারণ জ্ঞান বই থেকে প্রশ্ন করছিলাম। একটি প্রশ্ন ছিলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নাম কি? সে আব্দুর রহমান বিশ্বাস বলার পর দুষ্টুমি করে জানতে চাই, তিনি মুক্তিযোদ্ধা নাকি রাজাকার! সঙ্গে সঙ্গে তার উত্তর, রাজাকার। যখন জানতে চাইলাম কিভাবে সে তা জানে, তার উত্তর ছিলো শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কাছ থেকে। তখনও সে নিশ্চয়ই শহীদ জননী অর্থ ভালো বোঝে না, রাজাকার এবং মুক্তিযোদ্ধার পার্থক্যও খুব বেশি জানে না; কিন্তু যা জানার তা ঠিকই জেনেছিলো। শহীদ জননী এভাবে একটি প্রজন্মের জন্ম দিয়ে গেছেন, আজকের শাহবাগে নিশ্চয়ই সেই প্রজন্মের অনেকেই আছেন। ’
আসলেই তাই। শাহবাগে শহীদ জননীর বড় বড় প্রতিকৃতিই প্রমাণ করে আন্দোলনকারীদের কাছে কতো বড় নাম শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। একটি চেতনার আন্দোলন আসলে একটি প্রজন্মের জন্ম দেয়। শহীদ জননীর আন্দোলনে তাই হয়েছে। কিভাবে? তার আরও কিছু প্রমাণ আছে।
হয়তো উদাহরণগুলো ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে। তারপরও বলছি, কারণ আমার মনে হয় শাহবাগ আন্দোলনে এখন ঘরে ঘরে একই অভিজ্ঞতা। তার একটি নমুনা আমার ১৯ ফেব্রুয়ারির ফেইসবুক স্ট্যাটাস: ‘ছয় বছরের ভাতিজা, কেজিতে পড়ে। বাংলা ক্লাসে ‘া’ (আকার) দিয়ে শব্দ লিখতে দিয়েছিলেন টিচার। পুরো পাতা সে যা শিখেছে তা লিখার পর শেষ লাইনে লিখেছে, রাজাকারের ফাঁসি চাই। সে শাহবাগে গিয়েছিলো মহাসমাবেশের দিন, মোমবাতি প্রজ্বলনের দিন বাসার ছাদে মোমবাতি জ্বালিয়েছে। শাহবাগ এভাবে গড়ে তুলছে মুক্তিযুদ্ধের নতুন প্রজন্ম। ’
পরদিন সকালে মনে হলো, আরেকজনের কথা বলতে ভুলে গেছি। তার মায়ের অনুমতিসহ বন্ধুদের জানালাম ওই শিশুর কথা, সবার ছোট হয়েও যে স্লোগান লিডার। তার কথা বলা হয়েছিলো এভাবে: ‘ভাতিজা দাইয়্যানের পর ফিদেলের কথা শুনুন। সহকর্মী শিলা-সজলের ছেলে ফিদেল, প্লে-গ্রুপে পড়ে। মহাসমাবেশের দিন সেও শাহবাগে গিয়েছিলো, মোমবাতি প্রজ্বলন করেছিলো বাসার ছাদে। এখন সে ঘোষণা দিয়েছে, তার বাসা শাহবাগ; শাহবাগই তার বাসা। ’
শুধু সেøাগানে যে বলা হয়, এমন নয়। শাহবাগ এভাবে আড়াই সপ্তাহে আসলেই বাংলাদেশের নতুন হৃদয় হয়েছে, জাতির সব শুভ চিন্তার মোহনা হয়েছে, একাত্তরের মানুষের নতুন ঠিকানা হয়েছে। কে যায়নি সেখানে! নিজের ঘরের পাশের মানুষটি একটু দেরিতে শাহবাগে গিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে: ‘আমিই বোধ হয় সবার শেষে গেলাম শাহবাগ। কখনো মিছিল করিনি, তারপরও ক্ষতিপূরণ হিসেবে গলার সবটুকু জোর দিয়ে স্লোগানে গলা মিলিয়েছি। ’
গত কয়েকদিন তার মতো লাখ লাখ মানুষ শাহবাগে গিয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সাইন্সে পড়া যে ছোটভাই সকালকে জীবনে মুভি-মিউজিক-মেইসি ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলতে শুনিনি, সে যেমন দিনের পর দিন শাহবাগে গিয়েছে; তেমনই যে বোন স্কুলে শিক্ষকতার পর নিজের লাইব্রেরি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তিনিও গিয়েছেন। নিজের চারপাশের মানুষ দিয়ে অনেক কিছুই বোঝা যায়। তাতেও বোঝা না গেলে শাহবাগে মানুষের চেহারায় স্পষ্ট হয়েছে, চেতনার ওই মঞ্চে যেমন সব শ্রেণীর মানুষ ছিলেন; তেমনই ছিলেন সব চিন্তার মানুষ যাদের মধ্যে চিন্তার অনেক ভিন্নতা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে সবাই একমত।
তবে শুধু এই লাখো মানুষের শাহবাগ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্যই কি একে গণজাগরণ বলা হচ্ছে অথবা সারাদেশে গণজাগরণ মঞ্চের মতো প্রতিবাদী সভা-সমাবেশ ছড়িয়ে পড়ার জন্য! শুধু কি এজন্যই একে গণজাগরণ বলা হচ্ছে যে মানুষ কোনো রকম স্বার্থ এবং প্রচারণা ছাড়াই এই আন্দোলনে সশরির সম্পৃক্ত হয়েছে যেখানে আমাদের বড় দুই দলকেও শুধু ট্রাক-বাস নিশ্চিত করলেই হয় না, জনসভা-মহাসমাবেশে মানুষ আনার জন্য নগদ টাকাও গুণতে হয়। এটি এই আন্দোলনের সফলতার একটি দিক। কিন্তু শুধু মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণের জন্যই একে গণজাগরণ বলা যাবে না। বৃহত্তর অর্থে এটি এই কারণে গণজাগরণ যে যতো মানুষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়েছে তার চেয়েও আমার-আপনার মতো ঘুমিয়ে থাকা হাজার গুণ বেশি মানুষের ঘুম ভেঙ্গেছে। নতুন করে তারা ফিরে গেছে একাত্তরে, যে একাত্তর তাদের শিকড় কিন্তু তারা প্রায় ভুলতে বসেছিলো। এই আন্দোলন এ কারণেও গণজাগরণ যে নতুন প্রজন্মের আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার করলেও জেগে থেকেও অনেকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভাবছিলেন, গাছের পাকা ফল পেড়ে খাওয়ানোর মতো শেখ হাসিনা নিজ দায়িত্বে খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবেন আর জামায়াতি প্রজননে যাদের জন্ম তারা মুখে ললিপপ দিয়ে বসে থাকবে।
বৃহত্তর অর্থে এভাবে শাহবাগ এক প্রকৃত গণজাগরণ সৃষ্টি করেছে যে গণজাগরণ তার প্রথম পর্ব শেষে এক ঐতিহাসিক রূপান্তরের দ্বারপ্রান্তে। তবে শুরুর চেয়েও এই দ্বিতীয় পর্ব আরো কঠিন। কারণ এখানে দ্বন্দ্বটা আরো সরাসরি যে দ্বন্দ্বে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে এরইমধ্যে ‘কথিত জামায়াতবিরোধী’ ধর্মীয় দলগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। কিছুটা মুখলজ্জা আর কিছুটা সম্ভাব্য ভোটের আশায় তাদের পৃষ্ঠপোষকরা শাহবাগ আন্দোলনকে স্বাগত জানালেও জামায়াতকে ঝেড়ে ফেলতে না পারায় স্পষ্ট, সময়মতো শিফন-জর্জেটে সরাসরি তারাও দাঁড়িয়ে যেতে পারে খুনি এবং ধর্ষকদের পক্ষে, আতর-লোবানও যাদের দুর্গন্ধ দূর করতে পারেনি।
বিপরীতে গণজাগরণ মঞ্চের সহায়ক হতে পারে এমন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে এখনও স্লোগান নিয়েও মানসিক বিভক্তি। প্রজন্ম চত্বরের অমর একুশের মহাসমাবেশে এক ছাত্রলীগ নেতা ‘জয়বাংলা’র পর ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ও বলায় টেলিভিশনের সামনে এবং আমার পাশে থাকা এক নৌকা সমর্থক বলে উঠলো, ছেলেটা বঙ্গবন্ধুর কথা বলাতে এদের ঐক্য যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলেতো যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবির আন্দোলন ভেস্তে যেতে পারে। আমি তাকে বললাম, আমি যেভাবে ভাবতে চাই সেই রাজনীতির ছাত্রনেতা যদি ‘জয়বাংলা’ না বলে ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক’ বলতে পারেন; ছাত্রলীগ নেতাকে পাশে রেখে যদি আওয়ামী লীগের সস্তা নির্বাচনী স্লোগান ‘নৌকার মালিক আল্লাহ’র সমালোচনা করতে পারেন; তাতে যদি তোমার সমস্যা না হয়; অথবা পাশে থাকা ছাত্রলীগ নেতার কিংবা তার মূল দলের; তাহলে ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলাতে সমস্যা কোথায়?
তবে আপাতত এইসব বিষয় যতো দূরে রাখা যায়, দলীয় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ যতো না করা যায় ততোই মঙ্গল। কারণ ইতিহাসের চাকা সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর চাকা আবারো পেছানো বন্ধ রাখতে আন্দোলনে জয় ছাড়া নতুন প্রজন্মের সামনে দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই।
জাহিদ নেওয়াজ খান, বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই।