ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

তোমারে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে

জাহিদ নেওয়াজ খান, সাংবাদিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৩
তোমারে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে

তারপরও বিএনপির ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ অবস্থানই আশা করছিলেন কেউ কেউ। জামায়াতকে কোলে নিয়ে বসে থাকলেও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চকে স্বাগত জানানোর কারণে তারা মনে করেছিলেন অন্তত: একটি পরিণতি পর্যন্ত দু’ নৌকাতেই পা রাখবে বিএনপি।

প্রধান বিরোধীদল এভাবে মুখে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তার অবস্থান ধরে রাখবে বলে আশা ছিলো তাদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদেরও হতাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের দল। রোববারের হরতালে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে বিএনপি নিজেই প্রমাণ করেছে, তারা তাদের পক্ষে যারা জাতীয় পতাকায় আগুন দিয়েছে, শহীদ মিনার ভাংচুর করেছে, সাংবাদিকদের আক্রমণ করেছে।

হরতালে বিএনপির সমর্থন এসেছে কোনো রাখঢাক না রেখেই, সরাসরি, আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে। শুধু তাই নয়, নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে ওই সমর্থন ঘোষণার পর কয়েক জায়গায় বিএনপি নিজেদের দায়িত্ব মনে করে হরতালের সমর্থনে মিছিলও করেছে। এরকমই একটি বড় মিছিল হয়েছে নোয়াখালিতে। সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে ডাকা হরতালের সমর্থনে মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন বিএনপি নেতা, এক পৌর চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে কয়েকজন গুলিতে আহত।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার চেষ্টা হিসেবে জামায়াতের হরতালে অবশ্য এর আগেও সমর্থন জানিয়েছে বিএনপি। দুয়েকবার বিএনপি নেতারা জামায়াতের হরতাল নিয়ে নীরব থাকলেও দুয়েকটিতে তাদের ভাষায় নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। এবার আর সেই পর্যায়ে থাকেনি প্রধান বিরোধীদল। আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ণ সমর্থন জানানোর পাশাপাশি কয়েক জেলায় বিএনপি হরতালের পক্ষে মাঠেও নেমে গেছে।

এভাবে কেন্দ্র থেকে হরতালে পূর্ণ সমর্থন এবং মাঠে হরতাল সফল করার চেষ্টার আগের দিনও বিএনপি প্রমাণ করেছে নতুন প্রজন্মের আন্দোলনের যে চেতনা তার এক বিন্দুও ধারণ করে না জাতীয়তাবাদী দল। জামায়াতসহ নতুনভাবে তাদের সমর্থনে মাঠে নামা কয়েকটি ধর্মীয় দল শুক্রবার সারাদেশে জুমআ’র নামাজের পর তা-ব চালালেও ‘একচক্ষু হরিণের‘ মতো বিএনপি হতাহতের ঘটনায় শুধু সরকার ও তার পুলিশ বাহিনীকে দায়ী করেছে।
বিএনপির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত মিত্ররা ওইদিন জাতীয় পতাকার অবমাননা করলেও বিবৃতিতে এ নিয়ে একটি কথাও বলেনি সেই দল, যে দলের নেতারা সবচেয়ে বেশি সময় গাড়ি ও বাড়িতে রক্তে অর্জিত জাতীয় পতাকা উড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন। রক্তে অর্জিত ভাষার মর্যাদা রক্ষার স্মারক শহীদ মিনারে হামলা হলেও বিবৃতিতে তা নিয়ে একটি শব্দও বলেনি সেই দল, যে দলের নেত্রী সরকার প্রধান হিসেবে সবচেয়ে বেশিবার শহীদ মিনারে গেছেন। জামায়াত ও তার মিত্ররা যে বেছে বেছে সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে তা নিয়েও কিছু বলেনি বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে গণমাধ্যমও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার দাবিদার বিএনপি। ধর্মীয় সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মসজিদের ভেতর ভাচুর করলেও, মসজিদের ভেতর আগুন দিলেও তা নিয়েও কিছু বলেনি সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা সরিয়ে বিসমিল্লাহ বসানো বিএনপি, যে বিএনপি সব সময়ই দাবি করে বাংলাদেশে তারাই ইসলামের সবচেয়ে বড় রক্ষক।

বিএনপির এই নীরবতা একদিকে তার আদর্শিক অবস্থান, অন্যদিকে ভোটের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ। শাহবাগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিএনপির এই ধারণা হয়েছে আগামী নির্বাচনে আবারো তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে নতুন প্রজন্ম। তরুণরা ডজন ডজন ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকারের দিকে বীতশ্রদ্ধ হলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রশ্নে, জঙ্গিবাদের হুমকিমুক্ত জীবনের প্রশ্নে তারা আবারো আওয়ামী লীগকে বেছে নিতে পারে। এই আশংকার কারণে বিএনপি ঘুরেফিরে শাহবাগ আন্দোলনের নেপথ্যে সরকারের হাত দেখেছে। সরকারের রাজনীতি দেখেছে।

কিন্তু শাহবাগ আন্দোলন থেকে আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনী ফল পেতে চায় তার জন্য আওয়ামী লীগের কি দোষ! একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির মতো আওয়ামী লীগেরও মূল লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় থাকা। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে সে নিশ্চয়ই চাইবে না যে তার ব্যর্থতার দিকগুলো নিয়ে তরুণ প্রজন্ম ফুঁসে উঠুক। সরকারে থেকে তার একমাত্র চাওয়া হবে এমন ইস্যুতে জনমত গড়ে উঠুক যে ইস্যুতে তার ভোট না বাড়লেও অন্তত: প্রতিপক্ষের বাক্সেও যেনো ভোট না যায় তা নিশ্চিত হোক। নতুন প্রজন্ম তাই যখন শেকড়ের টানে, অস্তিত্বের খোঁজে যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে তখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা তাতে একাত্ম হয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন তার রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে তা পারেননি।

এটা একদিকে যেমন দুই দলের অন্তত: এক ইস্যুতে বড় আদর্শিক পার্থক্য, তেমনই দুই দলের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সফলতা-ব্যর্থতারও এক  প্রমাণ। কাঁচের ঘরে থেকে বিএনপি গত ৪ বছরে মনে করেছে, সরকারের এতো এতো ব্যর্থতার কারণে তারা ৫ বছর আরামসে ঘুমিয়েও নির্বাচনে গেলেই ধানের শীষ ও দাড়িপাল্লার বাক্স ভরে জনগণ ভোট দেবে। শুধু মাঝেমধ্যে দুয়েকটি হরতাল করলেই জনগণ প্রথম সুযোগেই তাদের ক্ষমতায় নিয়ে যাবে। নিজেদের অতীত ভুল যে তারা শোধরাতে পেরেছেন তা প্রমাণ করতে না পারলেও ‘কুছ পরোয়া নেহি’র মতো তারা ভেবেছেন আগামীতে গাড়ি ও বাড়িতে পতাকা উড়ানোর সম্মান তাদেরই দেবে জনগণ। এজন্য ক্ষমতার পালাবদল ঘটায় যে নতুন প্রজন্ম তাদের হৃদয় দিয়ে পড়াতো দূরের কথা, হাত না ছুঁইয়েও তাদের সমর্থন পাওয়া যাবে।

কিন্তু সময় যে পাল্টে গেছে তা তারা টের পায়নি। ইতিহাস বিকৃতিতে আগের কয়েক প্রজন্মের বড় অংশ বিভ্রান্ত হলেও এমন একটি প্রজন্ম যে গড়ে উঠছে যারা অতীতের অমীমাংসিত বিষয় মীমাংসা করেই যে সামনের দিকে তাকাতে চায়, তা তাদের হৃদয় বা মস্তিষ্ক কোনোটি দিয়েই পড়তে পারেনি বিএনপি। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে পুরোপুরি সফল না হলেও অন্তত: স্বপ্ন দেখানোর প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সাফল্যের বিপরীতে বিএনপি এটা ধরতেই পারেনি, গত এক দশকে এমন এক প্রজন্ম গড়ে উঠেছে যারা শুধু প্রযুক্তিতেই আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে না, অনলাইনে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে চিন্তা-চেতনা-মননেও আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে যে বাংলাদেশ হবে অসাম্প্রদায়িক।

এ কারণেই সরকারের অনেক ব্যর্থতা, একগুঁয়েমি, সুশাসনের অভাব, অনেক প্রতিশ্রুতি পূরণে অসাফল্যের পরও কোনো আন্দোলনে নতুন প্রজন্মকে পায়নি বিএনপি। বহিরঙ্গে আধুনিক খালেদা জিয়ার পাশে সময়ের চাকাকে পেছনে নিতে চায় এমন লোকদের দেখে তরুণ প্রজন্ম তার মধ্যে আশার কোনো বাতিঘর দেখতে পারেনি। এভাবে বিরোধীদল হিসেবে বিএনপি ব্যর্থতার এক চরম নজির তৈরি করেছে।

সেই ব্যর্থতা কাটাতে বিএনপি তার কোলে রাখা জামায়াতকে আরো আঁকড়ে ধরার সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের নতুন আণ্ডা-বাচ্চাদেরও ঘাড়ে তুলে নিচ্ছে। দেশে যে আধুনিক প্রজন্ম গড়ে উঠেছে তাদের স্বাগত না জানিয়ে, সব জায়গার মতো সেখানেও থাকা দুয়েকজন কট্টরপন্থী-নৈরাজ্যবাদীর মন্তব্যকে পুঁজি করে, মৌলবাদী গোষ্ঠিকে উস্কে দিচ্ছে। বিএনপি একে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি মনে করলেও জামায়াত এবং তার নব্য সমর্থকদের লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানো, যে বিচার এখন প্রধান দ্বন্দ্বের প্রধান দিক, যে দ্বন্দ্বে স্বাধীনতাবিরোধীদের মুখোমুখি নতুন প্রজন্ম। সেই দ্বন্দ্বের মীমাংসায় বিএনপি নতুন প্রজন্মের সাথী না হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে স্বাধীনতাবিরোধীদের ললাটে চুমু এঁকে দিচ্ছে। কিন্তু তার জবাব একদিন বিএনপি পেতে পারে বিষ ছোবলে।

আর নতুন প্রজন্মের সহায়তায় বিষধর সেই সাপকে আওয়ামী লীগ এখন ঝাপিতে পুরে ফেলতে পারলেও তারও আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ  নেই। যে জাগরণ মঞ্চ এখন শুধু ইতিহাসের দায়বদ্ধতা থেকে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি জানাচ্ছে, তারা ভবিষ্যতে ভিন্ন কোনো নামে, ভিন্ন কোনো রূপে রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশে আবারো ফিরে আসতে পারে সুশাসনের আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর বলেছে, তাদের এখন বাংলা পরীক্ষা চলছে; ভবিষ্যতে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি-ম্যাথ পরীক্ষায়ও যে তারা বসবে না সে কথা কিন্তু তারা বলেনি। তবে এই বাংলা পরীক্ষায় গণজাগরণ মঞ্চের জিপিএ-ফাইভের জন্য জামায়াত নামের সাপটিকে খাঁচায় ভরতে সরকারকেও কৌশলী হতে হবে অনেক। সে সঙ্গে বৃহত্তর এমন এক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম শুরু করতে হবে যাতে সাপটি ভবিষ্যতে ফোঁস ফোঁসও করতে না পারে।

জাহিদ নেওয়াজ খান: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই (znewaz@gmail.com)

বাংলাদেশ সময় ১৩৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।