কিছুটা ঔদ্ধত্য বলতে পারেন। এ লেখাটি লেখা আমার মত নবীন সংবাদকর্মীর জন্য দুঃসাহসই বলতে পারেন।
সোমবার দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি খবরের দিকে শুরুতেই দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ভেতরের পাতায় ছাপা হওয়া সেই খবরের শিরোণাম "সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর ঐক্যপ্রক্রিয়া থেমে গেলো" । ভেতরে বিস্তারিত লেখা এমন ,"সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা সাংবাদিকদের ঐক্যপ্রক্রিয়া আর এগোচ্ছে না। মূলত রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং কারও কারও ব্যক্তিস্বার্থের কারণে দ্বিধাবিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়ন একীভূত হচ্ছে না। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসি এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের ঢেউ সাংবাদিক ইউনিয়নের রাজনৈতিক বিভক্তি স্পষ্ট করে দিয়েছে। ইউনিয়নের দুই অংশ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের দুই বিপরীত প্রান্তে অবস্থান নিয়ে আলাদা কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে। " কিন্তু কেনো ? সাগর-রুনী হত্যাকা-কে ঘিরে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আমরা যারা নবীন এবং যেসকল প্রবীন এখনও সমঝোতার পথে হাঁটতে চাননা তারা তাঁরা প্রত্যেকেই আশা করেছিলাম সাংবাদিকদের নেতৃত্বে এবার বুঝি ঐক্য এলো। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে প্রায় এক বছর ধরে চালিয়ে আসা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের একপর্যায়ে ইউনিয়নের দ্বিধাবিভক্তি ঘুচিয়ে একীভূত হওয়ার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিলেন সাংবাদিক নেতারা। কিন্তু এরপর ?
সাংবাদিকদের নেতৃত্ব নিয়ে বরাবরই সংকট দেখা দিয়েছে। নেতা কি কম আছে ? সাংবাদিক সংগঠনওতো কম না? তবে কেনো বারবার সাংবাদিক নির্যাতনের পরও তার সুবিচার মেলেনা। কেনো ইতিহাসের পাতায় এখনও কোন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের সাজার রায় লেখা হলো না? কেনো শেষ বিকেলের আলোয় ম্লান মুখে ফিরে যেতে হয় একজন সংবাদকর্মীর পরিবারকে? উত্তর কখনো মিলবে না? সাংবাদিকতা বলতে যে সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলি, বলি সততা আর নিষ্ঠার কথা কিংবা আন্তরিকতার সঙ্গে মানবিকতার কথা তার কতটুকু আমাদের নেতাদের নেতৃত্বে প্রতিফলিত হয়? কেনো তাঁরা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক বলয়ের ভেতরে একটি নির্দিষ্ট আদর্শের গণ্ডিতে নিজেদের বেঁধে রাখেন? প্রশ্নগুলো সহজ। কিন্তু উত্তর?
বর্তমান রাজনীতিবিদদের নিয়ে একটা কথা প্রচলিত। এখন রাজনীতিকরা রাজনীতি করেননা, যারা করেন তারা আমলা। ঠিক এমনই যারা সাংবাদিক নেতা তারা আমার মত আম-সাংবাদিকদের জন্য নয়, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই নেতৃত্বে। কারা এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন ? কেউ একটি নির্দিষ্ট দলের হয়ে নির্বাচন করেছেন, কেউ দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হয়ে বসে আছেন। কোন একটি নির্দিষ্ট দলের নেতানেত্রীর ছবি সম্বলিত পোস্টার দেয়ালে সাঁটিয়েছেন। কেউবা নির্দিষ্ট ঘরানার প্যানেল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। কেনো সাংবাদিক সমাজেও রাজনীতির ছোঁয়া থাকতে হবে? কেনো আপনাকে আমাকেও চাটুকারিতা করতে হবে কোন একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শের। এটা সত্য এখনও আমাদের দেশে এই সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি যেখানে রাজনৈতিক দলের মদদ ছাড়া কিংবা সমর্থন ছাড়া নতুন কোন পত্রিকা কিংবা টেলিভিশনের লাইসেন্স আদায়। কিন্তু এটাতো ঠিক, যেভাবেই আদায় করিনা কেনো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতি থাকছে। শুরুতেই ওয়াদা করি, সততা আর নিষ্ঠার। এই আমাদের নেতারাই যখন রাজনৈতিক দলের তোষামদে মত্ত তখন কাদের তোষামোদ করেন? অবশ্যই প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আর কখনো কখনো কেউ কেউ জামায়াতকেও (সাম্প্রতিক সময়ের উদাহরণ থেকে)। কিন্তু যারা আমাদের সাংবাদিককুলের নেতৃত্বে তারা কি করেন? কোন প্রতিষ্ঠানে আছেন? তাদের প্রতিষ্ঠানের কাটতি কতটুকু? শুধু এই নেতৃত্বে থেকেই তারা নাকি বহু কিছুই আয় করেন? বাজারে কথিত আছে, আন্দোলনের দোহাই দিয়ে নিজেদের ফায়দা লুটেন তারা। মানতে চাইনা, বিশ্বাস করতেও না। শ্রদ্ধার সঙ্গেই বলছি, আমিও চাই আমার সমাজের যিনি বা যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁরা আমার পক্ষেই থাকবেন। আমার জন্য লড়াই করবেন, নিজের সুবিধার জন্য নয়।
সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে কতটা ভালো লেগেছিল তা প্রকাশ করতে পারবোনা। প্রায়শই রাজপথে রাজনৈতিক দলের মিছিল স্লোগানের সংবাদ কাভারের ভিড়ে সেদিন রাজপথে আমারও দ্রোহের প্রকাশ ঘটেছিল। কোন সংগঠনের হয়ে নয়, সাংবাদিক সমাজ হয়ে আমি আমার ভাইয়ের-বোনের, সহকর্মীর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। এরপর কত সময় পার। ঘটনাপ্রবাহ গড়িয়েছে অনেকটা পথ। এই বাংলানিউজেই শ্রদ্ধেয় সাহেদ আলম লিখেছিলেন, প্রতিবাদের নতুন অক্ষর শোকের কালোয় ঢাকা "J" "জে" নিয়ে। ফেসবুকে সব গণমাধ্যমকর্মী আর সাধারন অনেকেরই প্রোফাইল পিকচার ছিল তা। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই সবার প্রোফাইলই বদলে গেছে। ভুলে গেছে অনেকেই আমার মত আরও হাতে কয়েকজন এখনও প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছি নীরবে। হয়ত এই প্রতিবাদ কারো কাছে, কেবলই নিজের জন্য নিজের দ্রোহের প্রকাশ। এমন করেই আমাদের সাংবাদিক নেতারাও ভুলতে বসেছেন। ঐক্যে ধরেছে ঘুন।
সংগঠন ভিন্ন থাকতেই পারে। ভিন্ন আদর্শের সাংবাদিকও থাকতে পারে। তাদের জন্য একই ঘরানার নেতৃত্বই প্রয়োজন। কিন্তু আমার মত ক্ষুদ্র একজন গণমাধ্যম কর্মীর চাওয়া সেই নেতৃত্ব যেনো এমন কোন আন্দোলন না করে, যেটা কোন রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। আর সেই নেতৃত্বে যেনো এমন কোন নেতা না থাকে, যারা সরাসরি কিংবা যাদের অবস্থান স্পষ্ট যে, তিনি কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের আদর্শকে বিশ্বাস করেন।
সাংবাদিকদের এমন নেতৃত্বই আশা করি , যারা সত্যিকার অর্থেই সংবাদকর্মী (দু-একটি সংগঠনে ইতোমধ্যেই তার প্রতিফলন ঘটেছে)। যারা অন্তরে কোন রাজনৈতিক আদর্শ স্থাপন করলেও তার প্রকাশ অন্তত সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নিয়ে আসবেননা। এখনো সাংবাদিকতা পেশার প্রতি মানুষের সম্মান আছে, অনেকেই ইচ্ছে প্রকাশ করে বড় হয়ে সাংবাদিক হওয়ার। প্লিজ দয়া করুন, সাংবাদিক নেতারা। আপনাদের কর্মকাণ্ডে আপনারা মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে গা ভাসিয়ে দেবেন না। রাজনৈতিক দলের এমন পারপাস সার্ভ করার মধ্য দিয়ে যে অসম্মানের সূচনা হবে সেটি নিয়ন্ত্রণ বড়ই কষ্টসাধ্য আর সময়ের ব্যাপার হয়ে উঠবে। আর নয়তো এরপর সাংবাদিক নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সচেতন হতে হবে।
সবশেষে সব সাংবাদিকের জন্যই কবিগুরুর গান, "আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পূণ্য করো দহন দানে"।
সাইফুদ্দিন রবিন, সংবাদ কর্মী, saifuddin.robin@gmail.com
বাংলাদেশ সময় ২২৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৩
এমএমকে