পদ্মাসেতু নিয়ে যেন আলোচনা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। প্রতিদিন কোনও না কোনও নতুন খবরের জন্ম দিচ্ছে প্রমত্ত পদ্মার ওপর নির্মাণ পরিকল্পিত ভবিষ্যত সেতুটি।
বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষের এই ক্রান্তিলগ্নে পদ্মা সেতুর নির্মাণের থেকেও এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন যেন এক বিশাল ইস্যু হয়ে দাড়িয়েছে। পদ্মাসেতু নিয়ে তোড়জোড় দেখে ধারণা করে নিতে কষ্ট হয় না যে, পদ্মাসেতু যতটা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা দরকার আসলে তার থেকেও বেশি দেখা হচ্ছে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। যেহেতু বর্তমান সরকারের নির্বাচন ইশতেহারে এই সেতু নির্মাণ প্রধান একটি নির্বাচনী ওয়াদা ছিল, কাজেই সরকার যদি অন্তত ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে সক্ষম না হয়, তবে আগামী নির্বাচনে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয় যায় না। এছাড়াও বর্তমান প্রশাসনের দুর্নীতি কেলেংকারি ধামাচাপা দিতেও পদ্মাসেতুর শুরুটা করা বেশ জরুরি হয়ে পড়েছে।
২৯১ কোটি ডলারের পদ্মাসেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক স্বল্প সুদ এবং গ্রেস পিরিয়ডযুক্ত ১২০ কোটি ডলার ঋণ এবং সেই সাথে বাদ বাকি অর্থ এডিবি, জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের কাছে প্রাপ্তি সব মিলিয়ে বেশ সহজ ও মসৃণ পথেই পদ্মাসেতু বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছিল। কিন্তু সেতু নির্মাণে দরপত্র আহ্বানের সময় একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা প্রদানের অভিযোগ তুলে গত বছরের জুন মাসে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বাতিল করে।
এসময় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির অভিযোগ আমলে না নিয়ে নিজেরাই পারব এই ঘোষণা প্রদান করেছিলেন। যদিও তলে তলে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার সরকারের নানামুখি তত্পরতার কারণে শর্তসাপেক্ষে বিশ্বব্যাংক পুনরায় ফিরে আসে। এরপর শর্তানুযায়ী দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতির তদন্ত শুরু করে মামলা করলেও তা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের টানাপোড়নের এক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকার অর্থ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্বব্যাংকের সাথে সাথে অন্য দাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকেও ঋণ প্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সেই সাথে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে পদ্মাসেতু প্রকল্পের ভবিষ্যত।
এত কিছু হতো না যদি না সরকার কোনও বিশেষ ব্যক্তি-মহলকে আড়ালে রাখার জন্য উঠে পড়ে না লাগতো।
বিশ্বব্যাংক উত্থাপিত দুর্নীতির ব্যাপারে কোনো রকম পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরে থাক বরং কথিত অভিযুক্তকে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক দেশপ্রেমিক খেতাব প্রদান অনেক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
ঋণ না নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ করা গেলে তা অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু প্রশ্ন হল তা কতটুকু বাস্তবসম্পন্ন। আবেগের বশে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা এগিয়ে আসবে এমন প্রতিশ্রুতি দিলেও তা নিকট ভবিষ্যতে কতখানি সম্ভব হবে? নির্বাচনী পালাবদলে এই সব ব্যক্তি বা সংস্থাও যে উল্টোপীঠ দেখাবে না তার নিশ্চয়তা আদৌ আছে কিনা তা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।
সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী এ বছরের সেপ্টেম্বরেই পদ্মাসেতু প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে বলে আমরা জেনেছি। এর জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ প্রকল্পের নদীর পাড় সংরক্ষণ, নদীশাসনসহ যেসব কাজ শুরু হবে তার জন্য এক হাজার কোটি থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ প্রকল্পে নয় হাজার ৮৬৮ কোটি, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাত হাজার ৭৮৬ কোটি এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাকি তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ চার বছরে প্রয়োজন হবে কমবেশি ২৩ হাজার কোটি টাকা।
এ হলো ব্যয়ের দিক। এই বিপুল ব্যয় নির্মাণে সরকারি পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে অর্থনীতির উপর যেসব সম্ভাব্য প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোকপাত করা যেতে পারে।
নিজস্ব অর্থায়নের তহবিল সংগ্রহে পত্রপত্রিকা ঘেটে যা জানলাম তাহলো, অনেক সংস্থা নাকি তাদের একদিনের বেতন প্রদান করবে, অভ্যন্তরীণ ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শেয়ারবাজার কর্তৃপক্ষও নাকি কোম্পানি গঠন করে পুঁজিবাজার থেকে পদ্মাসেতুর জন্য অর্থের যোগান দেবার প্রস্তাব দিয়েছে। আর বাতাসের উপর কল্পনার ঘর বাঁধার মতই এইসব আশ্বাসবাণী শুনে অনেকেই বলছেন, দেশে যে অর্থ আছে তা দিয়ে নাকি পদ্মার উপর তিনটি সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।
বিশ্বব্যাংকের সাথে ঋণ চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তের সাথে সাথেই পূর্ব ঘোষিত সহযোগী তিন সংস্থার প্রস্তাবও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এছাড়াও বিকল্প অর্থায়নের জন্য চীনের কাছ থেকে বিনা সুদে ২০০ কোটি ডলার দেওয়ারও প্রস্তাবের কথা পত্রপত্রিকাতে শোনা গেলেও বিশ্বব্যাংকের সাথে মিটিংয়ের জন্য দেশ ছাড়ার আগে অর্থমন্ত্রী তা নাকচ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে, পদ্মাসেতুর ব্যাপারে চীনের কোনো প্রস্তাব নেই এবং মালয়েশিয়ার ঋণ প্রস্তাব অনেক এক্সপেনসিভ। অর্থাত্ আপাতদৃষ্টিতে তেমন কোনও দাতা সংস্থাকে পদ্মা সেতুর সাথে আমরা সম্পৃক্ত দেখতে পাচ্ছি না।
পদ্মাসেতুর তহবিল গঠনার্থে ইতিমধ্যেই সরকার ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনের জন্য একটি বৈদেশিক মুদ্রা (এফসি) একাউন্ট খুলেছে। ভারতের ১০০ কোটি ডলার ঋণের মধ্যে ২০ কোটি ডলার অনুদান পদ্মাসেতুতে ব্যবহারের একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেই ২০ কোটি ডলারের প্রথম কিস্তিতে ৫ কোটি ডলার ইতোমধ্যে এফসি অ্যাকাউন্টে যোগ হয়েছে বলে আমরা জেনেছি। সেতু নির্মাণে বিদেশি মুদ্রা সংগ্রহের জন্য প্রবাসী ও বিদেশি যে কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিক্রয়ের লক্ষ্যে ৫০ কোটি ডলারের সভরেইন বন্ড ছাড়ার যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, তা থেকে প্রাপ্ত ডলারও এফসি অ্যাকাউন্টে জমা হবে বলে জানা যায়। তবে সভরেইন বন্ড ছেড়ে তা দিয়ে ডলার সংগ্রহ কতখানি বাস্তবরূপ পাবে আর তার প্রভাব অর্থনীতির ওপর কী হবে সেটাও ভাববার বিষয়।
এ কথা দ্ব্যর্থহিন কণ্ঠে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা ইতোমধ্যে স্বীকার করেছেন যে, আসলে পদ্মাসেতু নির্মাণে মূল সাহস যুগিয়েছে মূলত আমাদের ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিন দিন বাড়ছে, যা অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। গত বছরের তুলনায় ডলারের বিপরীতে শক্তিশালী হয়েছে টাকা। টাকার এ শক্তি সঞ্চয়ের মূল কারণ হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি এবং রফতানি আয় বেড়ে যাওয়া। যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বেড়ে গিয়েছে, যা অতি সম্প্রতি ১৩ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
এছাড়াও আইএমএফ’র বর্ধিত ঋণ সুবিধার দ্বিতীয় কিস্তির ১৩ কোটি ৯৮ লাখ ডলার অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে আগামী ৬ মার্চ জমা হলে আশা করা যায়। তখন রিজার্ভ বেড়ে ১৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে, যা নিঃসন্দেহে একটি দেশের অর্থনীতির জন্য সুখবার্তাই বহন করে।
তবে, পদ্মাসেতু প্রকল্পের জন্য রিজার্ভ থেকে অর্থ নিতে গেলে সরকারকে অবশ্যই তা টাকায় কিনে নিতে হবে। অর্থাত্ টাকায় কেনা ডলার এফসি অ্যাকাউন্টে রাখতে হবে। আর সরকারের হাতে টাকা না থাকলে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে ডলার কিনতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকারকে টাকার যোগান দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়তে পারে। এতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের মাঝে ঋণপ্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত হয়ে বিনিয়োগ ব্যহত হবার আশংকা রয়েছে।
যদিও অর্থমন্ত্রীর মতে আগের ডিজাইনেই পদ্মাসেতুর কাজ শুরুর জন্য প্রাপ্ত রিজার্ভ থেকে তিন বছরে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিয়ে পদ্মাসেতু নির্মাণ করলে কোনো সমস্যা হবে না বলেই আশ্বস্ত করেছেন। তবে উচ্চাভিলাষী এই প্রকল্পকে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে দুর্যোগপূর্ণ এই দেশের যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা ছাড়াও খাদ্য ও রপ্তানি পণ্যের উপকরণের আমদানি ব্যয় মেটানো, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি আমদানির জন্য দেশে তীব্র তারল্য সঙ্কটের সৃষ্টি হবে কী না তা মাথায় রাখতে হবে। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গেলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে যে চাপের সৃষ্টি হবে তা কাটিয়ে ওঠার মত আমরা কতখানি প্রস্তুত তা ভেবে দেখতে হবে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের জন্য পদ্মাসেতুর গুরুত্ব অপরিসীম। এ সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব অনেকাংশে কমে যাবে, যা দেশের অভ্যন্তরে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। তবে, শুধু ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন আর মুখে মুখে এখান থেকে সেখান থেকে অর্থ আসবে এইসব হিসাব না করে সরকারকে বাস্তবতাবান্ধব সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভোটের বাণিজ্যে পদ্মাসেতুর আড়ালে সমগ্র দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিকে অন্ধকারে ডুবিয়ে শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাবার সেতু হিসেবে পদ্মা সেতু ব্যবহৃত না হোক সেটা ভেবে দেখতে হবে সর্বাগ্রে।
জিনিয়া জাহিদ: বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নরওয়ে থেকে "ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ইকোনমিক্স"-এ এমএস শেষ করে বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের "খাদ্য নীতি" নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৩
আরআর